শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ. আমাদের গড়েছিলেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

সালটা মনে নেই। মনে রাখার চেষ্টাও করিনি। জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে হেদায়াতুন্নাহ্ব পড়ি। আশৈশব শিক্ষাগুরু হযরত মাওলানা কুতবুদ্দীন রহ.-এর কামরা থেকে মাদরাসার দক্ষিণ দালানের দিকে কি একটা কাজে যাচ্ছিলাম। সারিবদ্ধ কামরা, আসাতিযায়ে কেরাম বসবাস করেন। কোনার কামরাটার দরজা একটু ফাঁক ছিল। নজর পড়লো ভিতরে। সুবাহানাল্লাহ কি হেরিলাম! শ্বেত শুভ্র বসন, সফেদবর্ণের মাদানী দু’পাল্লা টুপি শিরোপরি ভূষিত। ছোট্ট অবয়বের এক মহান অস্তিত্ব প্রভু সমীপে নিবেদনরত। চোখ বিস্ফোরিত হল। সারাটা কামরাই যেন স্বেতশুভ্র সূচিতায় বিভাময় হয়ে আছে। আলোর ঝটকা প্রভা ছড়াচ্ছে। এত আলোময় মানুষ দেখেছি বলে মনে পড়লো না।

তিনি যে বাহ্যিকভাবে এতটা ফর্সা ছিলেন না সে দিকে আমার নজরও গেলো না। হৃদয়ের তাবৎ নূরময়তায় গাত্রবর্ণ ছিলো উজ্জ্বল। চেহারা দ্যুতিময়।এই ছিলো আপাদমস্তক হাদীস বিশারদ, শব্দের পরতে পরতে ডুব দিয়ে জ্ঞানসমুদ্রের মণিমাণিক্য আহারী সত্তা হযরত মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ.-এর সাথে এই অধমের প্রথম দর্শন।

‘ফির তো মর মিটা’ সঁপে দিলাম অজান্তে নিজেকেই। এই অধম বঙ্গভাষা চর্চায় তখন অতি উৎসাহী। বাঙালিত্বের ফযীলত অন্বেষায় উদগ্রীব। ক্রমে প্রতীতি পেলাম হযরত মাওলানাও এ বিষয়ে একান্ত আগ্রহী। কত দিন বলেছেন, বড় কাটারা মাদরাসায় পড়ানোর সময় প্রতিদিন বিকালে গাঁটের পয়সা খরচ করে পাবলিক লাইব্রেরীতে আসতেন আর তারাশঙ্কর, মনোজবসু, শংকর, যাযাবর, বিমলমিত্র, মুজতবা আলীদের গোগ্রাসে গিলতেন।

একদিন বললেন, আজ তিন রাত ঘুমাইনি। বিমলমিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ খতম হলো। এই অধমও একটু আধটু বঙ্গকীর্তন করি। বাবার কাছে মধু কবির মেঘনাদবধ সবে শেষ করে কালিদাসের মেঘদূতের পাঠ নিচ্ছি। রবীন্দ্র-নজরুল তো নস্ব্যি। মনে আর স্বভাবে মিলে গেলো।

অবসরে কাজী হুযূরের কাছে ঘুরঘুর করি। তিনিও হয়তো বনেদী মাদরাসার পরিবেশে এই বঙ্গসন্তান পেয়ে আহ্লাদিত হয়েছিলেন। সে কালে বিষয়টা ছিলো দুর্লভ। তাই নিজেকে উজাড় করে গড়ে পিটে নিচ্ছিলেন অধমকে। তালীম ও সতর্ক তরবিয়্যাতের সেই শুরু। মরণের শেষ তীর্থ পর্যন্ত যা অবিচ্ছিন্ন নিরবধি অব্যাহত ছিলো।

হযরত কাজী হুযূর রহ. ছিলেন দেদীপ্যমান মহা ভাস্কর শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর চেতনায় আপ্লুত। এক রত্তি তা থেকে হটা ছিলো তাঁর জন্য মৃত্যুতুল্য। এই আমাকেও রাঙ্গাতে ব্রতি হলেন সেই অভিরঞ্জনে। আমার শৈশব পরিবেশ হযরত শাইখুল ইসলাম রহ.-এর নাম ততবেশী শুনতে অভ্যস্ত ছিলো না। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুনি তাঁর কাছে ইতিহাসের সেই মহানায়কের কথা। তাঁর সংগ্রাম, তাঁর মেধা, তাঁর তাকওয়া, যুহদ ও কানাআত আর ইলমী সমুদ্র মেখলার ধারা চিত্রণ। ক্রমে একটা জামাআত তৈরী হলো হযরত কাজী হুযূর রহ.-কে ঘিরে।

ইসলামের স্বভাব, ইসলামের মেজায আকাবির বিষয়ে আমাদেরকে সতর্ক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করলেন। বিশেষ করে হযরত মাদানী রহ.-এর ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন হাদীসের সঠিক চেতনা বদ্ধমূল করার প্রয়াস নিলেন। তিনি আমাদের বুঝালেন ইসলাম কত উদার, অসাম্প্রদায়িক, সহনশীল জীবনবাদী আদর্শ।

রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় বলতেন, ইসলাম প্রশাসনিক বিচারিক ও সামাজিক কাঠামোতে ধর্মনিরক্ষেতার জামানত দেয়। এর সমর্থনে বহু কুরআন-হাদীস এবং সাহাবাগণের জীবনাচার পেশ করতেন। পাকিস্তানের মতোসাম্প্রদায়িক কাঠামোয় আমরা লালিত ও বর্ধিত। ইসলামের ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা শুনে প্রথম প্রথম কানে বেশ খটকাই লাগতো। তিনি আমাদের নানা সন্দেহ দূর করার প্রয়াস নেন। আস্তে আস্তে আমাদের মনচৈতন্য স্থৈর্যানুকুল হলো।পরবর্তীতে কিছু কিছু বিষয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে মতানুকুল না হওয়ায় নিজেকে জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে সরিয়ে নেন এবং কাতলা সেন মাদরাসার দরসে বুখারীর পাশাপাশি হযরত মুফতী মাহমুদ রহ. এবং হাজারভী রহ.-এর নেতৃত্বে জমিয়ত উলামার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন।

তিনি মুফতী মাহমুদ রহ.-কে হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর চিন্তাধারার বলিষ্ঠ অনুসারী বলে ভাবতেন। মুফতি সাহেবও তাঁকে অত্যন্ত ধীমান ও গভীর প্রজ্ঞার অধীকারী এবং হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ. এর চিন্তা চেতনার বলিষ্ঠ ধারক বলে ভাবতেন। অনেক সময় বলতেন তোমরা কাজী সাহেবকে মাটির উপরে যতটুকু দেখছো মাটির গভীরেও তিনি তা-ই। বাতিলের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত প্রহরী। ইসলামের আওয়াজে যেভাবে বাতিল চোরাই পথে সমাজে স্থান করে নিচ্ছিলো বিশেষ করে মওদুদীবাদীদের তিনি সবিস্তারে মুখোশ খুলে ধরেন।

খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের ছিলেন অন্যতম সিপাহসালার। ঢাকায় হযরত মাদানী রহ.-এর চিন্তাচেতনার অধিকারী কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান ছিলো না। হযরত দরখাস্তী রহ. তার সঙ্গীরা মিলে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ি ঢাকায় একটা প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্র হিসেবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এর কর্ণধার হিসেবে সবার দৃষ্টি ছিলো হযরত কাজী হুযূরের প্রতি।

তিনি কাতলা সেনের নিরাপদ উপার্জনের সুশান্ত আশ্রয় ছেড়ে বুখারী দরসের স্থলে এক কথায় সবকিছু কুরবানী দিয়ে আশৈশব লালিত স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে ঢাকায় চলে আসেন। অথচ বলতে গেলে মাদরাসাটি তখন একটা মকতব মাত্র। স্ত্রী-পুত্র সংসার এবং নিজেকে নিঃশেষ উজাড় করে দিয়েছিলেন এই মাদরাসাটি গড়ে তুলতে। মনে পড়ে একদিন ঢাকায় সারাদিন হেঁটে একটা পয়সাও জোগাড় করতে পারেননি। তবুও তার উৎসাহে চেষ্টায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়তে দেখা যায়নি। পরিশ্রম সহ্য করতে না পেরে অনেক দিন রক্ত প্রস্রাব হতো তার তবু ছিলেন হাস্যময়।

মাদরাসার ব্যস্ততায় নয় মাস একবারে বিবি বাচ্চার খোঁজ নিতে বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারেননি তিনি। একে ঘিরেও তাঁর চোখে ছিলো এক স্বপ্নীল চিত্র, হৃদয়ে ছিলো তার এক স্বপ্নগাঁথা। সৌভাগ্য, তিনি অধমকেও এই স্বপ্নের সঙ্গী করেছিলেন। স্বাধীনতার পর এক সময় মওলবী নামের কিছু ষড়যন্ত্রীদের চক্রান্তে যখন তাকে এই মাদরাসা ছেড়ে আসতে হয়েছিলো তখন থেকেই তিনি অনেকটা উদ্যমহারা হয়ে পড়েছিলেন। এই কষ্ট কখনও আর ভুলতে পারেননি তিনি। আমাকে তিনি প্রায়ই স্বপ্নভঙ্গের এই কষ্টের কথা বলে সান্ত্বনা পেতে চাইতেন।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি এতে সক্রিয় অংশ নেন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ লাভ করেছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকায় প্রথম মাদরাসা খুলেন এবং অন্যানন্য মাদরাসাসমূহ চালু করার প্রয়াস নেন। চারণ গায়কের মতো ঢাকার অলিগলিতে তিনি ঘুরেছেন। আলিম-উলামাদের সাহস দিয়েছেন। প্রায়ই বলতেন, আমার ঈমান যদি আমি রক্ষা করতে উদ্যমী হই তবে কোনো শক্তি নেই তা ছিনিয়ে নেয়ার। বলতে গেলে তার প্রচেষ্টায় ঢাকার মাদরাসাগুলো পুনরায় চালু হয়।

সূত্র : আজ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ