শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


বন্যার্ত বা অভাবগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে যেভাবে উৎসাহ দিয়েছে ইসলাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জাকারিয়া হারুন
আলেম ও সাংবাদিক

স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা বয়ে যাচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চলিও জেলাগুলোতে। চোখের সামনে নিজের সাজানো বাড়ি-ঘর এখন পানিতে একাকার। মানবেতর জীবন-যাপন করছে তারা। ১৬ আগস্টের এক হিসাবে ২১ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ লাখ ৮৭ হাজার মানুষ। ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর।

চলতি এ বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ ৫২ হাজার পরিবার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ৩৭ জন। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৯টি। এগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ১১ হাজার।’

ইসলামে আর্ত মানবতার সেবা করার গুরুত্ব অপরিসীম। জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে আর্ত মানবতার সেবকদের। আর আর্ত মানবতার সেবা না করাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বলা হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কীসে দোজখে নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা মুসল্লিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না, আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার দান করতাম না।’ (আল মুদ্দাসসির: ৪২-৪৪)

পবিত্র এ আয়াতে গরিব-অসহায়দের সাহায্য, আহার না দেওয়া, জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে? সে তো সেই, যে এতিমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং সে অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না।’ (সুরা মাউন : ০১-০৩)

পবিত্র এ আয়াতে এতিম, মিসকিনদের সাহায্য-সহযোগিতা না করা, এসব বিপন্ন মানুষের সাহায্যে এগিয়ে না যাওয়া এবং এদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা তাদের বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা প্রকৃত অর্থে দ্বীন-ধর্ম ও পরকালে অবিশ্বাসী। সুতরাং যারা মুমিন হবে, তাদের অবশ্যই বিপদগ্রস্ত ও আর্ত মানবতার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।

বিপদগ্রস্ত মানবতার অন্যতম ও ন্যূনতম সহযোগিতা হচ্ছে, তাদের সাময়িক ঋণ দিয়ে হলেও সাহায্য করা। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং তোমরা আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ।’ (সুরা মুজাম্মিল : ২০)

অন্যত্র বলেন, ‘কে সে, যে আল্লাহকে করজে-হাসানা প্রদান করবে? তিনি তার জন্য সেটা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন।’ (সুরা বাকার: ২৪৫)

যারা আল্লাহর রাস্তায় দান করে তাদের উপমা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৬১

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে বেশি মানব প্রেমিক। তিনি মানবতার কথা ভেবে রাতে ঘুমাতে পারতেন না। সহীহ বুখারী শরিফের বর্ণনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ইসলামের মাঝে কোন জিনিস সর্বোত্তম? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অপরকে আহার করানো।’

হজরত আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য একটি ভবনসদৃশ, যার এক অংশ আরেক অংশকে মজবুত করে।’ অর্থাৎ সবল মুমিনদের সাহায্য-সহযোগিতায় অসহায় ও দ্বীনহীনরা শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তাদের দৈন্য কেটে যাবে। এটিই শাশ্বত ও সত্য ধর্ম ইসলামের শিক্ষা ও প্রত্যাশা। (মুসলিম শরিফ : খ-৭, পৃ. ১১৩; হাদিস : ৬৩৪৯; ইফা)

আবূ হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।’ [মুসলিম : ৭০২৮; আবূ দাঊদ : ৪৯৪৮; তিরমিযী : ১৪২৫]

সহিহ হাদিসের বাছাইকৃত ‘রিয়াদুস সালেহিন’ নামক গ্রন্থে বোখারি/মুসলিম ইত্যাদির বরাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে, যার ভাষ্যে বলা হয়েছে, যেসব গরিব-দুঃখী, বিপন্ন ও অসহায় মানুষের প্রতি আমরা অবহেলা প্রদর্শন করে থাকি, মূলত অনেক ক্ষেত্রে তাদের মাধ্যমেই আমাদেরও রিজিক পৌঁছে থাকে। অথচ আমরা তাদের মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত নই। যেমন- ‘নিশ্চিত তোমাদের রিজিক দেয়া হয় এবং তোমাদের সাহায্য করা হয় তোমাদের মধ্যকার দুর্বল-অসহায়দের কারণেই।’

হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘অসহায় বিধবা (স্বামী পরিত্যক্তা বা স্বামী মৃতা) ও মিসকিনের সাহায্যার্থে (যে কোনো প্রকার সাহায্য) কর্মতৎপর ব্যক্তি আল্লাহর রাহে জিহাদরত ব্যক্তির সমতুল্য।’ বর্ণনাকারী সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রা. বলছেন, আমার মনে পড়ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনটিও বলেছিলেন যে, ‘তেমন সাহায্যকারী ব্যক্তি একনাগাড়ে রোজা পালনকারী ও সারা রাত ইবাদতকারী ব্যক্তির অনুরূপ সওয়াব প্রাপ্ত হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম/মিশকাত : পৃ. ৪২২, রেজা একাডেমি, মুম্বাই)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যারা দয়া করে থাকে (সৃষ্টির প্রতি) পরম দয়ালু আল্লাহও তাদের প্রতি দয়া করে থাকেন।’ (সুতরাং) তোমরা জগৎবাসীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো, তাহলে আকাশের মালিক মহান আল্লাহও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ ও সুনানে তিরমিজি)

বন্যার্ত মানুষদের সেবা ইসলামের অতি আগ্রহ এবং অনন্ত প্রেরণার স্বাক্ষর হিসেবে আর কিছু নয় ; কেবল নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসীই যথেষ্ট হতে পারে। হযরত আবূ হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

‘কেয়ামত দিবসে নিশ্চয় আল্লাহ তাআ’লা বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার শুশ্রূষা করো নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক। আপনিতো বিশ্বপালনকর্তা কিভাবে আমি আপনার শুশ্রূষা করব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তাকে তুমি দেখতে যাও নি। তুমি কি জান না, যদি তুমি তার শুশ্রূষা করতে তবে তুমি তার কাছেই আমাকে পেতে।?’ ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাও নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব, তুমি হলে বিশ্ব পালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জান না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি খাদ্য দাও নি। তুমি কি জান না যে, তুমি যদি তাকে আহার করাতে তবে আজ তা প্রাপ্ত হতে?’ ‘হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাও নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রভু, তুমি তো রাব্বুল আলামীন তোমাকে আমি কীভাবে পান করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল কিন্তু তাকে তুমি পান করাও নি। তাকে যদি পান করাতে তবে নিশ্চয় আজ তা প্রাপ্ত হতে।’ (সহীহ মুসলিম : ৬৭২১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৭৩৬)

আসুন আমরা আর্তমানবতার সেবায় কিছু খরচ করি। এই কঠিন মুহূর্তে যারা আমাদের দিকে তাকিয়ে তাদের দিকে বাড়িয়ে দেই দুটি হাত।

তসলিমার অশ্লীল লেখা প্রকাশে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আইনি নোটিস


সম্পর্কিত খবর