শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

সিকিউরিটি মানি ও অ্যাডভান্স এর বিধিবিধান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

• মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব

জামানত হিসেবে ভাড়াগ্রগিতা থেকে যে টাকা গ্রহণ করে থাকে, ভাড়ার চুক্তি শেষে তা আবার ভাড়াগ্রহিতাকে ফেরত দিয়ে দিতে হয়, সেটি সিকিউরিটি মানি এবং এককালীন গ্রহণ করা টাকা প্রতি মাসেই কিছু কিছু করে ভাড়া হিসাবে কাটা হয়, সেটি অ্যাডভান্স সিকিউরিটি মানি।

ভাড়াদাতার কাছে থাকলেও এর মালিকানা থাকে ভাড়াটিয়ার। ভাড়াটিয়া পরবর্তীতে ওই টাকা ফেরত পায়। সুতরাং সিকিউরিটি মানির জাকাত ভাড়াটিয়া প্রদান করবে। অন্যদিকে অ্যাডভান্স হিসেবে প্রদানকৃত টাকার মালিকানা ভাড়াটিয়া থেকে ভাড়াদাতার কাছে চলে যায়

সিকিউরিটি মানি ও অ্যাডভান্স বর্তমান সময়ের ব্যাপক পরিচিত দুইটি লেনদেন। বিশেষ করে বাড়ি ও দোকান ভাড়ার ক্ষেত্রে এসব লেনদেন মানুষ বেশি করে থাকে। ভাড়াটিয়া ভাড়া শেষে চলে গেলে কোনো ক্ষতি করে গেলে সে টাকা থেকে তা পুষিয়ে নেয়ার প্রয়োজনেই মূলত এ ধরনের অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তবে এ ধরনের লেনদেনে শরয়ি বিশ্লেষণ জানা না থাকায় বেশকিছু ভুল হয়ে থাকে।

সিকিউরিটি মানি ও অ্যাডভান্সের পার্থক্য
ভাড়াদাতা ভাড়াগ্রহিতা থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার দুটি পদ্ধতি রয়েছে- ১. ভাড়াদাতা জামানত হিসেবে ভাড়াগ্রহিতা থেকে যে টাকাটা গ্রহণ করে থাকে, ভাড়ার চুক্তি শেষে তা আবার ভাড়াগ্রহিতাকে ফেরত দিয়ে দিতে হয়, যাকে সিকিউরিটি মানি বলে। ২. এককালীন গ্রহণ করা টাকা প্রতি মাসেই কিছু কিছু করে ভাড়া হিসাবে কাটা হয়, যাকে অ্যাডভান্স বলে।

সিকিউরিটি ও অ্যাডভান্সের ভাড়া
সিকিউরিটি মানির কারণে ভাড়া কম রাখা জায়েজ নয়। অর্থাৎ সিকিউরিটি মানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ভাড়া কমে যাওয়ার যে প্রচলন আমাদের সমাজে রয়েছে, তা জায়েজ নয়। কেননা সিকিউরিটি মানি ভাড়াদাতার কাছে ঋণ হিসেবে থাকে। তাই এ টাকার কারণে ভাড়ার পরিমাণ কমিয়ে দিলে তা ঋণ দিয়ে ঋণগ্রহিতা থেকে অতিরিক্ত সুবিধা গ্রহণের অন্তর্ভুক্ত, যা সুদ ও হারাম। (আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকি : ৫/৫৭৩; আলমাবসুত, সারাখসি : ১৪/৩৫; মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যাহ, মাদ্দাহ : ৪৬৮; আলমাআয়িরুশ শরইয়্যাহ : ১৪৮)।

তবে সিকিউরিটি মানি না হয়ে যদি অ্যাডভান্স তথা অগ্রীম ভাড়া প্রদান করার কারণে ভাড়া কিছুটা কমানো হয়, তবে তাতে সমস্যা নেই। কেননা অ্যাডভান্সের টাকাটা ভাড়াদাতার কাছে ঋণ হিসেবে থাকে না। ফলে ভাড়া কমানো হলেও তা ঋণের পরিবর্তে কমানো হয়েছে বলে গণ্য হয় না।

যেমন একটি ফ্ল্যাটের জন্য ৫০ হাজার টাকা সিকিউরিটি মানি প্রদান করলে ভাড়া হবে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা; কিন্তু সিকিউরিটি হিসেবে ২ লাখ টাকা অগ্রিম দিলে ভাড়া হয়ে যাবে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। সিকিউরিটি মানি তথা ফেরতযোগ্য ঋণ বৃদ্ধির কারণে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার ভাড়া ৩ থেকে ৪ হাজারে নেমে এসেছে।

এটি সুদের অন্তর্ভুক্ত। ফাযালা বিন উবাইদ (রা.) বলেন, ‘যে ঋণ কোনো মুনাফা নিয়ে আসে, তা রিবার অন্তর্ভুক্ত। (সুনানে বাইহাকি : ৫/৩৫০)।

ইমাম মালেক (রহ.) বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বস্তু ঋণ দেবে, সে যেন অতিরিক্তি কিছু গ্রহণের শর্ত না করে। যদিও তা একমুঠো ঘাস হোক না কেন।’ (মুআত্তা মালেক, হাদিস : ২৫১৩)। তবে অ্যাডভান্সের ব্যাপারটি ভিন্ন। অ্যাডভান্সের বিপরীতে ভাড়া কমানোর সুযোগ রয়েছে। কেননা তা ঋণ হিসেবে থাকে না; বরং অগ্রিম প্রদেয় ভাড়া। মোটকথা, সিকিউরিটি মানি বৃদ্ধির কারণে ভাড়ার স্বাভাবিক হার তথা উজরতে মিছিল থেকে কমানো জায়েজ নয়। কিন্তু অ্যাডভান্সে জায়েজ আছে।

সিকিউরিটি মানির জাকাত
সিকিউরিটি মানি ভাড়াদাতার কাছে থাকলেও এর মালিকানা থাকে ভাড়াটিয়ার। তাই ভাড়াটিয়া পরবর্তীতে ওই টাকা ফেরত পায়। সুতরাং সিকিউরিটি মানির জাকাত ভাড়াটিয়া প্রদান করবে। অন্যদিকে অ্যাডভান্স হিসেবে প্রদানকৃত টাকার মালিকানা ভাড়াটিয়া থেকে ভাড়াদাতার কাছে চলে যায়। তাই তো এ টাকা পরবর্তীতে ফেরত দিতে হয় না। সুতরাং অ্যাডভান্স হিসেবে নেয়া টাকার জাকাত ভাড়াদাতার ওপর আবশ্যক হবে। (জাদিদ ফিক্বহি মাসায়েল : ১/১৪৭-১৪৮; মালে হারাম আওর উসকে মাসারেফ ওয়া আহকাম : ৮৫)।

আর যদি টাকাটা শুধু জামানত হিসেবে বা ঋণ হিসেবে দোকান ও বাড়ির মালিকের কাছে গচ্ছিত রাখা হয়, এক্ষেত্রে মূল মালিক যেহেতু যিনি দোকান বা বাসা ভাড়া নিয়েছেন তিনিই থাকেন, তাই উপরি-উক্ত টাকার জাকাত দোকান বা বাসা ভাড়াকারী ব্যক্তি তথা টাকা জমাদাতা ব্যক্তির ওপরই আসবে।

বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার জন্য সিকিউরিটি বাবদ কিছু টাকা প্রদান করতে হয়। এ টাকাটা প্রদানকারীর মালিকানায় থাকে। প্রতিষ্ঠান শুধু টাকাটা সংরক্ষণ করে থাকে সিকিউরিটি বাবদ। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে প্রতিষ্ঠান ওই টাকা ফেরত দেয়। ওই টাকার জাকাত প্রদানকারী আদায় করবে, গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান আদায় করবে না। অনুরূপভাবে ব্যাংকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিকিউরিটি হিসাবে গ্যারান্টি মানি প্রদান করতে হয়। ওই টাকা অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের মালিকানাধীন থাকে। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে তিনি ওই টাকা উত্তোলন করতে পারেন। ওই টাকাও জাকাতযোগ্য। এ টাকার জাকাতও প্রদানকারী আদায় করবে।

সিকিউরিটি মানির শরয়ি বিধান
সিকিউরিটি মানি তথা জামানত হিসেবে যে অর্থ ভাড়াদাতাকে প্রদান করা হয়, পরবর্তীতে তা আবার প্রদানকারীকে ফেরত দেওয়া হয়, তা ভাড়াদাতার কাছে বন্ধক হিসেবে থাকে। আর বন্ধকী বস্তু যেহেতু ব্যবহার করা নাজায়েজ ও সুদের অন্তর্ভুক্ত, তাই এ টাকাও ব্যবহার করা সুদের অন্তর্ভুক্ত। মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, আমার কাছে এক ব্যক্তি একটি ঘেড়া বন্ধক রেখেছে। আমি এতে আরোহণ করেছি। এর কী হুকুম? তখন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, তুমি এর পিঠ থেকে (আরোহণ করে) যে উপকৃত হয়েছ, তা সুদের অন্তর্ভুক্ত। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক : ১৫০৭১)।

তবে এক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে। সিকিউরিটির টাকা ভাড়াগ্রহিতা থেকে ঋণ হিসেবে নিলে তা ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু তখন এ সিকিউরিটি মানির কারণে ভাড়া কমানো যাবে না। কেননা ঋণ নিয়ে কোনো সুবিধা দিলে তা সুদ হিসেবে গণ্য হয়। সিকিউরিটির টাকা ঋণ হিসেবে নেয়ার জন্য আরও একটি শর্ত রয়েছে। ঋণের চুক্তিটি ভাড়া গ্রহণের সময় করতে পারবে না, বরং পরে করতে হবে। ভাড়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারবে না। কেননা একটি চুক্তির সঙ্গে আরেকটি চুক্তি শর্তযুক্ত করে কারবার করা নাজায়েজ। এটিকে ‘সাফকাতাইনে ফি সাফকাহ’ কিংবা ‘বাইআতাইনে ফি বাইআহ’ বলা হয়। হাদিস শরিফে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা হলো, ভাড়াদাতা ভাড়াগ্রহীতা থেকে এককালীন যে টাকাটা নেবে, তা অ্যাডভান্স তথা অগ্রিম ভাড়া হিসেবে নেবে, যা চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া হিসেবে কর্তিত হবে। এতে দোকান বা বাড়ির মালিক একত্রে বেশি টাকাও নিতে পারে এবং তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধও হবে।

(মুসনাদে আহমদ : ৬৬২৮; শরহুল মাজাল্লাহ, খালিদ আতাসী : ৩/১৪৫, ১৯৬; মাবসুত, সারাখসি : ১৪/৩৫, ২১/১০৮; কিতাবুল আসল : ৩/১৬৩; মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যাহ মাদ্দাহ : ৪৬৮)।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক আলহেরা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ