শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


ইউরোপ এবং আমাদের পরিচয় সংকট

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
অতিথি লেখক

ইউরোপ নিয়ে আমাদের বড় আহ্লাদ আজকাল। ইউরোপ মানেই ঝা চকচকে দুনিয়া। উদার এক পৃথিবী। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা তুলে ধরে আজকের ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার কাছে ‘সভ্য পৃথিবী’ হিসেবে নিজেদের গরিমা প্রকাশ করে থাকে। বিশেষত এশিয়া-আফ্রিকার তৃতীয় বিশ্বেরস মানুষের কাছে তারা নিজেদের উপস্থাপন করে সাক্ষাত দেবদূত হিসেবে।

কিন্তু ইউরোপ কি সত্যিই গরিমাধন্য? ইউরোপের ইতিহাস কি সেই সত্যকে সাপোর্ট করে? নাকি আজকের বস্তুবাদী ইউরোপ কেবলই রঙ করা এক খোলস মাত্র? যার ইতিহাসের নিচে লুকিয়ে আছে লুটেরা, ধর্মান্ধ আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এক জনগোষ্ঠীর মুখোশ। যারা খ্রিষ্টীয় ধর্মের দোহাই দিয়ে মানবহত্যাকে নিয়ে এসেছিল ধর্মরক্ষার গিলোটিনের তলায়।

আজকে ইউরোপ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র বাণী নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ফেরি করে ফিরছে গণতন্ত্র। ধর্মীয় উদারতার সবক শেখাচ্ছে বিশ্বের অপরাপর দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। কিন্তু এক সময়কার ইউরোপ নিজেরাই যখন ছিলো দারিদ্র্য, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ, লুটেরা, অসহিষ্ণু এক জাতি, তারা আজ কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষতর বুলি রপ্তানি করছে তৃতীয় বিশ্বের কাছে?

অথচ তাদের ধর্মান্ধতা আর ধর্মীয় কুসংস্কারের ফিরিস্তি দেখে খোদ শয়তান তাদের মুরিদ হওয়ার বায়না ধরতো।

এই সেই ইউরোপ, যারা ১৫ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ নারীকে পুড়িয়ে মেরেছে। এই নারীদের অপরাধ ছিলো-তারা শয়তানের পূজা করতো এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাদের ওপর এই অপরাধের দণ্ড দিয়েছিলো খ্রিষ্ট সমাজের গির্জার মহামান্য পুরোহিতগণ।

গির্জা কর্তৃক ঘোষণা ছিলো-যেসব নারী জাদু-টোনা করে, পানিপড়া-মন্ত্রপড়া দেয়, ডাকিনিবিদ্যা চর্চা করে, ভ্যাম্পায়ার হাজির করে, শয়তানের তপস্যা করে বলে সন্দেহ হয়, তাদের ধরে বিনা বিচারে হত্যা করতে হবে।

ইউরোপের ইতিহাসে একটুখানি নজর ফেরান, এমন হাজার হাজার হত্যাকাহিনি পড়তে পারবেন। খুব বেশিদিন আগের কথাও নয়, আজ থেকে দেড়-দুশো বছর আগেও প্রচলিত ছিলো এই মর্মন্তুদ ধর্মীয় হত্যাকাণ্ড। শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে শত শত নিরপরাধ নারীকে হত্যা করা হয়েছিলো ধর্মরক্ষার দোহাই দিয়ে।

এসব নারীদের হত্যার ধরণও ছিলো ভয়াবহ। কাউকে গির্জার প্রাঙ্গনে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে ফেলা হতো, কাউকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো, গাছের সঙ্গে লটকে ফাঁসি দেয়া হতো, নদীতে ডুবিয়ে মারা হতো, অন্ধকার কূপে ফেলে দেয়া হতো...

এমন আরও নানা নারকীয় পন্থায় তৎকালীন শাসক ও গির্জার পুরোহিতগণ হত্যার আদেশ দিতেন ‘ডাকিনিবিদ্যা চর্চাকারী’ নারীদের।

আজকের ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ড, সুইডেন-মোদ্দাকথা পুরো ইউরোপই ছিলো এই হত্যাকাণ্ডের উর্বরভূমি।

১২৭৫ সালে ফ্রান্সের অ্যাঞ্জেলা ডি লা বার্থি নামের এক নারীকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ‘শয়তানের সঙ্গে সঙ্গমে’ লিপ্ত হওয়ার অপরাধে!

১৪৩৫ সালে ডাকিনিবিদ্যা চর্চার কারণে জার্মানির অ্যাগনেস বার্নাউয়ের নামের এক নারীকে নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করে তার শশুর।

১৫৫০ সালে সুইডেনে ল্যাসেস বিরগিট্টাকে গিলোটিনে মাথা রেখে গলা কেটে হত্যা করা হয় একই অপরাধে।
১৭৮৯ সালে ইতালিতে জিওভান্না বোনানোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

সুইজারল্যান্ডে মিশে চাউডেরন, আমেরিকায় মার্থা ক্যারিয়ার, আয়ারল্যান্ডে ব্রিজিত ক্লেরি, বেলজিয়ামে জিয়ান ডেলভক্স, স্কটল্যান্ডে জ্যানেট... আরও হাজার হাজার নাম বলা যাবে। উইকিপিডিয়া বলছে, এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলো প্রায় দুই লাখ নারী!

Including illegal and summary executions it is estimated 200,000 or more "witches" were tortured, burnt or hanged in the Western world from 1500 until around 1800.

সন্দেহপ্রবণ এমন নারীদের দমন করার জন্য গির্জা কর্তৃক অনুপ্রাণিত বিশেষ বাহিনীও ছিলো। তারা অঞ্চলে অঞ্চলে ঘুরে ডাইনী-উইচদের শাস্তির ব্যবস্থা করতো। ইউরোপের ইতিহাসে এসব বাহিনীর বীরদের সমাদরে সমাদৃত করা হয় আজও। তাদের বীরত্বের কথা এবং হত্যাকৃত নারীদের ডাইনী সাজিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য কেচ্ছা-কাহিনি, রূপকথা, গল্প, উপন্যাস, ফিকশন এমনকি শত শত ব্লকবাস্টার সিনেমা।

ইউরোপ আজও সেই কল্পিত ধর্মান্ধতা এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের মহত্ব বয়ে বেড়াচ্ছে। তারাই আজকে পৃথিবীর কাছে বিক্রি করছে ধর্মীয় উদারতা আর ধর্মনিরপেক্ষতার মহান বাণী।

লেখক: তরুণ আলেম, কবি ও কথাসাহিত্যিক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ