শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

বার্মায় মুসলমানদের করণীয় বিষয়ে ১৯৬১ সালে দেয়া আলি মিয়া নদভীর ভাষণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী

বার্মায় মুসলমানদের সংকট অনেক পুরাতন। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে এ সংকট। অবশ্যই এর সাথে বিশ্ব রাজনীতি ও পলিটিক্স জড়িত। তাই আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিকভাবেই তা সমাধান করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মুসলিম বিশ্বের নেতাদেরকে এ ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে কোনো কালেই এতে স্থায়ী সমাধান বয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

আমার বিশ্বাস বার্মায় মুসলমানদের চলমান সংকটের সমাধান তাদের হাতেই। তাদেরই স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। ইসলাম ছাড়া তাদের কোনো সমাধান নেই। বৌদ্ধ বার্মায় ইসলামের দাওয়াত যত তাড়াতাড়ি প্রসার করা সম্ভব হবে, তত তাড়াতাড়ি তাদের সমাধান বের হয়ে আসবে। বিশ্ব সম্প্রদায় কোনো কালেই তাদের সমাধান দিবে না, দিতে পারবে না। সেখানে ইসলামের দাওয়াত প্রসারের মধ্যেই তাদের সমাধান। তারা যত তাড়াতাড়ি এই বাস্তবতাটি বুঝতে এবং কাজের ময়দানে নেমে পড়তে সক্ষম হবে, তত তাড়াতাড়ি তাদের সমাধান বের হয়ে আসবে।

কোন পথে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান? এ সম্পর্কে আজ থেকে প্রায় ৫৭ বছর পূর্বে ১৯৬১ সালে বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ও মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. আরাকানের মুসলমানদের উদ্দেশ্যে সে কথাগুলো বলে গেছেন। জানি না তারা সে পথে অগ্রসর হয়েছে কি না। তবে উলামায়ে কিরামের দায়িত্ব তাদের সে পথে অগ্রসর করা। তাদের মধ্যে ব্যাপক দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করা এবং মসজিদ মাদরাসা গড়ে তোলা।

এ প্রসঙ্গে নিম্নে আল্লামা নদভীর সেই ভাষণটির সার-সংক্ষেপ তুলে ধরছি, যা তিনি ১৯৬১ সালে আরাকানের মুসলমানদের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের রেঙ্গুনে অবস্থিত সুরতি জামে মসজিদে প্রদান করেছিলেন।

শায়খ নদভী রহ. বলেছিলেন, এই দুনিয়া নশ্বর। এই দুনিয়ার সব কিছু ধ্বংসশীল। সম্পদ-সম্মান সব কিছুই একদিন শেষ হয়ে যাবে। চিরকাল যা বাকি থাকবে তা হলো, শুধু আল্লাহর নাম, আল্লাহর রাস্তায় মেহনত এবং আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রচেষ্টা ও কুরবানি। এখন বড় মোক্ষম সময় যাচ্ছে। আপনারা যদি নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজ-কারবার থেকে সময় বের করে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কর্মে আত্মনিয়োগ করতে পারেন, এর প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ তাআলা আপনাদের দুনিয়ায় এই দেশের ক্ষমতা এবং আখিরাতে জান্নাত দান করবেন।

আর যদি আপনারা এটা না করেন, তাহলে স্মরণ রাখবেন, আপনারা এ দেশে থাকতেই পারবেন না। কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নয়, বরং মুমিনের হৃদয়ে আল্লাহ প্রদত্ত জ্যোতির আলোকেই আমি বলছি, এ দেশে আপনাদের থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে, যদি আপনারা দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা না করেন। তখন এমন দুরবস্থা দেখা দেবে যে, আপনাদের দোকান, কারখানা—কোনো কিছুই সংরক্ষিত থাকবে না। কোনো দেশে মুসলমানদের টিকে থাকার একমাত্র উপায় হলো, সে দেশে দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য মেহনত করা এবং দ্বীনকে শক্তিশালী করা।

এই দেশে আপনাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার কাজ, সবচেয়ে জরুরি ও প্রথম কাজ— যা সময়ের একান্ত দাবি তা হলো, এখানে পুরোদমে দ্বীনের মেহনত চালু করে দেওয়া। এখানে বসবাসের জন্য, ক্ষমতা অর্জনের জন্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ও পরবর্তী প্রজন্ম রক্ষার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো, ১০ থেকে ২০ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা তৈরি করা। এই মেয়াদে সকল কাজ থেকে ফারেগ হয়ে শুধু দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় লেগে থাকা এবং মুসলমানদের ঈমান ও আকিদার হেফাজত করা।

আপনাদের দায়িত্ব অনেক। এখনো এই দেশ স্বাভাবিক রয়েছে। খোদা না করুন! যদি এই দেশ বৌদ্ধরাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যায় এবং আপনারা দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও মুসলমানদের ঈমান-আমল শক্তিশালী করার কাজ না করেন, তাহলে কেউ আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না, কেউ আপনাদের সাহায্য করবে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

চোখ-কান খোলা রেখে খুব চিন্তা-ফিকির করে বুঝে নিন, ইসলাম ছাড়া এই দেশে আপনাদের বসবাস সম্ভব নয়। এ জন্য এখনই দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুন, গ্রাম-গঞ্জে যান, আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিন। তাওহীদের কালিমা ও ইসলামের সভ্যতা-সংস্কৃতি খুলে বলুন যে, আপনারা ইসলামী সংস্কৃতি গ্রহণ করুন, ইসলামী নাম রাখুন এবং শিরক ও মুশরিকি প্রথা থেকে দূরে থাকুন। মুসলমানের জন্য শিরক গ্রহণ করা, কোনো শিরকি কাজে অংশগ্রহণ করা অথবা শিরকি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া—মৃত্যুর সমতুল্য। মানুষের কাছে শিরক ও মূর্তিপূজার অসারতা তুলে ধরুন।

আর যদি আপনারা এই কাজে উদাসীনতা প্রদর্শন করেন, তবে স্মরণ রাখবেন হে আমার ভাইয়েরা! আপনারা এই দেশে টিকে থাকতে পারবেন না। আমি কোনো বুজুর্গ মানুষ নই যে ১০ বছর পরের কথা এখন বলে দিচ্ছি!

এটা একটা প্রকাশ্য কথা; পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন যে কেউ বিষয়টি বুঝে নিতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমি বলছি, বড় দুর্দিন আপনাদের সামনে আসছে। আল্লাহর ওয়াস্তে এখনই আপনারা নিজেদের দ্বীন প্রচারের কাজে পূর্ণরূপে লেগে যান। তাওহীদ ও ইসলামী শিক্ষার নবজাগরণ সৃষ্টি করুন পুরো বার্মার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত। শিশুদের শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করুন। কখনো যেন কোনো মুসলমানের মাথায় ইরতিদাদ বা ধর্মত্যাগের চিন্তাই আসতে না পারে।

আপনাদের দেশের পরিস্থিতি বড়ই নাজুক। এখন আপনাদের আর কোনো কাজ নেই। পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান সব ধরনের মতভেদ ভুলে যান। বিভিন্ন দল-উপদলের মধ্যকার সব মতানৈক্য পায়ের নিচে ফেলে দিন। সময় বের করুন, তাবলিগে সময় লাগান, চিল্লায় যান।

এখনো আপনাদের হাতে এ কাজের সুযোগ রয়েছে। জানি না, কত দিন এই সুযোগ বাকি থাকবে! যদি আপনারা এই সুযোগ কাজে লাগান এবং দ্বীন প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, তাহলে আল্লাহর রহমতে এই দেশে দ্বীন প্রতিষ্ঠা লাভ করবে এবং দ্বীন বাকি থাকার ফয়সালা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এর বরকতে আল্লাহ তাআলা আপনাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ইজ্জত-আবরু, স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষা করবেন। এ দেশে আপনারা মাথা উঁচু করে বসবাস করতে পারবেন। অসম্ভব নয় যে আল্লাহ তাআলা এই দেশ পরিচালনার দায়িত্বও আপনাদের দিয়ে দেবেন। কেননা রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করা মূলত আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মেহনতেরই একটি ফসল।

আমার যদি শক্তি ও সামর্থ্য থাকত, তবে কয়েক দিনের জন্য নয়; দুই, চার, পাঁচ বছরের জন্য আপনাদের দোকানগুলোতে তালা লাগিয়ে দিতাম, কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতাম এবং সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলতাম, এখন আপনাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে দ্বীন প্রচারের উদ্দেশে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়া। খাবার শেষ হয়ে গেলে পাতা খেয়ে নেবেন এবং কাপড় ছিঁড়ে গেলে তালি লাগিয়ে দেবেন। ১০ বছরের জন্য শুধু দ্বীন প্রচারের কাজে লেগে থাকবেন। তবেই এ দেশে ইসলাম ও মুসলমান রক্ষা পাবে। সাহাবায়ে কেরামের ২৩ বছরের মেহনতের বদলে আজ ১৩০০ বছর পরও আমরা সেই ফসল ভোগ করে যাচ্ছি।

আপনাদের দেশের পরিস্থিতি বড়ই নাজুক। এখন আপনাদের আর কোনো কাজ নেই। পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান সব ধরনের মতভেদ ভুলে যান। বিভিন্ন দল-উপদলের মধ্যকার সব মতানৈক্য পায়ের নিচে ফেলে দিন। সময় বের করুন, তাবলিগে সময় লাগান, চিল্লায় যান। সপ্তাহ কিংবা তিন দিন করে সময় লাগান। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন—১০ বছর এমন মেহনত করবেন যে, এ দেশের প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে এবং প্রতিটি ঘরে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে যাবে। এই উম্মাহ দ্বীন প্রচারের স্বার্থে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলো বলেই এই দ্বীন আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে।

স্মরণ রাখবেন, এখানে আপনাদের অস্তিত্ব ও বসবাস শুধু খাওয়া-দাওয়া আর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নয়। এ দেশে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্যই আপনাদের পাঠানো হয়েছে। শুধু নিজ জাতির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং আল্লাহর সৃষ্টি এই মানবজাতিকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য, মূর্খতা ও পশুত্বের জীবন থেকে বের করে আনার জন্য আপনাদের পাঠানো হয়েছে।

কয়েক লক্ষ্য রোহিঙ্গা এখন আমাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে। তাদের উপরোক্ত চেতনার আলোকে গড়ে তোলা যেতে পারে। আশা করি উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে গভীর চিন্তা-ভাবনা করবেন এবং উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবেন।

আজ তো অবস্থা এমন, স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যেই ইরতিদাদ ও ধর্মত্যাগের ফিতনা ছড়িয়ে পড়েছে। আমি শুনতে পেয়েছি, মুসলমান মসজিদ ছেড়ে মণ্ডপে যাচ্ছে! কেউ দুনিয়ার লোভে খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে! সুতরাং আপনাদের ওপর এখন দুটি জিম্মাদারি। একটি হলো, নিজেদের মুসলিম ভাই-বোনদের ঈমান রক্ষা করা, আর দ্বিতীয়টি হলো, নিজেদের দেশীয় এসব অমুসলিম ভাই-বোনকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া।

মনে রাখবেন, শুধু এ কথা বলে দিলে হবে না যে, আমরা এখানে মসজিদ নির্মাণ করছি। মসজিদ বানানো বড় সওয়াবের কাজ ঠিক, কিন্তু এখানে যদি কোনো মুসলমান মুরতাদ হয়ে যায় কিংবা কোনো মুসলমানের আকিদা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আপনারাই এর জন্য দায়ী থাকবেন।

আল্লামা নদভীর উপরোক্ত বক্তব্যের আলোকে আরাকানের মুসলমানদের ব্যাপারে উলামায়ে কিরামকে নতুন করে ভাবতে হবে। পাশাপাশি তাদের জন্য মানবিক দৃষ্টিকোণ আজ যা কিছু করা হচ্ছে তার সবটুকু অব্যাহত রাখতে হবে। কয়েক লক্ষ্য রোহিঙ্গা এখন আমাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে। তাদের উপরোক্ত চেতনার আলোকে গড়ে তোলা যেতে পারে। আশা করি উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে গভীর চিন্তা-ভাবনা করবেন এবং উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবেন।

লেখক: আমীর, রিসালাতুল ইনসানিয়া বাংলাদেশ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ