বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে নেই ভারত ও চীন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মিয়ানমার থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ভারে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। সহিংসতা থামাতে ও শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হলেও বন্ধুপ্রতিম দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং মিয়ানমার সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে উভয় দেশই রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার দায় চাপাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার দেশত্যাগ এবং শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থানের বিষয়টি বেইজিং ও দিল্লির নেতারা এড়িয়ে যাচ্ছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের বিষয়ে মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটির কাছে মহাসচিবের চিঠি পাঠানোর এমন নজির খুব কম। চিঠিতে জাতিসংঘ মহাসচিব রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা ‘মানবিক বিপর্যয়ে’ রূপ নিতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা ও প্রস্তাব পাসের উদ্যোগ নিতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। তবে মিয়ানমার সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মনে করছেন, নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো পদক্ষেপ নিতে চূড়ান্তভাবে সফল হবে না। রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমারের নীতির প্রতি চীনের অকুণ্ঠ সমর্থনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই তারা এমন আশ্বস্ত বোধ করছেন।

মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং তুন বুধবার নেপিদোয় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্ভাব্য প্রস্তাব ঠেকাতে নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার ওপর নির্ভর করছে মিয়ানমার। থং তুন বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের বিষয়টি রুখে দিতে আমরা বন্ধুপ্রতিম কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা করছি। চীন আমাদের মিত্র। রাশিয়ার সঙ্গেও আমাদের একই রকম মৈত্রীর সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই সেখানে (নিরাপত্তা পরিষদে) ইস্যুটি খুব সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বুধবার নেপিদোয় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে সু চির সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা ইস্যুটির কোনো উল্লেখ নেই। বরং দুই নেতাই তাদের ভাষায় ‘সন্ত্রাসের সমস্যা’ মোকাবেলায় একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতে অবস্থানরত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিলেও এর চেয়ে বহুগুণ শরণার্থীর ভারে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সু চির সঙ্গে বৈঠকে কিছুই বলেননি।

যৌথ বিবৃতিতে সু চির বক্তব্য সমর্থন করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, রাখাইন প্রদেশে চরমপন্থী সহিংসতা, বিশেষত নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা এবং যেভাবে নিরপরাধ মানুষ আক্রান্ত ও নিহত হয়েছে, তাতে আপনাদের উদ্বেগে আমরাও অংশীদার।

জবাবে মিয়ানমারের নেত্রী তার বক্তব্যে বলেন, কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের দেশে যে সন্ত্রাসী হুমকি এসে পৌঁছেছে, সে বিষয়ে দৃঢ় সমর্থনের জন্য আমরা ভারতকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, একসঙ্গে কাজের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব, যাতে আমাদের দেশের অথবা প্রতিবেশী দেশের মাটিতে সন্ত্রাসের শিকড় গজাতে না পারে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, মিয়ানমারের, বিশেষত রাখাইন প্রদেশ ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর উপকূলে আবিষ্কৃত জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ পেতেই চীন সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরবতার কৌশল নিয়েছে।

২০০২ সালে রাখাইন উপকূলে বিপুল পরিমাণ অফশোর গ্যাস মজুদ আবিষ্কৃত হয়। রাখাইন প্রদেশের ভূগর্ভেও তেলের বিরাট মজুদ রয়েছে। চীন এক দশকের বেশি সময় ধরে এ সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ করায়ত্ত করতে চাইছে। নব্বইয়ের দশকে প্রথম দফা দেশত্যাগের পর ২০১১-১২ সালে রোহিঙ্গারা আবার বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশে আসতে থাকে। রাখাইন প্রদেশে তখন গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলছিল। উপকূলের কিয়কফু গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে চীনের কুনমিং প্রদেশে গ্যাস সঞ্চালনে এ পাইপলাইন প্রতিষ্ঠা করা হয়। চীন সরকার কিয়কফু সমুদ্রবন্দরের ৮৫ শতাংশ মালিকানা কেনার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও মে মাসে রয়টার্সের এক খবরে জানানো হয়।

ইরাবতি নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, মিয়ানমারে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে চীন সরকার তাদের দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশটিকে বরাবর আন্তর্জাতিক ফোরামে সুরক্ষা দিয়ে এসেছে। চলতি দফায় রাখাইন প্রদেশে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরুর পর যুক্তরাজ্য সরকার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে বৈঠক আয়োজনের ডাক দেয়। কিন্তু চীন তা স্পষ্টভাবে প্রতিহত করে জানায়, মিয়ানমারের সংকটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জোরালো অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই।

এর আগে ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং সম্ভাব্য জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর জন্য অভিযুক্ত করা হয়। মিয়ানমারের সরকার ও সামরিক বাহিনী ওই অভিযোগ অস্বীকার করে। রাখাইন প্রদেশে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে জাতিসংঘ একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর প্রস্তাব দিলে মিয়ানমার তাতে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানায়। চীন তখন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়। এরপর মার্চে রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি আলোচনায় নিরাপত্তা পরিষদ এক বৈঠকে মিলিত হয়। সেবার পরিষদের পক্ষ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি পাসের উদ্যোগ নিলে চীন ও রাশিয়া তা রুখে দেয়।
চীনের মতো ভারত সরকারও মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া কালাদান নদীকে ঘিরে নরেন্দ্র মোদি একটি বহুমাত্রিক পরিবহন অবকাঠামো প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন।

ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো কে ইয়োম সিএনএনকে বলেন, নরেন্দ্র মোদি সরকার তার ঘোষিত অ্যাক্ট ইস্ট নীতি এগিয়ে নিতে এবং বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে, যেখানে মিয়ানমার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, সেখানে এক ধরনের কমিউনিটি গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে।

তুরস্ক, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা ও মিয়ানমার সরকারের বর্বর নীতিতে তীব্র উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি মঙ্গলবার রাখাইন প্রদেশে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে ভর্ত্সনা করে বিবৃতি দিয়েছেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ উদ্বেগের সঙ্গে মিয়ানমারের পাশের দুই দেশ ভারত ও চীনের সংযোগ দেখা যাচ্ছে না। সু চির সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গতকাল ‘রাখাইন প্রদেশে স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। একইভাবে সোমবার নেপিদোয় মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট উ মিন্ত সোয়ের সঙ্গে বৈঠকেও এশিয়া বিষয়ে চীনের বিশেষ দূত সুন গুওজিয়াং ‘রাখাইন প্রদেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়াসের’ প্রতি সমর্থন জানান।

সূত্র: পূর্বপশ্চিমবিডি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ