শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


‘স্বপ্নের বিদ্যালয়’ চলছে সুবিধাবঞ্চিতের স্বপ্ন নিয়ে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কামরুল ইসলাম রুবেল
হবিগঞ্জ থেকে

পড়ন্ত বিকেল ঘড়িতে সাড়ে চারটা। শিক্ষা-সংস্কৃতি বিদ্যাপিঠের পথিকৃৎ হবিগঞ্জের নিমতলা কালেক্টর প্রাঙ্গনের কড়ই গাছের নিছে ৮/৯ জন শিশুকে পাঠদান করছে একজন কিশোর। গাছে ঝুলানো হোয়াইট বোর্ডে মার্কার দিয়ে সংখ্যা লিখছে এক শিক্ষার্থী।

এ যেন সেই টোল প্রথার মতো, শিক্ষাগুরুরা ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান করছেন।

হোয়াইট বোর্ডের উপড়ে লেখা ‘স্বপ্নের বিদ্যালয়’। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সবার বয়স হবে ৬/১২। পোশাক পরিচ্ছেদ দেখে বুঝা যায় তারা সাধারণ ছাত্র না, বিশেষ ছাত্র।

তারা সারাদিন বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে বিকেলে স্বপ্নের বিদ্যালয়ে আসে পড়তে। ১ম বা ২য় শ্রেনী নয়। একটি শিশু তার শিক্ষা জীবনের শুরুতে পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে শিক্ষা সর্ম্পকিত যে প্রাথমিক ধারণা বা জ্ঞান অর্জন (বাংলা, ইংরেজি বর্ণমালা, কবিতা, সংখ্যা গণনা) করে সেই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এবং নৈতিক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে দেয়া হচ্ছে স্বপ্নের বিদ্যালয়ে।

এই বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিশুই শহরের গরুর বাজার এলাকায় খোয়াই নদীর পাড়ের বস্তিতে বসবাস করে।
প্রায় ১১ বছর বয়সী দেওয়ান মিয়া। বাবা জজ মিয়া রিক্সা চালান। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছিল কিন্তু বেশি দিন পড়তে পারেনি স্কুলে।

৭ জনের সংসার চালাতে গিয়ে মা দয়া বেগম অনেক ঋণ করে ফেলেন। যার জন্য স্কুল ছেড়ে বোতলের বস্তা কাঁধে নিয়েছে দেওয়ান মিয়া। ‘সারা দিন বোতল থুকাইয়া(কুড়িয়ে) বেছলে(বিক্রি) শ’খানেক টেকা (টাকা) পাই। এই টেকাটা ঘরে দিলে আম্মার সাহায্য হয়। বাজার হাট করতে পারুইন।’

রিজন মিয়ার বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছে অনেক বছর আগে। মা পারুল বেগম তার দুই ভাই ও দুই বোনকে নিয়ে পরিবার চালাচ্ছেন অনেক কষ্ট করে। নদীর পাড়ে ভ্রাম্যমাণ একটি টং দোকানে চা, পান বিক্রি করেন তার মা। ‘ছয় জনের সংসারে আম্মার একলা রুজিতে (আয়ে) চলে না। তাই আমি ও বোতল, কাগজ, থুকাইয়া (কুড়িয়ে) টাকা দেই আম্মারে।’

স্বপ্নের বিদ্যালয়ে নিয়ে রিজন মিয়া বলে, ‘ভাইয়েরা খুব আদর করে পড়ান, নাস্তা খাওয়ান, টমটম ভাড়াও দিয়ে দেন, আমাদের বই-খাতা কিনতে হচ্ছে না। এ স্কুল থেকেই দেওয়া হচ্ছে। আমরা বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লেখাপড়া করছি। সারা দিন শহরে বোতল কুড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে যাই। তারপর ও বিকাল হলেই তাদের ভালবাসার টানে পড়তে চলে আসি।’

প্রায় একই রকম গল্প মারুফ মিয়া, সুফিয়ান মির্জা ও সুলেমান মির্জার। মনের আনন্দে শিখার আগ্রহ নিয়ে স্বপ্নের বিদ্যালয়ে আসে তারা।

‘স্বপ্নের বিদ্যালয়’ সুবিধা বঞ্চিত পথশিশুদের জন্য ‘স্বপ্নযাত্রা সোসাইটি’ র একটি শিক্ষা কার্যক্রম।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে এই বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের শিক্ষার্থী আছে ৯ জন। রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট থেকে ৫টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত নিমতলা কালেক্টর প্রাঙ্গনের কড়ই গাছের নিছে পাঠদান করা হয়।

বাংলা, অংক, ইংরেজি, চিত্রাংকন ও সাধরন জ্ঞান বিষয়ে পড়ানো হয়।

সংগঠনের সভাপতি মিজানুর রহমান আরিফের মনিটরিংয়ে নয়জন সদস্য রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নেন।

বিদ্যালয়ের ছাত্রদের খাতা, কলম,রং পেন্সিল, স্কেল সবই সরবরাহ করা হয়েছে সংগঠনের সদস্যদের নিজস্ব তহবিল থেকে।

‘স্বপ্নযাত্রা সোসাইটি’ র স্কুল কলেজের একঝাঁক কিশোর ও যুবক গত ২ বছর যাবত সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। ইফতার খাওয়ানো, ঈদবস্ত্র ও শীতবস্ত্র বিতরন করেছে। এছাড়াও বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযোদ্ধের চেতনায় উদ্বোধ্য করার জন্য শহর কেন্দ্রীক কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র প্রর্দশনী ও কুইজ প্রতিযোগিতার ও আয়োজন করা হয়েছে।

‘স্বপ্নযাত্রা সোসাইটি’ র সভাপতি মিজানুর রহমান আরিফ বলেন, ‘আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন শিশু সংগঠন ন্যাশনাল চিল্ডেন টাস্ক ফোর্স এ সভাপতি ছিলাম। ওই সংগঠনে কাজ করার সময় সুবিধা বঞ্চিত এই শিশুদের দুঃখ কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছি। তখন থেকেই তাদের জন্য ফলপ্রসু কিছু করার ইচ্ছা ছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারনে আমাদের সমাজের একাংশের শিশুদের মাঝে এখনো শিক্ষার আলো পৌঁছাতে পারে নি। যার ফলে সাধারন জীবন যাপনে তারা বিভিন্ন সমস্যার সমুক্ষিন হয়।

যেমন, তারা কেউ হিসাব জানে না তাই প্রায়ই বোতল বিক্রি করে সঠিক মূল্য নিতে পারে না। আমাদের এই ‘স্বপ্নের বিদ্যালয়’ করার আমাদের উদ্দেশ্য হলো। প্রাথমিক শিক্ষা না থাকার সুযোগে যেন এই শিশুদের কেউ ঠকাতে না পারে, সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশুরা যাতে অপরাধের দিকে পা না বাড়ায়।

তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসা। তাই আমরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে শিশুদের পাঠদান করছি।

বিদ্যালয় পরিচালনা করতে আর্থিক যোগানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ সংগঠনের ৮০ ভাগ সদস্য বিভিন্ন স্কুলের। এখানে সবাই বিনা পয়সায় পড়াচ্ছেন। আমাদের পকেটের পয়সা দিয়ে শিশুশিক্ষার্থীদের বই-খাতা কিনে দিচ্ছি।

বড় ধরনের কোন ডোনেশন এখনো পাইনি কারো কাছ থেকে। তাই সদস্যদের কাছ থেকে যার যার সাধ্য অনুযায়ী চাদাঁ সংগ্রহ করেই এই স্বপ্নের বিদ্যালয়ের কাজ চলছে।’

এভাবে যদি প্রতিটি শিক্ষার্থী তাদের আশপাশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারে এগিয়ে আসে তাহলে একটা শিশুও পড়াশোনার বাইরে থাকবে না। পথ শিশুদের শিক্ষার কাজ করার মাঝে এত আনন্দ আগে বুঝিনি-আশা করি আমাদের এই কার্যক্রমের সাথে সমাজের সকলে এমনি এগিয়ে আসবে।


সম্পর্কিত খবর