শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


মুহাজির (রোহিঙ্গা) ক্যাম্পে খোলা আকাশের নিচে দুরাকাত নামাজ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি শামছুদ্দোহা আশরাফী 

সফরের ৩য় দিন। কাফেলার রোখ কুতুপালং ক্যাম্প। মেইন রোড থেকে প্রায় ২ কিলো.  ভেতরে। এখানে নতুন মাজলুম রোহিঙ্গারা এসে আশ্রয় নিয়েছে। প্রায় কয়েকশ পরিবারের আবাস!  নারী, পুরুষ আর শিশু মিলে কয়েকহাজার মানুষ অবস্থানস্থল।

প্রাপ্ত তথ্য মতে তখনো তাদের কাছে কোন ত্রাণ পৌঁছেনি। ব্যবস্থা নেই বিশুদ্ধ পানির। জরুরত সাড়ার মত নেই টয়লেট। এমনকি অর্থাভাবে অনেকে তাবুও বানাতে পারেনি। তাই অবস্থান করছে খোলা আকাশের নিছে।

শুনতেই কেমন যেন লাগল!বুকটা কেঁপে উঠল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যেকোন ভাবেই হোক সেখানে যাব।
একটি মসজিদ মাদরাসা নির্মাণের পাশাপাশি মাজলুমদের প্রয়োজনানুপাতে সাহায্য করার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ।

বিষয়টা মুন্তাজিম মাহমুদ গুনবি সাহেবকে জানানো হল। তিনি রাহবার ঠিক করে দিলেন। বাদ যোহর রওয়ানা করলাম।কাফেলা এগিয়ে চলল। দুর্গম পাহাড়ি পথ। উঁচু নিচু টিলা,পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে চলছি সামনের দিকে। পাহাড়ের ঢালে মানুষ আর মানুষ। যতদূর চোখ যায় শুধু বিভিন্ন রংয়ের তাবু।

কিছুদূর যাবার পর আমরা হাঁপিয়ে উঠি। পা জোড়া আর চলতে চায় না। ঘামে পুরো শরীর ঘেমে গেছে। লেগেছে প্রচণ্ড পানির পিপাসা। কিন্তু কোথায় পাব পানি? তাই কিছু না বলে চলতে লাগলাম।

Image may contain: 3 people, people sitting, child and outdoor

রাহবার আশরাফ ভাইও আমাদের মতই। বাড়ি মোমেনশাহী। মুহাজিরদের নুসরতে আছেন বেশ কদিন যাবত।চলাফেরায় বুঝলাম, কয়েকদিনে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। তিনি আমাদের অবস্থা টের পেলেন। তাই পাহাড়ের উপর পুরনো ক্যাম্পে অবস্থিত এক মাদরাসায় গিয়ে যাত্রা বিরতি করলেন। মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকরা খুব মেহমানদারী করলেন আমাদের।পাহাড়ি নলকুপের সুমিষ্ট পানি পান পিপাসা মিটালাম।

আবার শুরু পথচলা।তালাশ করতে থাকলাম মসজিদ মাদরাসা করার উপযুক্ত জায়গা। এক পাহাড় আরেক পাহাড়। অবশেষে আমাদের কাংখিত স্থান খুঁজে পেলাম। আমাদের দেখেই লোকজন জড়ো হতে লাগলেন।
কিন্তু একটা জিনিস খুব অবাক করল আমাদের!

এখানে আমাদের সামনে কেউই হাত পাতছে না! কিছু চাচ্ছেও না!! অথচ রাস্তার পাশে নামা মাত্রই লোকদের দৌঁড়াদৌড়ি শুরু হযে যায়।

বিষয়টা আমার মত বাকিদেরও অবাক করল। তাই বিষয়টা নিয়ে আমরা কানাকানিও করলাম।

আরেকটা বিষয় খেয়াল করলাম। এখানে তো অনেক মানুষ! তারা কি ত্রাণ নিতে রাস্তায় যায় না? ঘরের ভিতরেও দেখলাম প্রায় প্রতিটা ঘরেই মা বোনরা অবস্থান করছে।

কৌতূহল জাগল, তাহলে রাস্তার পাশে কারা? কারা ত্রাণ নিয়ে টানাটানি করছে?
জিজ্ঞাসা করলাম তাদেরই একজনকে।
তিনি জানালেন, তারা ত্রাণের জন্য যান না !
তাহলে খাচ্ছেন কি? চলেন কিভাবে?
জানালেন, নিজেরা হিজরতের সময় সাথে নিয়ে আসা টাকা দিয়েই স্থানীয় বাজার থেকে জিনিস পত্র কিনে চলতেছেন।

কারো নগদ অর্থ শেষ হয়ে গেলে প্রিয়তমা স্ত্রীর সোনা গয়না অথবা কলিজার টুকরা মেয়ের নাক কানের গয়না বিক্রি করে চলছেন।

আমাদের গল্পের ফাঁকেই অনেক লোক জড়ো হলেন। তাদের একটাই দাবি, আমাদের কিছুই প্রয়োজন নাই, এমনকি খাবার দাবারও না। এক মুরুব্বি তো এসে কেঁদেই দিলেন। আর বলতে লাগলেন শুধু একটি মসজিদ চাই।

Image may contain: sky, outdoor and text

আজ কয়েকদিন যাবত নামাজ পড়তে পারছি না। আমরা মসজিদ নির্মাণ করব শুনে তারা অনেক খুশি।
অনেক যুবক প্রস্তুত হয়ে গেলেন স্বেচ্ছাশ্রম দেয়ার জন্য।

কয়েকজন নেমে গেলেন জায়গা মাপায়। আর কয়েকজন ছুটে গেলেন বাঁশ ইত্যাদি আনতে। আমরাও যেতে চাইলাম। কিন্তু তারা আমাদের মোটেও কাজ করতে দিতে নারাজ।

এখানে মসজিদ হবে এটাই তাদের বড় প্রাপ্তি। কি যে খুশি তারা !তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আজকের আসরের নামাজ জামাতের সাথে এখানেই পড়ব।ইনশাআল্লাহ।
সবাই যার যার কাজে চলে গেল।

আমরা বসলাম মাজলুম ভাইদের নিয়ে। শুনতে থাকলাম তাদের সুখ দুখের গল্প। কারো সন্তান শহীদ হয়েছে। কারো ভাই । কারো পরিবার পরিজনের একজন সদস্যও বেঁচে নেই। কিছু ভাই নিজেদের জখমের জায়গাগুলো দেখাতে লাগলেন।

আহ ! কি নির্মমতা! কি নিষ্ঠুরতা!! এযেন পশুত্বকেও হার মানায়।

গল্পে গল্পে আসরের সময় হয়ে যায়।কিন্তু এখনো মসজিদ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের অবস্থানস্থল থেকে বাজার অনেক দুরে। তাই বাঁশ ইত্যাদি আনতে সময় লাগছে।

অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলাম খোলা আকাশের নিচেই নামাজ পড়ব।

সফরসঙ্গী নন্দিত মুফাসসিরে কোরআন আবুল কালাম তৈয়িবী সাহেব সুমধুর কণ্ঠে আজান দিলেন। আজানের আওয়াজ শুনে অনেক দৌঁড়ে আসতে লাগলেন। সবার চোখে মুখে অানন্দ। যেন বহুদিন পর তারা প্রশান্তি লাভ করেছেন।

Image may contain: one or more people and outdoor

ইমামতির দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। আমিও না করিনি।

নামাজ শুরু করার আগে ভাবলাম, নামাজের নিয়মটা একটু বলে নেই।

অবাক হলাম তাদের মাসআলা সম্পর্কে অবগতি দেখে!

আমি যখন বলতে চাইলাম “আমি মুসাফির হিসেবে দুরাকাআত পড়ব, আপনারা... সাথে সাথে এক মুরুব্বি ইংগিত দিলেন আমরা জানি। শুনে খুব ভালো লাগল।আবার দুঃখও লাগল। আহ ! মুরুব্বী বুঝি ধরেই নিয়েছেন দীর্ঘ সময় তার মাতৃভূমিতে যাওয়া।

তাই এটাই তাঁর ওয়াতনে এক্বামাত!
তাদের নিয়ে দুরাকাআত নামাজ আদায় করলাম।
তারা মুকীম হিসেবে চার রাকাআত পূর্ন করল।
নামাজ শেষে দোয়া করলাম।

দোয়ায় বারাবার বলতে লাগলাম, আয় আল্লাহ ! আরাকান কে স্পেন বানিও না! মুসলমানদের হারানো সালতানাত তাদের হাতে ফিরিয়ে দাও।

নিজের জন্মভূমি রক্ষার আন্দোলনে মাাজলুম ভাইদের কে মুক্তিযুদ্ধ করার তাওফিক দাও। তাদের হিম্মত দাও।

লেখক: খতিব; বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার(সাইন্সল্যারেটরী) কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ