শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


আরাকানের কসাইদের পরিকল্পিত গণহত্যা ও আমাদের করণীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাফি কামাল
সাংবাদিক

বার্মা সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিতভাবে অভিযান চালাচ্ছে আরাকান প্রদেশে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করেই তাদের এ অভিযান। লক্ষ্য একটাই, আরাকান থেকে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী নির্মূল।

মগের মুল্লুক বার্মা, তাদের গডফাদার চীন, সমর্থনকারী রাশিয়া ও সহায়তাকারী ভারত, ইসরাইলসহ নানা দেশ নিজ নিজ স্বার্থে এখানে মিলেছে একবিন্দুতে। অর্থনৈতিক ও ভূরাজনীতির স্বার্থে তারা জলাঞ্জলী দিয়েছে মানবতা।

রোহিঙ্গা জঙ্গি নির্মূল এবং সেখানে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই তাদের সকলের প্রচারণার বিষয় এখন। চোখবন্ধ করেই তারা বার্মার পক্ষে নিয়েছে কূটনৈতিক অবস্থান। বার্মা সরকার, দেশটির নেত্রী ও সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাদের বাঙালী ও বাঙালী জঙ্গি বলে প্রচারণা চালায়। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী নির্মূলে যে ভয়াবহ গণহত্যা সেখানে চলছে তা ধারনাতীত।

বিবিসি, আল জাজিরাসহ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দু’একটি সরেজমিন প্রতিবেদনে কিছুটা হলেও তার আঁচ পাওয়া যায়। বার্মার সরকার ও সামরিক বাহিনী বলছে, রোহিঙ্গা জঙ্গিরা পালিয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশের এক শ্রেণীর লোকজনও সে সুরেই গান গাইছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কোন জাতিগোষ্ঠীর কতিপয় লোক জঙ্গি হতে পারে। কিন্তু পুরো জাতিগোষ্ঠী কিভাবে জঙ্গি হয়। কোন যুক্তিতে হয়? যদি পুরো জাতিগোষ্ঠীই জঙ্গি হয় তাহলে দেশটি এতদিনে তার সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে পারতো কিনা? যদি কিছু সংখ্যক জঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয় তাহলে নিশ্চিত আবাসভূমি নয় জেনেও কেন লাখ লাখ সাধারণ মানুষ দেশটি ছেড়ে চলে আসছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে।

অনেকেই রোহিঙ্গাদের মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করে জঙ্গি আখ্যায়িত করার মাধ্যমে আনন্দ পান। বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানে প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গা হিন্দুর বসবাস। ইতিমধ্যেই তাদের ওপর সমান নির্যাতন, হত্যাকা-ের ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তাহলে কি দাঁড়াল? বার্মা সরকার ও সেনা বাহিনী মুসলিম জঙ্গি নয় মূলত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী (হিন্দু-মুসলমান) নির্মূল করার চূড়ান্ত অভিযানে নেমেছে। বিশ্বে জাতিগত দাঙ্গা ও নৃশংসতার বহু উদাহরন রয়েছে। কিন্তু আরাকানে বার্মিজদের নৃশংসতা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করেছে নতুন কালো অধ্যায়।

একটি জাতিগোষ্ঠীর পুরুষদের হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, ছেলে শিশুদের হত্যা কিসের ইঙ্গিত দেয়? একবার ভাবুন তোÑ কেবল গুলি করে হত্যা নয়, মৃতদেহ পোড়ানো হচ্ছে আগুনে। ভাবুন তো, মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে কুড়ালের আঘাতে খ--খ- করে। বাচ্চাদের প্রতি নৃশংসতার চিত্রগুলো দেখে মনে হতে পারে এটা কোন গবেষণাগার। কিন্তু এসব এখন আর ভাবার বিষয় নয়, বাস্তবতার অধিক। ইন্টারনেটের বদৌলতে ইতিমধ্যেই আপনি হয়তো আরাকানে নৃশংসতার বহু স্থির ও ভিডিওচিত্র দেখেছেন। তাহলে, বিতর্ক কেন? আসুন, মানবতার স্বার্থে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থে আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে নানামাত্রিক করণীয় নিয়ে ভাবি। আরাকানে নৃশংসতার ঘটনায় বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর অভিযোগের আঙুল অং সান সু চি’র প্রতি।

দেশটির রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে তিনি অবশ্যই এ ঘটনায় অন্যতম দায়ী। কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সংসদ ব্যবস্থা ও সংবিধান সম্পর্কে আমাদের খোঁজ-খবর নিতে হবে। সকলেরই মনে রাখা উচিত হবে, বার্মায় সাংবিধানিকভাবেই সশস্ত্র বাহিনীর উপর সু চি’র কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। উপরন্তু আর্মি সেখানে পুলিশ বাহিনী, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, কারা ব্যবস্থা ইত্যাদিও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। সংসদে রয়েছে তাদের ২৫ শতাংশের কোটা ও ভেটো ক্ষমতা।

ফলে বার্মায় ক্ষমতার প্রধানতম ভরকেন্দ্র কার্যত এখনও সশস্ত্র বাহিনী। বার্মার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে জাতিগত নৃশংসতার প্রধান পরিকল্পনাকারী এবং নির্দেশদাতা হলেন জেনারেল মিঙ অঙ লাইং। যিনি পদ্ধতিগতভাবেÑ রোহিঙ্গা নির্মূল কর্মসূচি পরিচালনা করছেন। কেবল আরাকানে নয়, বার্মার কাচিন ও শান প্রদেশসহ দেশের নানা জায়গায় বিভিন্ন ছোট ছোট জাতিসত্তাগুলোর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত দমনাভিযান পরিচালনা করছেন। তারই নির্দেশনায় আরাকানে সশস্ত্র বাহিনীর চলমান জাতিগত নির্মূল অভিযানটি পরিচালনা করছেন দেশটির একজন কর্নেল ফোনে টিন্ট। আমাদের মনে রাখতে হবে, পুরো বিশ্বের ক্ষোভের তীর ছুটছে সু চি’র পানে।

অন্যদিকে আড়াল পড়ে যাচ্ছে বার্মার সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ। কেবল রোহিঙ্গাই নয়, বার্মার সকল নিপীড়িত জাতিসত্তার স্বার্থে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর উচিত বার্মার সেনাবাহিনী; বিশেষ করে জেনারেল মিঙ অঙ লাইং ও কর্নেল ফোনে টিন্টসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা। বাংলাদেশ যদি বার্মা প্রশ্নে তার প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ফোকাস ঠিক করতে পারে, তাহলে বার্মার ভেতর থেকেও যুক্ত হতে পারে অনেক জাতিসত্তার সমর্থন।

সূত্র: পূর্বপশ্চিম


সম্পর্কিত খবর