মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


পুঁজিবাদের কবলে হত দরিদ্র রিক্সা চালক; আমরা কেন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এ এস এম মাহমুদ হাসান
গণমাধ্যম কর্মী

আমি চা আড্ডায় মাঝে মাঝে অনুজ অগ্রজদের সাথে বিষয়টি ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে শেয়ার করি। আজ বগুড়ার একটি হৃদয় বিদারক চিত্র সে বিষয়গুলো পাঠকদের সাথে সংক্ষিপ্তভাবে শেয়ার না করলেই নয়।

এ দেশ ধীরে ধরে চলে যাচ্ছে পুঁজিবাদিদের হাতে। সেটা কিভাবে? নামি দামি কোম্পানি ও অর্থলোভী উদ্যোক্তারা এখন প্রান্তিক মানুষের ব্যবসায়ও হাত দেওয়া শুরু করেছে।

অতি সুক্ষ্মতার সাথে বিনিয়োগ ও সব ধরনের ব্যবসায় মনোনিবেশ করছে পুঁজিবাদীরা। ফলে যত্রতত্র (যত নিম্ন এলাকাই হোকা না কেন) বড় বড় মেগা শপ ও শপিংমল গড়ে তোলা হচ্ছে।

এই শপগুলোকে টেকাতে ছোট ছোট দোকান ও ফুটপাত ব্যবসায়ীদের তাড়া করা হচ্ছে প্রসাশনের পক্ষ থেকে।
হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ভ্রাম্যমান দোকানীর রুটি রুজির বিকল্প ব্যবস্থা না করে হুট করে সে এলাকায় বড় শপিংমল গড়ে তোলা হয়। আর সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড় কোনো কোম্পানির অর্থায়নে হচ্ছে।

বিনিময়ে সরকার এক জায়গা থেকেই বিপুল ট্যাক্স ও চাঁদা আদায় করতে পারছে।

বিপুল বাজেট সামলাতে ছোট ছোট দোকানীদের থেকে ট্যাক্স আদায় করা সরকারের জন্য যেমন মুশকিল তেমনি দোকানীদের উপর দলীয় প্রভাব খাটোনোও দুরুহ।

নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসার পেছনে বেঁচে থাকে এক একটি সম্ভাবনাময়ী পরিবার। কিন্তু পুঁজিবাদি কিছু সংখ্যাক অর্থলোভী ডাকাতদের প্ররোচনা ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তিলে তিলে নিঃস্ব করা হচ্চে কোটি কোটি মানুষকে। ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের স্বপ্ন।

রাষ্ট্রের দু দিন পর পর বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন ও নির্দেশাবলী দ্বারা প্রতিয়মান হচ্ছে, আইনগুলো বাস্তবায়ন বা প্রয়োগের ক্ষেত্র শুধুমাত্র খেটে খাওয়া শ্রমিক আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। উচ্চবিত্ত কিংবা এলিট শ্রেণীদের কাছে আইন যেন হাতের মোয়ায় রূপ নিয়েছে। আর সরকারও বেছে বেছে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য তৈরি করছে প্রবল শক্ত আইন। এই আইনের প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে প্রান্তিক সমাজের নিরিহ লোকদের উপর।

এর উদাহরণ টানতে হলে সম্প্রতি বগুড়ার দিকে লক্ষ করুন। একজন হত দরিদ্র রিকশাওয়ালার স্বাদের রিকশাকে বুলডোজার দিয়ে মাটিতে পিষে ফেলল প্রশাসন। হত দরিদ্র লোকটির অপরাধ ছিল সরকার নিষিদ্ধ ব্যাটারি চ্যালিত রিকশা চালাতেন তিনি। এক বিদ্যুৎ অপচয়ের অপরাধে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হলো অসহায় রিকশাওলার স্বপ্ন। বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল হারিয়ে পুরো একটি পরিবারকে নিশ্চিত পথের ভিখারি বানিয়ে ছাড়ল সরকার। এতে ক্ষমতাবান প্রশাসনের হৃদয় চুল পরিমাণও কাঁপেনি।

আচ্ছা, এই বিদ্যুৎ বাঁচাতে খেটে খাওয়া হত দরিদ্রকে নির্দিষ্ট মেয়াদে জেলে নেওয়া যেত, অথবা রিক্সা আটকিয়ে রাখা যেত। ব্যাটারি খুলে ফেলা যেত। কিন্তু এতসব উপায় অবলম্বন না করে বুল ডোজার দিয়ে গুড়িয়ে একজন অস্বচ্ছল মানুষকে পথের ভিখারি বানানোর কোনো দরকার হয়?

পুঁজিবাদী শ্লোগান ধরে সর্ব সাধারণ জনগনকে দীর্ঘ মেয়াদে পথের ভিকারি বানিয়ে ছেড়ে দিবে। আর জনগন নাকে খত দিয়ে ক্ষমতাবানদের মোয়াফেক চলতে বাধ্য হবে। পৃথিবীর বুক থেকে নিরিহ মানুষদের আর্তনাদে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জমিদারী প্রথা ফিরিয়ে আনার এত জঘন্য প্রয়াস কেন?

এ দেশের বড় বড় কোম্পানী কর্তৃক সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার তথ্য পাই। তাদের অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ব্যবহারের সন্ধান পাওয়ার সংবাদ পাই। এ দেশের অসংখ্য দলীয়, নির্দলীয়, বড় বড় ব্যবসায়ীদের বিদ্যুৎ চুরি করার নিউজ আসে পত্রিকায়। কিন্তু সেসব রাঘব বোয়াল অর্থ পিশাচদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির খোঁজ খবর আমরা পাই না।

অথচ একজন খেটে খাওয়া রিক্সা চালকের বাড়ির বিদ্যুৎ মিটার ঘুরিয়ে চার্জ দেওয়া ব্যাটারি বিশিষ্ট রিক্সা বড় অপরাধ করে বসে। (অথচ এ ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার টাকা রাষ্ট্র পাচ্ছে। ) আইনের নির্মম ব্যাখ্যা ও অপপ্রযোগর মাধ্যমে অপমৃত্যু ঘটে একটি পরিবারের জীবিকা ও জীবনপ্রবাহের।


সমাজের গুটি কয়েক মানুষের হাতে পুরো একটি দেশের অর্থনৈতিক শক্তি তুলে দিয়ে পুরো জাতিকে সর্বশান্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার মাঝে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে বুযৃয়াদের। রয়েছে ক্ষমতা ও সক্ষমতার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের শক্তি।

ফলে এ দেশে অর্থনৈতিক শক্তির নেতৃত্বদানকারী কোম্পানিদের স্বার্থ রক্ষায় নতুন নতুন আইন করা হচ্ছে। যে আইনগুলো মোটেই ধনী ও এলিটদের গা ছুঁতে পারে না। তাদের জন্য করা আইনের ফাঁক ফোকর রাখা হয়।

বছরের পর বছর আইন প্রয়োগে মিমাংসার নামে তামাশা লক্ষ করা হয়। আর বগুড়ার হত দরিদ্র, রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের শিকার রিকশাওয়ালার পরিবারের মত লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক পরিবারকে আইনের আশ্রয়ের সুযোগ না দিয়ে নিমিশেই ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা হয়।

বড় বড় কোম্পোনিকে অর্থের যোগান দিতে সরকার গরিবের দোকানের পাশে শমিং মলের/বাজার তৈরির অনুমোদন দেয়। পরক্ষণেই গরিবের পেটে লাথি মেরে দোকানটা তুলে দেয়া হয়। এ দেশের হাজার হাজার প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার চাহিদা নিবারণ করছে। একটি রাষ্ট্রের কাছে চাওয়া নাগরিকদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমুন্নত করছে।

অথচ সরকার নতুন নতুন আইন করে এ খাতকে গুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। এতে যেমন শিক্ষাখাতে সরকারের উপর বাড়তি চাপ পড়বে ঠিক তেমনি লক্ষ লক্ষ পরিবার আয়ের উৎস হারিয়ে নিঃস্ব হবে। এ দেশের কোটি কোটি মানুষ এখনো নিম্ন আয়ের। খেটে খাওয়া খানুষ এরা। আমাদের বুঝতে হবে, এ দেশ গরিবের। এ দেশে সাধারণ জনগনের। সিংহভাগ পুঁজিবাদী অর্থলোভীরা উন্নত বিশ্বের নাগরিক । এ দেশের টাকা ভিন্ন দেশে ব্যয় করে ধ্বংস করছে আমাদের দেশের সম্ভাবনা। দেশের টাকা ওপারে পাচার করে এসব ক্ষমতাবান অর্থপিচাশেরা পিছেয়ে রাখছে আমাদের দেশের নাগরিকদের।

সুতরাং সজাগ থাকুন। সামাজিক ও এলাকাভিত্তিক সংগঠন তৈরি করুন। আপনার এলাকার গরিব নিরিহদের অত্যাচার নিপিড়ন করে কোনো অর্থপিচাশ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কিছু করতে চাইলে প্রতিবাদে জ্বলে উঠুন। প্রতিহত করুন।

তিউনিসিয়ার তৎকালীন বেন আলীর গদি কাঁপানো আবর বসন্তের মত বিপ্লব ঘটানোর মন মানসিকতা তৈরী রাখুন। যত কিছুই হোক, এদেশটা আমার।আমার মায়ের। পুঁজিবাদীর মন মাতানো শ্লোগান আর উন্নয়নের ঢাক- ঢোলের খপ্পরে পরে, এলাকার উন্নয়নের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে মাথা নত না করে নিজেদের অস্তিত্ব টেকাতে সরব থাকুন।

আগে গরিবদের বাঁচান। তাহলে রাষ্ট্র বাঁচবে। নতুবা এ দেশ একদিন পুঁজিবাদের খোয়াড়ে ভিন দেশীদের পুতুল হবে। আমরা হব তখন বর্গীদের শোষণের শিকার। আমাদের প্রজন্ম থাকবে অনাদিকাল পরাধীন।


সম্পর্কিত খবর