শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


একজন নীরব সাধক, পীরে কামেল ও মুখলেস মানুষের কথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মুহাম্মদ আমিনুর রশিদ

আল্লাহ তায়া’লার প্রিয় সৃষ্টি এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুগে যুগে এমন কিছু মানুষ দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছেন, যাদের পেয়ে দুনিয়া গর্বিত। যাদের স্পর্শে সভ্যতা ফিরে পেয়েছে প্রাণচঞ্চলতা।

মানবজাতির গর্বিত এই শ্রেণির অগ্রভাগে রয়েছেন নবী-রাসুলগণ আ.। নবী-রাসুলগণের এই ধারাক্রম হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে খাতামুন্নাবীয়্যিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এসে পরিসমাপ্তি ঘটে।

নবী-রাসুলগণের পর একাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য চালু করা হয়েছে ‘ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ার’ ধারা। ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ার এই ধারায় নবী-রাসুলগণের পর তাঁদের পদাংক অনুসরণে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন হযরাতে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী’ন, তাবে তাবেয়ী’ন, আইয়িম্মায়ে মুজতাহিদ্বীন, আওলিয়ায়ে কেরাম, ওলামায়ে কেরাম ও মশায়েখে ই’জামগণ।

নবুওয়াতী ধারার এই গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার সূত্র ধরেই আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশেও প্রেরিত হয়েছেন অসংখ্যা ধর্মপ্রচারক অলি আল্লাহ।

জামিয়া আহলিয়া হাটহাজারীর প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ের শেরপুরস্ত ও মহান মুরব্বি, শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা শাহ্ জমির উদ্দিন রহ. এর অন্যতম খলিফা, চট্টগ্রাম পটিয়া জমিরিয়া কাছেমুল উলুম মাদরাসা (আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া) এর প্রতিষ্ঠাতা মুহ্তামিম, কুতুবুল আক্তাব, হাদিয়ে মিল্লাত আল্লামা মুফতি আজিজুল হক রহ. ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।

তারই সুযোগ্য উত্তরসুরী ও ছাহেবজাদা, মুর্শিদে কামিল, মুসলিহে উম্মত, আলহাজ মাওলানা হাফেজ মাহবুর রহমান রহ.।

তিনি ১৩৫৭ হিজরী সন মোতবেক ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া চরকনাই গ্রামে নিজ পিতৃলয়ে জম্ম গ্রহণ করেন। ছিদ্দিকী বংশের এই নক্ষত্রের বংশ পরিক্রমা পরস্পর মিলিত হয়ে ইব্রাহিম গোরির সাথে মিলিত হয়েছেন।

হযরতকে তার বাবা কুতুবুল আকতার আল্লামা মুফতি আজিজুল হক রহ. সর্বপ্রথম তার গৃহ শিক্ষক হযরত কারী মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ. এর কাছে নুরানী কায়দা ও কুরআন শরীফ শিক্ষা করার ব্যবস্থা করেন।

এরপর মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার হেফজ বিভাগে মাওলানা হাফেজ নুরুল ইসলাম (ছিপাতলী, হাটহাজারী) রহ. এর কাছে পবিত্র কুরআন হেফজ করার জন্য ভর্তি করে দেন।

হেফজ শেষ করে ১৩৭০ হিজরী সনে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় ‘জামাতে ইয়াজদাহুমে’ ভর্তি হন। তিনি ১৩৭৬ হিজরীতে বাবার নির্দেশে জিরি ইসলামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে মাত্র এক বছর শিক্ষার্জন করে ১৩৭৮ হিজরী সনে আবারও আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় ‘জমাতে ছওম এ ভর্তি হয়।

সে ধারাক্রমে ১৩৮১ হিজরিতে ‘দাওরায়ে হাদিস’ শেষ করেন। তারপর ১৩৮২ হিজরিতে তিনি আল্-জামিয়া আল্-ইসলামিয়া পটিয়ায় শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তিন বছর শিক্ষতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি বাবার নির্দেশে জমাতে হাস্তুমে অধ্যায়নরত অবস্থায় চট্টগ্রামস্থ মরহুম আব্দুর রশিদ সওদাগরের বাসায় শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা আবদুল কাদের রায়পুরী রহ. এর হাতে বায়আ’ত গ্রহণ করেন।

আল্লামা রায়পুরী রহ. এর ইন্তিকালের পর ১৩৮২ হিজরি মোতাবেক ১৯৬২ সালে যখন হযরত হজ আদায় করার জন্য পবিত্র মদিনায়ে মুনাওয়ারায় তাশরিফ নিয়েছেন তখন সেখানে শায়খুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া সাহারনপুরী রহ. এর সাথে সাক্ষাত করে হযরতের হাতে ‘রুজুয়ে বায়আ‘ত” করেন।

অলিয়ে কামিল, আল্লামা আলী আহমদ বোয়ালবী রহ. (আল্লামা মুফতি আজিজুল হক রহ. এর খলিফা) ১৪১৫ হিজরী সনে হযরতকে চার তরিকার খিলাফত প্রদান করেন।

তিনি আশেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাল্ফে সালেহীনদের রীতি-নীতির পদাংক অনুসারী ছিলেন।

১৯৫৪ সালে জামাআতে হাস্তুমে অধ্যয়নরত অবস্থায় হযরত রায়পুরী রহ. এর হাতে বায়আত গ্রহণ করার পর থেকে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনদিন তাহাজ্জুদের নামাজ মিস করেননি।

হযরত বলতেন, ‘আমি যেদিন আমার হযরতের হাতে বায়আ’ত গ্রহণ করি, সেদিন থেকে আমার আর তাহাজ্জুদের নামাজ কাজা হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ!’

এমনকি যেদিন শাদি হয়ে আমার বাসররাত হয়, সেদিনও তাহাজ্জুদের নামাজের সময় আমাকে আব্বা ডাক দিয়ে বললেন, ‘মাহবুব! উঠ উঠ তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে’।

হযরত আরো বলতেন, এখনো পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজের সময় কোন কারণে যখনই দেরী হওয়ার সম্ভনা দেখা দেখা যায়, (আব্বা আমাদের যেমন করে জীবিতাবস্থায় ডাকতেন) ঠিক তখনই আব্বার আওয়াজ শুনতে পাই। আব্বা ডেকে ডেকে বলেন, মাহবুব উঠ উঠ তাহাজ্জুদের সময় হয়েছে।

তিনি শ্রদ্ধেয় মুরব্বীগণের পরামর্শে বিশেষ করে জিরি মাদরাসার শ্রদ্ধেয় মুহাদ্দিস হযরতুল আল্লামা অবদুল অদুদ রহ. এর নির্দেশনায় ও দোহাজারী এলাকবাসীর অনুরোধে ১৯৬৬ সনে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী এলাকায় আগমন করেন।

সেখানে তার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান, কুতুবুল আক্তার আল্লামা মুফতি আজিজুল হক রহ. কতৃক পরিদর্শন ও ভবিষ্যৎবাণীকৃত জায়গায় ১৯৬৯ সনে “দোহাজারী আজীজিয়া কাছেমুল উলুম মাদরাসা” প্রতিষ্ঠিত করেন।

হযরতের উল্লেখযোগ্য উস্তাজগণের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা মুফতি আজিজুল হক রহ.। প্রতিষ্ঠাতা মুহ্তামিম, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

শায়খুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া সাহারনপুরী রহ.। হযরত তার কাছে ভারতের সাহারনপুরে অবস্থানরত অবস্থায় বোখারী শরীফের সবক পড়ে ইলমে নববী অর্জন করেন।

আল্লামা ইমাম আহমদ রহ.। প্রথম শায়খুল হাদিস ও মুদারিরস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

আল্লামা ইছহাক আল-গাজী রহ. শায়খুল হাদিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম। হযরাতুল আল্লাম আমীর হোছাইন (মীর সাহের হুজুর রহঃ) মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

আল্লামা আবদুল অদুদ রহ. মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া জিরি, চট্টগ্রাম। হযরাতুল আল্লামা জনাব মুফতি নুরুল হক রহ. মুহতামিম, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া জিরি, চট্টগ্রাম।

আল্লামা জনাব হাজী ইউনুছ রহ. সাবেক মুহতামিম ও মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম। আল্লামা আলী আহমদ বোয়ালবী রহ. সাবেক ছদরে মুহ্তামিম ও মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

আল্লামা নুরুল ইসলাম ক্বাদীম রহ. সাবেক মুহতামিম ও মুহাদ্দিস,আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া। আল্লামা মাওলানা ওবাইদুর রহমান রহ. (নায়েবে মুহতামিম আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া।

তিনি একজন অত্যন্ত পরহেজগার, অবিচল মুত্তাকী ও দুনিয়াবিমূখ সাধাসিধে জীবনে চলাফেরাকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার মুখমন্ডলেই ভেসে উঠত তাক্ওয়া ও পরহেজগারীর চিহ্ন। সর্বক্ষেত্রে “ফত্ওয়া ও সুবিধাবাদ” নীতি পরিহার করে “তাক্ওয়া ও সাবধানতা” নীতিকেই প্রধান্য দেওয়াই হল তার বর্ণাঢ্য জীবণের অন্যতম বৈশিষ্ট।

বিভিন্ন ওয়াজ মাহ্ফিলে হযরতের কান্নাজড়িত,রূহানীয়তপুর্ণ ও আখেরাতমুখী বয়ান, ওয়াজ ও নসিহতে শ্রোতাদের জীবনে এক অকল্পনীয় আমলী পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত।

হযরতের প্রতিষ্ঠিত তাক্ওয়া ও তাওয়াক্কুলের নিদর্শন দোহাজারী মাদরাসার বার্র্ষিক মাহ্ফিল আল্লাহ প্রেমিক পাগলদের এক মিলন মেলায় পরিনত হত। জামাআ’তে নামাজ পড়া, ফরজ ও নফল ইবাদত, কোরআন তেলোয়াত, পর্দা, লেনদেন, তা’লিম ও তারবিয়াতে এক অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ছাত্রদের নৈতিক শিক্ষা ও আমলী জিন্দেগীর পাবন্দ করে গঠনে অদ্বিতীয় প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি।

তিনি গত ৬ মুহাররম ১৪৪৯ হিজরি, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বুধবার দুপুর ২.১৫ মিনিটে পটিয়া মাদরাসা সংলগ্ন নিজ বাসায় মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে হাজারও শিক্ষার্থী, মুহিব্বিন ও মুতাআ’ল্লেকীনকে চির এতিম করে ইন্তিকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

সেই দিনেই রাত দশটায় আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রামের সুবিশাল মাঠে হযরতের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জামিয়া’ দারুল মা’রিফ আল ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভী।

জানাজায় আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম এর মহা পরিচালক আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী, জামিয়া আহলিয়া হাটহাজরীর সহকারী মুহতামিম আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী, চট্টগ্রাম-১১ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, দোহাজরী আজিজিয়া কাছেমুল উলুম মাদরাসার মুহ্তামিম মাওলানা ইসমাইলসহ সর্বস্তরের ওলামা মাশায়েখ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থী ও মুহিব্বীনগণ উপস্থিতিত ছিলেন।

জানাজার পর হযরতকে জামিয়ার পশ্চিম পার্শ্বে সংরক্ষিত ‘মাকবারায়ে আজিজিয়’ দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ তায়া’লা হযরতকে এবং সকল মরহুম মুরব্বীগণকে জান্নাতুল ফেরদাউসের আ’লা মক্বাম নসিব করুন। আমিন।

লিখক: সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি
খতিব,বায়তুশ শরফ জামে সজিদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ