শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


সৌদি যুবরাজের ভিশন ও পশ্চিমা সখ্যতা দেশের উন্নয়নের জন্য হলে সমস্যা কোথায়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র সৌদি আরব। রাজনৈতিক অর্থনৈতকি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিবেচনায় পৃথিবীর দুইশ কোটি মানুষের কাছে সৌদি আরব শুধু একটি দেশ নয় অনুকরণীয়ও বটে।

সাম্প্রতিক সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের ঘোষিত ভিশন ২০৩০ নিয়ে চলছে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনা। যুক্তি তর্ক ও গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই বাস্তবতা বেরিয়ে আসে। তথ্যস্বল্পতা ও না জানার কারণে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

আওয়ার ইসলাম বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের নবীন প্রবীন চিন্তাশীল আলেমদের মতামত প্রকাশ করছে, এ বিষয়ে আজ আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন চিন্তাশীল আলেম, গবেষক ও কবি মুসা আল হাফিজ। কবি মুসা আল হাফিজ সময়ের প্রতিধ্বনী বুঝেন, চিন্তার পরিপক্ষতা ও গভীর পাঠ তাকে ভিন্ন উচ্চতা দিয়েছে।

সৌদি আরব বিষয়ে তার খোলামেলা আলোচনা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন আওয়ার ইসলামের নির্বাহী সম্পাদক রোকন রাইয়ান।

আওয়ার ইসলাম: সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান যে উদারনীতির ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি দিয়ে দেশ বিদেশে আলোচনা চলছে, আপনার দৃষ্টিতে বিষয়টি কেমন?

মুসা আল হাফিজ: সৌদি যুবরাজ উদারনীতির ঘোষণা দিয়েছেন। এর কিছু দিক অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। কিছু দিক সমাজ- সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকারের সাথে সম্পর্কিত।

অর্থনৈতিক সংস্কারের যে প্রকল্প, সেটা দরকারি, একান্তই দরকারি। সৌদিকে অবশ্যই তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে উত্তরণ পেতে হবে। কিন্তু তেলনির্ভর অর্থনীতি সৌদিকে যে বিপুল পেট্রো-ডলার দিয়েছে, তা দিয়ে টেকসই উন্নয়ন তো অনেক আগেই হয়ে যাওয়ার কথা।

আসলে সৌদি আরব উন্নয়ন বলতে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর উন্নয়নকেই প্রাধান্য দিয়েছে। অথচ কয়েকটি শহর আর কয়েক হাজার সড়কের উন্নয়ন আসল উন্নয়ন নয়।

জনসম্পদের উন্নয়ন, ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা ও বৈষম্য দূরিকরণ, শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, প্রায়োরিটি ভিত্তিক উৎপাদনসক্ষমতা, খাদ্য, প্রতিরক্ষা ইত্যাদিতে স্বনির্ভরতা অর্জন- এ জাতীয় বিষয়ে দেশটির অগ্রগতি কোথায়?

অথচ তেলের অর্থস্রোত তো থামেনি। নগদ অর্থের প্রবাহ ভোগ ও দুর্নীতিকে প্রণোদিত করে কখনো কখনো। সৌদিতে এমনটা যে হয়ে চলে, তা সোনার টয়লেট বা সোনার সিঁড়ি থেকে নিয়ে অসংখ্য নজিরের দ্বারা পরিষ্কার।

অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে আগেও। কাজ করেনি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় তা অসফল হয়েছে। মুহাম্মদ বিন সালমান যে সংস্কারের কথা বলছেন, তাকে অর্থনীতিবিদরা উচ্চবিলাশীই বলছেন।

হোক উচ্চবিলাশী। কিন্তু বিদ্যমান অপচয়, বিলাশ ও দুর্নীতিগ্রস্থ অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সংস্কার যতক্ষণ না হচ্ছে এবং বাহারি শহর গড়া, অট্রালিকার জেল্লা দেখানোর প্রবণতা ইত্যাদি থেকে অগ্রসর হয়ে তৃণমূলে মৌলিক ও গণউন্নয়নের পথে যতক্ষণ অগ্রগতি না হচ্ছে, ততক্ষণ বিশাল বাজেটের ব্যাপক পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার শংকাই প্রবল।

একটি দিকের সম্পর্ক সংস্কৃতি ও ধর্মের সাথে। সৌদি সমাজে প্রচলিত কোনো কুশংস্কারের দায় অবশ্যই ইসলাম নেবে না। ইসলামের নামে নারীদের কর্ম, বৈধ ক্ষেত্রে বিচরণ ও চলাফেরার সুবিধা হরণ যদি হয়ে থাকে, সেটা দূরিকরণ আবশ্যক।

অমুসলিম নারী বা অপ্রযোজ্য ক্ষেত্রে মুসলিম সংস্কারের বাধ্যবাধকতা আরোপের বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আধুনিক অর্থনীতি কর্মক্ষেত্র নারীদের ভূমিকা নিয়ে সজাগ। ইসলাম সেই প্রয়োজনকে প্রত্যাখান করে না।

তবে পর্দা ও পোষাকে বিধি আরোপ করে। সে বীধি নারীর কর্মক্ষমতাকে কমায় না, অর্থনীতির চাকাকেও পেছনে ঠেলে না। সে বিধি বহাল রেখে উন্নতি সম্ভব। এখন যদি, উদারবাদের প্রকল্প হয় সে বিধি থেকে মুক্তি, তা হবে দুঃখজনক।

আওয়ার ইসলাম: অনেকের কাছে যুবরাজের ভিশন ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার হাতিয়ার, এ কারণে তিনি পশ্চিমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন যা মুসলিম বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে। আপনার কি মনে হয় এমন কিছু ঘটছে বা ঘটবে?

মুসা আল হাফিজ: দেশের উন্নয়নে কেউ পরিকল্পনা নিলে সেটাকে ক্ষমতা পোক্ত করার প্রকল্প বলে ভাবতে হবে কেন? উন্নয়ন পরিকল্পনা ক্ষমতার দায় এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার দাবি। কিন্তু সেটা দেশের জন্যই হয়। এর সুফল ভোগী হয় দেশের জনগণ।

কেউ যদি ক্ষমতা পোক্ত করার জন্যেও সুফলদায়ক পরিকল্পনা নেয়, মন্দ কী? আমি এখানে সমস্যা দেখি না। পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব মন্দ নয়, যদি তা দেশ ও জাতির প্রয়োজন পূরণ করে। মুসলিম রাষ্ট্র তাদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে সালাহুদ্দিন আইয়ুবির সময়ে, ভয়াবহ যুদ্ধকালেও।

সে সম্পর্ক রক্ষিত হবে রাষ্ট্রের স্বার্থ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির আলোকে। সেটা অধীনতামূলক মিত্রতা হলে সমস্যা। যে দেশ এমনটি করে, সে ডুবে, ডুবেই।

আওয়ার ইসলাম: আপনার কথার প্রেক্ষিতে বলতে হয়, যুবরাজের এই নীতি ও ভিশনে আপাতত ক্ষতির কিছু নেই বরং তারুণ্যের অগ্রযাত্রার মাইলফলক?

মুসা আল হাফিজ: কোনো ভিশন তারুণ্যকে প্রবুদ্ধ ও প্রলুব্ধ করলে তার সাফল্য নিকটতর বলা যায়। কিন্তু প্রলুব্ধকরণ কোন অর্থে? কী দিয়ে? এমন কিছু দিয়ে নয়তো, যা তারুণ্যের তরল আবেগকে উদ্দীপিত করে! সেটা করে বলেই সে উদ্দীপিত।

এমন হলে তাকে সত্যিকার সংস্কার পরিকল্পনা বলা কঠিন। তারুণ্য যদি উদ্দীপিত হয় কর্মশক্তি, জীবনমান ও শিক্ষার উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, সামর্থের বিকাশ ও সুযোগের প্রসারতার কারণে, তাহলে সে উদ্দীপন অবশ্যই অভিনন্দনের।

কিন্তু উদ্দীপনের প্রয়োজনে কিছু উন্নয়ন চিন্তা আর কিছু পশ্চিমা মুক্তসমাজচিন্তার (জেন্ডার প্রশ্নে) মিশ্রণে যা হবে, ইসলামের জীবনবোধ তাকে বিপজ্জনক বলেই দেখে।

পশ্চিমা উন্নয়নের-শিল্পায়ন, উদারিকরণ, উন্মুক্তকরণ ইত্যাদি দিক অবশ্যই প্রয়োজন বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায়।কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক যে উদারবাদ, একে গ্রহণ না করেই এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে হবে।

আওয়ার ইসলাম: সৌদি আরবের মতো একটি দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উদারনীতির ফলে নৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসলে কি তাই? আবার অনেক ক্ষেত্রে শোনা যায় সেখানে সাধারণের মধ্যে নৈতিক অধোমুখিতা প্রকট।

মুসা আল হাফিজ: আরবের সমাজ নৈতিক অর্থে রক্ষণশীলতা অনেকটা হারিয়েছে। আকাশ সংস্কৃতি প্রবলভাবে সেখানে পশ্চিমা চিন্তার অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা চিন্তা যৌনতার প্রশ্নে উদারবাদী, উন্মুক্ততাকামী।

আকাশ সংস্কৃতি, ভারসাম্যহীন পশ্চিমাপ্রীতি, সেখানকার চিন্তা ও সাহিত্য আরবকে নিয়ে গেছে বহুদূর। আরবের কোনো সরকার বাহ্যিক আইন দিয়ে এই পরিবর্তনকে ঢাকতে ও আটকাতে চেয়েছে। এটা কাজ করেছে বহুক্ষেত্রে। সয়লাব সৃষ্টি হতে দেয়নি। ইসলামি পরিবারবোধ ও ঐতিহ্যের প্রতি সমীহটা অন্তত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি।

সৌদি আরব যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে আর যদি কিছুটা পশ্চিমা সাংস্কৃতিক উদারবাদের দিকে এগুয়, মনে করি বিপর্যয় বানের পানির মতো সামগ্রিক রূপ নিতে থাকবে।

আওয়ার ইসলাম: অনেকের অভিমত যুবরাজের ঘোষিত উদারনীতি, এটাই মূল ইসলাম এবং মধ্যপন্থা। আর ইসলামে কঠোরতার স্থান নেই। এ সম্পর্কে আপনার মতমত জানতে চাচ্ছি…

মুসা আল হাফিজ: নাহ, এটা ইসলামের কোনো রূপ হবে কেন? ইসলামের রূপ একটাই। ইসলামের উদারবাদ চারিত্রিক প্রয়োজন ও জৈবিক প্রয়োজনে ভারসাম্য নিশ্চিত করে। নাগরিক ও মানবিক অধিকার এবং জনকল্যাণ প্রশ্নে সে আপোষহীন। আরব জাহানে নাগরিক অধিকারের দশা কী?

পশ্চিমা উদারবাদ অধিকার সচেতন বটে, কিন্তু পেটের প্রয়োজন ও যৌনতার প্রয়োজনের বেলায় সর্বোচ্চ ছাড় দিতে চায়। মানবিক ও পাশবিক বৃত্তির ব্যবধান ঘুচাতে প্রস্তুত সে। দুই উদারবাদ এক হতে পারে না।

আওয়ার ইসলাম: এছাড়াও সম্প্রতি সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানোর যে অনুমতি দেওয়া, স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখা, সিনেমা হল এবং সিনামা নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মুসা আল হাফিজ: নারীরা গাড়ি চালাতে পারবে কি না- সেটা ফিকহি বিতর্ক। বিদ্যমান বাস্তবতায় যথাযত শর্তে এর বৈধতা নিয়ে সমস্যা কোথায়? সমস্যা থাকলে এর স্পষ্ট সুরাহা একশ’ বছর আগে হওয়া উচিত ছিলো। তাহলে আজ এ বিষয় নিয়ে ইসলামকে বিদ্রুপের সুযোগ পেতো না অমুসলিমরা।

নারীর ভোটাধিকার, তার গাড়ি চালানো- এসব নিয়ে বিভিন্ন আইন তর্ক করেছে শত শত বছর আগে। সুরাহাও প্রাচীন। কিন্তু আমরা এখনো ভোগছি। এগুলো খুবই বিব্রতকর।

সিনামা হল, স্টেডিয়াম ইত্যাদিতে নারীকে যেতে না দেয়া পশ্চিমা বিবেকের কাছে অপরাধ মনে হয়। কিন্তু ইসলামী বিবেকের তো একটা বিচার আছে।পশ্চিমা সংস্কৃতির চোখে এটা ভয়ানক অনাচার। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতির তো একটা চোখ আছে।

মুসলিম রাষ্ট্র যদি ইসলামী সংস্কৃতির চোখ দিয়ে বিষয়টিকে দেখে- সেটাই তো উচিত- সেখানে সমস্যা থাকার কী আছে? একটি মুসলিম রাষ্ট্র পশ্চিমা চাপকে উপেক্ষা করে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে পারে।তাহলে তাদের চাপকে উপেক্ষা করে মুসলিম সংস্কৃতি ও বিবেকের চোখ দিয়ে এগুলোকে বিচার করতে পারবে না কেন?

আওয়ার ইসলাম: তাহলে বিনোদনের ইসলামিক নির্মাণ তো আমরা মেনে নিতে পারি এবং বর্তমানে বিনোদনের প্রয়োজন মেটাতে আরব তরুণরা যেভাবে পশ্চিমায় ঝুঁকছে সেটা থেকে বিরত করতে এর বিকল্প নেই।

মুসা আল হাফিজ: বিনোদনের ইসলামি ভাবধারা জীবনকে আনন্দ দেয়, শিক্ষা দেয় কিন্তু প্রবৃত্তির উস্কানিকে প্রশ্রয় দেয় না। চলচ্চিত্র যদি ইসলামের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করে নির্মিত ও প্রদর্শিত হয়, সেটা নিয়ে সমকালীন বাস্তবতায় ইতিবাচকভাবে ভাবা যেতে পারে।

পশ্চিমা প্রবণতায় ঝুঁকে পড়ার সমাধান পশ্চিমা প্রবণতায় আত্মসমর্পণ নয়। সৌদি আরব থেকে আমরা আশা করি, এই প্রবণতার যথার্থ সমাধান ইসলামের বিনোদন নীতিতেই খুঁজতে হবে।

বিনোদন প্রশ্নে ইসলাম কীভাবে তারুণ্যের মন- মানসকে উজ্জীবিত করে এবং প্রযুক্তি যুগে এর প্রায়োগিক রূপ কী হতে পারে, এ নিয়ে মনস্তত্ত্ব এবং ইসলামি জ্ঞান ও চিন্তার বৈশ্বিক প্রতিনিধিদের নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণার প্রয়োজন ছিলো। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতো শরীয়া নির্দেশিত বিকল্প।

কিন্তু যুবরাজ তড়িঘড়ি করেছেন, নিজেদের পছন্দ ও অভিপ্রায়কে চাপিয়ে দিয়েছেন, যেমনটি করতেন গাদ্দাফি। যদি চমকের ইচ্ছা প্রবল না হতো, ধৈর্য ও নিষ্ঠা নিয়ে পশ্চিমা বিনোদনপন্থার শরীয়া নির্দেশিত বিকল্প অনুসন্ধান করা হতো, তাহলে ঐতিহাসিক একটি দায় শোধ হতো। মান্ধাতার আমলের সিনেমা হলে সমাধান খুঁজতে হতো না।

আওয়ার ইসলাম: বিজ্ঞানভিত্তিক ‘নিওম’ নামের যে শহর গড়ে তোলার কাজ হাতে নিয়েছেন যুবরাজ এটিতো দেশটির যুকবদের জন্য পজিটিভ দিক।

মুসা আল হাফিজ: অবশ্যই ভালো দিক।

আওয়ার ইসলাম: আপনি হয়তো জেনেছেন, সৌদি আরবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু প্রতিনিধিত্বশীল আলেমকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এটা সৌদিসহ মুসলিম বিশ্বের জন্য কতটা সুখকর?

মুসা আল হাফিজ: আইন লংঘনে জেল স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ভিন্নমতের কারণে জেল? প্রতিবাদের অধিকার একটি সভ্য সমাজে থাকতে হয়। ইসলাম তো এর চর্চা ও লালনের নজির রেখেছে। সেই অধিকারের চর্চায় জেলে যেতে হয় যখন, তখন বুঝতে হবে এটা বিপজ্জনক।

আওয়ার ইসলাম: কাতার ইস্যুতে সৌদিকে যেভাবে আগ্রাসী হতে দেখা গেছে, সেটা কতটুকু ঠিক মনে করেন?

মুসা আল হাফিজ: কাতার ইস্যু দেখিয়ে দিয়েছে, সৌদি জোটের নিজস্ব, স্বাধীন কোনো পররাষ্ট্রনীতি নেই। কাতার প্রশ্নে তাদের ইচ্ছা আর ইসরাইলের ইচ্ছা সমান্তরাল। উভয়ের স্বার্থ এক মোহনায় মিলিত হয়েছে
যা অবশ্যই আমেরিকার ইচ্ছের আওতায়।

আওয়ার ইসলাম: এখানে শিয়া সুন্নি কেন্দ্রিক একটা সমস্যা উঠে আসে, সেটাকে আপনি কতটা বিবেচনায় রাখছেন।

মুসা আল হাফিজ: সৌদি জোটের ভুল পলিসি কাতারকে ইরানের পক্ষপুটে নিয়ে গেছে। নতুবা কাতার ইরানের সাথে আগে যে সম্পর্ক রাখতো, সে সম্পর্ক আরব আমিরাত বা ওমানের মতোই।

আওয়ার ইসলাম: শিয়াপ্রধান রাষ্ট্র ইরান যেভাবে আধুনিক বিষয়াবলী অবলম্বন করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং শক্তি অর্জন করছে সেটা দেখেও কি সুন্নি রাষ্ট্রগুলোর হাতগুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ আছে?

মুসা আল হাফিজ: শিয়া-সুন্নী কেন্দ্রিক সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু এটি আরব-ইসরাইল সমস্যার চেয়ে গুরুতর নয়। এখানে ছাড় দেয়ার জায়গা আছে, কৌশলগত ঐক্যের জায়গা আছে, সেখানে তা নেই।

সুন্নী রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে শিয়া রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে বলে নয়। এটা দৃষ্টিভঙ্গীর বিপর্যয়। কিন্তু দেখছি সেটাই। এর ফলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে ইরান ও সৌদিতে। বিভক্তি লাভ করছে চরম আকার। প্রতিটি রাষ্ট্রকে এগিয়ে যেতে হবে আপন সুরক্ষার প্রয়োজনে।

বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ সম্প্রসারণবাদী ইহুদীবাদ। সে আপন প্রয়োজনে মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন বিন্যাস দিতে চায়। এ কাজে তার সাথে আছে সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ। তারা নয়া ক্রুসেডী প্রকল্প নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সামনে দাঁড়িয়ে।

সে অপর মুসলিম রাষ্ট্রকে যেমন এক মুসলিম দেশের শত্রু বানাচ্ছে, তেমনি অমুসলিম জগতকে টার্গেটকৃত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোন সুযোগে লেলিয়ে দিচ্ছে।

এ প্রেক্ষাপটে প্রস্তুতি থাকতে হবে সামগ্রিক, প্রচারযুদ্ধ, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক কিংবা একান্ত প্রয়োজনে সামরিকতার প্রয়োগে প্রস্তুত থাকা চাই। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই কোনো রাষ্ট্রই সক্ষমতার জায়গায় নেই। কিন্তু ইরান তো এগিয়ে গেলো।

স্থিতিশীল রাজনীতি,প্রভাবশালী কুটনীতি,নিজস্ব মিডিয়াজাল, প্রতিরক্ষা­সক্ষমতা, শিয়াবাদের সম্প্রসারণ, ইরাক-সিরিয়া, ইয়ামান ইত্যাদিতে শিয়াবাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাসহ নানা ক্ষেত্রে সে সফল? কেন সফল?

যুদ্ধ, অবরোধ, আন্তর্জাতিক শত্রুতা সত্তেও সে সফল, মাথা তুলা স্বকীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি, রাজনৈতিক সংস্কার, গণসম্পৃক্তি এবং জাতিয় নেতৃত্বের পাশে জ্ঞানভিত্তিক, দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রবল ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টায়।

কোনো সুন্নী রাষ্ট্র এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারেনি। এটা না করে ইরানের বিরুদ্ধে দামামা বাজিয়ে কোনই লাভ নেই। সুরক্ষিত মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ইরানকে তার উদগ্র শিয়াবাদ থেকে সরে এসে সুন্নী রাষ্ট্রগুলোর সাথে পারস্পরিক মর্যাদাভিত্তিক সহাবস্থান করতে হবে।

আরব রাষ্ট্র ও ইরানকে পরস্পরের বিরুদ্ধে হাতিয়ার শাণানো থেকে মুক্তির পথ খুজতে হবে। নতুবা ইসরাইল তাদেরকে শাসন করবে। এক হাত দিয়ে শিয়াদের,আরেক হাত দিয়ে সুন্নীদের।

তাদের বিরোধের জায়গা পরিষ্কার।কিন্তু যে সব জায়গায় তারা এক সাথে এগুতে পারে, সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে বহুদূর যাওয়া যায়।

আওয়ার ইসলাম: উপমহাদেশের আলেমদের সাথে সৌদি আলেমদের সম্পর্ক খুব কম। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক করাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? সম্পর্ক না থাকলে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া কী হতে পারে বলে মনে করেন?

মুসা আল হাফিজ: এ যোগাযোগ খুবই প্রয়োজন। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন। জ্ঞান ও গবেষণাগত আদান-প্রদান বাড়ানো, জ্ঞানগত সফর, পাঠের দান-গ্রহণ, অনুবাদ ও প্রকাশনাকেন্দ্রিক যোগাযোগ, এবং যৌথ অংশগ্রহণের কিছু নিয়মিত ইলমি ও ফিকরি আয়োজন ফলপ্রসূ হবে, মনে করি।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ