শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই: তারেক রহমান জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেন শায়খ মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন আগামীকাল মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে চরমোনাই পীরের শোক প্রকাশ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী রহ.-এর বর্ণাঢ্য জীবন কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে: নাছির বড় ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা আইফোনে ‘টাইপ টু সিরি’ ফিচার যেভাবে ব্যবহার করবেন  স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা আল্লাহকে পেতে হলে রাসূলের অনুসরণ অপরিহার্য: কবি রুহুল আমিন খান

কাতারে দীপ্তিমান নক্ষত্র; বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল আওয়াল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইমরান আনোয়ার
কাতার থেকে

আমাদের ব্যর্থতা হল আমরা গুণীজনদের সম্মান প্রদর্শনে সবসময় কার্পণ্য করি। যারা প্রকৃত মর্যাদা ও প্রশংসার দাবিদার, তাদের প্রতি আমাদের কুণ্ঠিত মনোভাব সত্যিই এক বিচিত্র চরিত্রের পরিচয় দেয়!

ধর্মীয় অঙ্গনে প্রতিভার অভাব নেই; তবে আন্তরিক মূল্যায়ন অথবা উপযুক্ত সমাদরের অভাবে প্রকৃত সফল মানুষগুলো বরাবরই আলোচনার বাইরে থেকে যায়। তাদের প্রতি আমাদের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি যেন অনাকাঙ্ক্ষিত সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।

অথচ আচমকা একদিন তাদের সাফল্য-দীপ্তিতে চারপাশের মানুষগুলো 'ধন্য-ধন্য' রবে ছুটে আসে। প্রশংসা ও বন্দনা বাণীতে সে মানুষগুলো অস্থায়ী সুখের বৈভবে বিভোর হয়। এমনটি কখনো কাম্য নয়!  গুণী মানুষদের সূচনা থেকেই এপ্রিশিয়েট করা প্রয়োজন। তাদের কৃতিত্বকে আনন্দের সাথে সেলিব্রেট করা উচিৎ। তবেই না তাদের কাজের গতি বৃদ্ধি পাবে! ভাল কাজের অনেক বেশি অনুপ্রেরণা পাবেন তারা।

এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিদেশের মাটিতে গর্বিত গুণী মানুষদের পরিচয় তুলে ধরার জন্য আমরা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। সফল মানুষের পথচলা ও স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প আমাদের ভবিষ্যতকে অনুপ্রাণিত করবে- এই প্রত্যাশাই এই প্রচেষ্টার মূল উপাদান।

পরিচিতি ও সাফল্যগাঁথা

‘ফাইলাসুফ আল-হিন্দ’ এবং ‘ফকীহুল হিন্দ’, এ দুটো উপাধি নিশ্চয়ই একজন শিক্ষার্থীর পরম মেধা ও বুদ্ধিমত্তাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে! কতটা বিচার-বিশ্লেষণ এবং নিরঙ্কুশ প্রতিভা প্রদর্শন করলে মিশরের কায়রো ইউনিভার্সিটিতে একজন বাংলাদেশি এমন উপাধি লাভ করতে পারেন- তা বোধকরি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। এরপরও কারো মনের অতৃপ্তি মেটানোর জন্য একটি তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদীর্ঘ ইতিহাসে স্নাতকে হাতেগোনা কয়েকজন 'মুমতাজ' (এ গ্রেড) অধিকারীর অন্যতম হলেন আমাদের এ ব্যক্তি।

কুমিল্লা-দেবীদ্বার, রসুলপুর-এর বাসিন্দা মাওলানা আব্দুল আওয়াল শৈশবের শুরুতেই কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। তারপর ২০০৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া দারুল আরকাম আল-ইসলামিয়া' থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে সরকারি তত্ত্বাবধানে পূর্ণ স্কলারশিপসহ ২০০৪-এ মিশর পাড়ি জমান।

পুরো মাদরাসা শিক্ষাকালে অসামান্য সাফল্যধারা বজায় রেখেছেন তিনি। তার সময়ে তিনি 'তর্কযোগ্যভাবে' দারুল আরকামের সেরা ছাত্র ছিলেন। জামিয়া আজহারে প্রারম্ভিক 'দিরাসা খাসসাহ' (বিশেষ স্টাডি) সমাপ্ত করে পরবর্তীতে আংশিকভাবে মা'হাদুল ইকরা-তে পাঠ লাভ করেন। এ কোর্সগুলোর প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণির (মুমতাজ) ফলাফল অর্জনের কৃতিত্ব দেখান।

'দিরাসা খাসসাহ' পর্যায়ে তাকে উপাধি দেওয়া হয় 'মুআররিখুল কাআহ' (ইতিহাসবেত্তা)। একই বছর (২০০৪) জামিয়া আজহার-এর 'কুল্লিয়াতুশ শরীয়া'তে সুযোগ পেয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রীতে ভর্তি হন। ২০০৭-এ তার 'সম্মান ডিগ্রী' সম্পন্ন হয়। স্নাতক ফাইনালের ফলাফল ছিল চমকে যাওয়ার মত! কারণ মিশরের মাটিতে বাংলাদেশের গৌরব হয়ে উঠা মাওলানা আব্দুল আওয়াল এ পরীক্ষাতেও প্রথম শ্রেণীর (মুমতাজ) ফলাফল অর্জন করেন! চূড়ান্ত পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত সেরাদের তালিকায় তার নাম ঠাই পেয়েছে সগর্বে। সব ইমতেহানের মত এবারও তার নামের পাশে এই মর্যাদা স্থায়ীভাবে আসন গেঁড়েছে।

স্নাতক পরবর্তী মাস্টার্স-এর জন্য কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তার প্রথম পছন্দ। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের ঘোষণা ছিল, শুধুমাত্র পাঁচজন বাংলাদেশিকে স্কলারশিপসহ মাস্টার্সে অধ্যয়ন করার সুযোগ দেওয়া হবে। অতএব আত্মবিশ্বাস, প্রতিজ্ঞা এবং আল্লাহর অনুগ্রহে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেন মাওলানা আব্দুল আওয়াল। সেখানে অগণিত প্রার্থীকে টপকে সর্বশেষ সেরা পাঁচ শিক্ষার্থীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন তিনি।

এর পর পা রাখেন স্বনামধন্য কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজেকে সামান্য সময়ের জন্যও তিনি আপন স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত হতে দেন নি। স্বপ্নের শেষ ধাপটুকু পাড়ি দিতে মনপ্রাণ উজাড় করে দেন কায়রোয়। মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষার প্রথম রাউন্ডে বাংলাদেশিদের মধ্যে একমাত্র তিনিই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হন।

নতুন স্বপ্ন ধরে এগিয়ে চলা

সময়টা ছিল ২০০৮। দেশ ভ্রমণের উদ্দেশে নিজভূমে আগমন করেন এ প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। মাস ছয়েক অবস্থানকালে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে জামিয়া দারুল আরকামে পাঠদান করেন। তারপর নতুন রোমাঞ্চ ও চ্যালেঞ্জের আশায় যাত্রা করেন ধনিক দেশ কাতারে। নিজ যোগ্যতায় স্বল্প সময়েই সেখানে ইমাম (বা) পদে নির্বাচিত হন।

কর্মজীবনের পাশাপাশি ২০১০ সালে বিশ্ববিখ্যাত কাতার ফাউন্ডেশনে মাস্টার্সের জন্য নতুন করে ভর্তি হন। নিজ সামর্থ্যের প্রয়োগ ঘটিয়ে 'সোনার হরিণ' পূর্ণ স্কলারশিপ লাভ করেন এ বরেণ্য প্রতিষ্ঠানে।

একটি ব্যাপার উল্লেখ্য, এ প্রতিষ্ঠানে বিশ্বের তুখোড় মেধাবী ছাত্রদেরই কেবল অধ্যয়নের সুযোগ হয়। মান ও খ্যাতি বিবেচনায় আরববিশ্বে বর্তমানে এর সমতুল্য খুঁজে পাওয়া ভার। এখানে সব বিদেশি ছাত্রের জন্য নিয়মানুযায়ী আরবি ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স বাধ্যতামূলক।

আমাদের আব্দুল আওয়াল'কেও এ কোর্সের প্রত্যাদেশ দেওয়া হলে তিনি তাৎক্ষনিক পরীক্ষার জন্য বিনীত অনুরোধ জানান। তার ডাকে সাড়া দেন পরীক্ষক বোর্ড। সংক্ষিপ্ত সময়ে পরীক্ষার আয়োজন করা হয় এবং সেখানে সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে আরবি ভাষায় নিজের অসাধারণ বুৎপত্তি প্রদর্শন করেন তিনি।

সে থেকেই ডিপার্টমেন্ট-অথরিটির সুনজরে পড়েন এ কৃতি ছাত্র। তার ভাষায়, ‘আমাদের ডিপার্টমেন্টের অন্যতম শিক্ষক ডক্টর মুহাম্মাদ আল-জাম্মাল আমার প্রেজেন্টেশনে খুশি হয়ে আমার আরবি পাসপোর্ট ইস্যু করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।’

কৃতিত্ব ও গৌরব

কাতার ফাউন্ডেশনে অধ্যয়নরত অবস্থায় مركز القرضاوى للوسطية তে পার্ট টাইম গবেষক হিসেবে কাজ করেন মাওলানা আব্দুল আওয়াল। মাস্টার্সে তার থিসিস-এর বিষয় ছিল- ‘তাদমিনুল ব্যাঙ্ক আল-ইসলামি লিল ওয়াদাইঈল ইসতিছমারিয়্যাহ ও বাদাইলুহ, দিরাসাহ ফিকহিয়্যাহ মুকারানা’ (তুলনামূলক ফিকহি অধ্যয়: বিনিয়োগ আমানতে ইসলামি ব্যাংক-এর জামানত)।

এ থিসিসের প্রধান আলোচক ছিলেন ডক্টর আলি মুহিউদ্দিন আল কারদাগি, যিনি 'ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলারস'-এর সম্মানিত মহাসচিব, তিনি অনবরত শিস্য আব্দুল আওয়ালকে এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে যান। বলেন, ‘তোমার এ রিসালায় অনেক মণিমুক্তা রয়েছে। এটি প্রচারিত হওয়া দরকার।’ তার এ রিসালাহ বর্তমানে বই আকারে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।

রিসালাটি শেষ হওয়ার পর কাতারের ধর্মমন্ত্রণালয় ওয়াজারাতুল আওকাফে জমা দেওয়া হয়; এবং সর্বসম্মতিক্রমে সেটি প্রকাশের জন্য অনুমোদন পেয়ে যায়। সম্প্রতি এই বই রচনার জন্য জনাব আব্দুল আওয়ালকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়। জানানো হয়, অল্প কয়েকদিনের ভেতর এ বই সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্রগুলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।

বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এ গুণী লেখককে। কাতারের ভূমিতে বাংলাদেশের নাম আলোকিত করার অন্যতম কারিগরকে নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই! তার দেখানো সফলতার সিঁড়ি বেয়ে আগামী প্রজন্ম দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে, এই আমাদের নিখাদ প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন
আজহারে বাংলাদেশের ফুল: কীর্তিমান শরিফ আব্দুল বাসেত
‘কাতারের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে বাংলাদেশের খতীব’


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ