জহির উদ্দিন বাবর : চলে যাওয়া সবার নিয়তি হলেও কোনো কোনো চলে যাওয়া সহজে মেনে নেয়া যায় না। মুফতি মুতীউর রহমানের চলে যাওয়াটাও তেমনি। একজন আলেমের মৃত্যুকে ‘জগতের মৃত্যু’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর সেই আলেম যদি হন লেখক তাহলে সেই চলে যাওয়ার ক্ষতিটা আরও বেশি। যে ক্ষতি কখনও পূরণযোগ্য নয়। এজন্য চল্লিশ পেরোনো টগবগে এই যুবক আলেমের চলে যাওয়ার কষ্টটা গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে সবার মনে। যারা জীবনে তাঁকে কোনোদিন দেখেননি, তাঁর সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না তারাও এই মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছেন। একজন শক্তিমান আলেমের কলম এভাবে হঠাৎ থেমে যাবে এটা কেউ কখনও ভাবেনি। কিন্তু নিয়তির কাছে সব ভাবনাই অকার্যকর; সব অসম্ভবই সম্ভব। এখানে অকালে বলে কিছু নেই, সবই পূর্ব নির্ধারিত।
মুফতি মুতীউর রহমান রহ. বছর দেড়েক আগে কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত হন। তাঁর দুটি কিডনিতেই সমস্যা দেখা দেয়। একটি জাতীয় দৈনিকে তাঁকে নিয়ে লেখা হলে আমরা বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরামের পক্ষ থেকে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছিলাম। ছোটখাট সহযোগিতা নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হয়েছিলাম। সেদিন দেখেছি তিনি কতটা ধৈর্যশীল। জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্তে¡ও নেই কোনো হা-হুতাশ। আল্লাহর ফায়সালাকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। বিপদাপদেও কীভাবে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে হয় সেই শিক্ষা সেদিন পেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকে। একজন প্রকৃত ওয়ারেসে নবীর পাশে দাঁড়ানোর তৃপ্তি নিয়ে সেদিন আমরা ফিরেছিলাম।
মুফতি মুতীউর রহমান ছিলেন অগ্রসর চিন্তা অধিকারী
পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও তাঁর চিকিৎসার জন্য ভালো একটি সহযোগিতা করা হয়েছিল বলে জেনেছি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মাকতাবাতুল আযহারের বিশেষ লেখক সম্মাননা লাভ করেন তিনি। মধ্যবাড্ডায় লেখকদের একটি অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে এক লাখ টাকার চেক তুলে দেয়া হয়। সেদিনই তাঁকে সর্বশেষ দেখেছিলাম। তখন তিনি সংক্ষিপ্ত কিছু কথা বলেছিলেন লেখকদের উদ্দেশ্যে। সেখানেও ছিল ইখলাসের কথা, সবরের কথা। তরুণ লেখকদের করণীয় সম্পর্কে সেই অনুষ্ঠানে তিনি সংক্ষিপ্ত যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সেটা যেন আজও কানে বাজছে। সেই অনুষ্ঠানে কয়েক মাস আগে চলে যাওয়া আরেক আলেম লেখক মাওলানা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়াকেও সম্মানিত করা হয়েছিল।
মুফতি মুতীউর রহমানের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ঢাকায় কয়েকটি অনুষ্ঠানে দুই-চারবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে তাঁকে এই অল্প সময়ের দেখায় মনে হয়েছে আপাদমস্তক ভদ্র, মার্জিত ও পরিশীলিত একজন মানুষ। দৈনিক যুগান্তর ও আমার দেশে পাশাপাশি আমাদের লেখা ছাপা হতো। ২০০৯ সালের দিকে বারিধারা মাদরাসায় বেফাক আয়োজিত লেখালেখি বিষয়ক একটি কর্মশালায় প্রথম সাক্ষাৎ। নাম বলতেই সেদিন খুব আপন করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মনে হয়েছিল, দূরে থাকলেও তিনি অনেক কাছের একজন মানুষ। তাঁর ছাত্রদের কাছ থেকে জেনেছি তিনি লেখালেখি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় পড়ে যারা লেখালেখিতে সরব তাদের অনেকেই তাঁর কাছ থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছেন।
জাতীয় দৈনিকগুলোর ধর্ম পাতা যেসব ইলমি ব্যক্তিত্বদের লেখায় সমৃদ্ধ হতো তাদের একজন ছিলেন মুফতি মুতীউর রহমান। সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে বেশি লেখা প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে। প্রায় প্রতি বছর যুগান্তরের প্রথম পাতায় রমজান বিষয়ক সিঙ্গেল কলামটি তিনি লিখতেন। যুগান্তরে তিনি ধর্মীয় প্রশ্নের জবাবও দিতেন। তাঁর লেখায় ইলমি গভীরতা ছিল। পাঠকের মেজাজ বুঝে লিখতে পারতেন। বিষয়বৈচিত্র্য ছিল চমৎকার। এছাড়া মাসিক আলকাউসারসহ মাসিক পত্রিকাগুলোতেও তাঁর লেখা ছাপা হতো। তিনি পুরোদস্তুর একজন মুদাররিস ছিলেন, এর বাইরে সময় বের করে লেখালেখি করতেন। জুমার খুতবাসহ বিভিন্ন ব্যস্ততা ছিল তাঁর। কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেমে যায় তাঁর খেদমতের সরব এই ধারা। বছর দেড়েক ধরে তাঁর কিডনি নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হতো। তবে এই অসুস্থতা সত্তে¡ও তিনি চৌধুরীপাড়া মাদরাসাতেই থাকতেন এবং হাদিস-ফতোয়া পড়ানোর খেদমত চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
মুফতি মুতীউর রহমানের মতো তরতাজা একজন আলেম লেখকের চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা ও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোভাবেই পূরণযোগ্য নয়। তবুও ¯্রষ্টার অমোঘ নিয়মের কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আমরা দোয়া করি আল্লাহ তাঁর বহুমুখি খেদমতগুলো কবুল করুন। তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। তাঁর দেখানো পথে শিষ্য-শাগরেদ, ভক্ত-অনুরাগীসহ সবাইকে চলার তাওফিক দিন। আমিন।