শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


উসমান-আজিদার যে গল্প শুনলে গা শিউরে ওঠে!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইউছুফ জালাল: ২৫ আগস্ট বর্মী বাহিনী রোহিঙ্গা নিধন শুরু করলে আরকানের প্রতিটি গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায় পরিবারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মিলিটারি গণহারে খুন করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার নতুন অধ্যায় সূচনা করে। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ বাদ যায়নি । চোখের সামনে পেলের রক্তের হুলি খেলায় মেতে উঠে।

২৯ আগস্ট সকালে মংডু উপজেলার ছোট গজিবিলের দম্পতি আব্দুল শুক্কুর (৪০) ও রশিদা বেগম (৩৬ ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তারা নাফ নদীর পাড়ে পৌঁছালে, সেখানেও মিলিটারি তাদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে।

এসময় প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাপ দেয় তারা। আব্দুল শুক্কুরের বড় ছেলে উসমান (১৭) দৌড়ে ঝুপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। উসমানের চোখের সামনেই গুলি করে সৈন্যরা তার বাবা-মাকে খুন করে। খুন করে তার চার ভাইকেও। পালিয়ে বেঁচে যায় তার ছোটবোন আজিদা বেগম (১৩)।

উসমানের কাছে জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমার চোখের সামনে বাবা মা মিলিটারির গুলিতে মারা যায়। ছোট চার ভাই যাদের বয়স ১০ বছরের নিচে তারাও। মিলিটারি বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ না করলে ছোট ভাইকে বাঁচাতে পারতাম। তার গাঁয়ে গুলি লাগেনি। পানিতে ডুবে মারা গেছে। অন্যদের শরীর গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে গেছে।

ছোটবোন আজিদার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম তখন। মিলিটারির গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে, বাবা মাকে নদী থেকে তুলতে গিয়ে দূরে দেখতে পাই আজিদা পড়ে আছে একটি ধান ক্ষেতের আইলের উপর। দ্রুত তার কাছে যাই। সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়েছিল। তাকে তোলে নিয়ে ছোট্র টিলার কাছে নিয়ে শুয়ে দিই। ততক্ষণে তার জ্ঞান ফিরে আসে।

জ্ঞান ফিরে আসলে আমি আবার বাবা মাকে তুলতে নদীর দিকে যায়। তখন দেখতে পাই মিলিটারি নদীর দিকে আসছে। আমি আজিদাকে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাই। দূরে গিয়ে লুকিয়ে দেখি লাশগুলো পানি থেকে তোলে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলছে মিলিটেরী।”

উসমান যখন এ প্রতিবেদককে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ট্রাজেডির কথা বলছিল, তখন তার ছোট বোন আজিদা গোঙ্গিয়ে কেঁদে কেঁদে ওড়না দিয়ে চোখ মুছছিল।

উসমান জানায়, তাদের সাথে দেখা হয় বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাওয়া একটি রোহিঙ্গা কাফেলার । তাদের সাথে বাংলাদেশে আসে তারা ।

উসমান আরো জানায়, হত্যার শিকার তার পিতামাতা ও ভাইদের জন্য যতটা না কষ্ট হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি তার বোন আজিদা বেগমের জন্য চিন্তা হয় তার।

সে বলে, ‘বোনের মুখের দিকে তাকালেই বুক ফেটে যাই ‘। বলতে বলতে এবার ওসমানও কাঁদতে শুরু করে ।

ভাই-বোন দু’জনই বর্তমানে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে লংবীচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করছে ।রাতের বেলা আজিদা রেজিস্টার্ড এক রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবারের সাথে থাকে। আজিদার কাছে সেদিন কি হয়েছিলো জানতে চাইলে, “কিছুই জানিনা” বলে উত্তর দেয়। বর্তমানে কি অবস্থায় আছে জানতে চাইলে সে বলে, বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়েছিলাম। এখানে এসে যাদের বাড়িতে আছি তাদের কাছ থেকে এক জোড়া কাপড় নিয়ে পড়ছি। মা-বাবা আর ভাইদের খুব মনে পড়ছে”।

পাঠক, আমরা হয়তো উসমান ও আজিদাকে খুঁজে পেয়েছি । শুনেছি তাদের দুঃখময় সদ্য অতীতের বাস্তব গল্প । কিন্তু এমন শত শত আজিদা ও ওসমান ক্যাম্পে আছে যাদের কেউ বাবা, কেউ মা, কেউ ভাই, কেউ বোন, কেউ স্বামী, কেউ সন্তান কিংবা কেউ পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে । সবার জীবনের গল্প হয়তো তুলে আনা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু আমরা সবাই উপলদ্ধি করতে পারি “রক্তাক্ত আরাকানের” বর্মী হায়েনারা কতটা নৃশংসতা চালাচ্ছে রোহিঙ্গাদের উপর ।

সূত্র: আরাকান টিভি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ