শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


আল আকসা ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ব্যাপার: ড. আবু ইয়া’লা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ড. আবু ইয়া’লা আহমদ সুবকি আব্দুল মুনয়িম আল আজহারি। ১৯৮৩ সালে মিসরের মুনুফিয়্যা প্রদেশে জন্ম গ্রহণ করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তারপর তানতা প্রদেশের কুল্লিয়্যাতিুশ শরিয়া ওয়াল কানুন-এ ভর্তি হন ২০০৫ সালে। বিভাগে স্টার মার্কস-সহ প্রথম স্থান অধিকার করেন।

আল আজহারের ২০০৭ সালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অনুষদের তুলনামূলক ফিকহ বিভাগে ভর্তি হন এবং ২০১২ সালে এ বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১৫ সালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ‘তুলনামূলক ফিকহ’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

বর্তমানে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অনুষদের তুলনামূলক ফিকহ বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।

সম্প্রতি আল আজহারের এ তরুণ অধ্যাপক বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। গত ২৫ জুলাই জামিয়া সাঈদিয়া কারীমিয়া, ঢাকায় তার সঙ্গে কথা বলেন, আওয়ার ইসলামের বার্তা সম্পাদক আতাউর রহমান খসরু। খোলামেলা আলাপচারিতায় তিনি কথা বলেন তার বাংলাদেশ সফর, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট ও সমাধান বিষয়ে। আলোচনার চুম্বকাংশ পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।

আওয়ার ইসলাম : আপনার বাংলাদেশে আসার উপলক্ষ্য কী?

ড. আবু ইয়া’লা : আমি আল আজহারের বাংলাদেশি ছাত্রদের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছি। যারা পূর্বে আল আজহারে পড়ে এসেছেন। আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভিন্ন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় (বড় কওমি মাদরাসা) ঘুরে দেখছি।

ইতিমধ্যে জামিয়া রশীদিয়া আহসানাবাদ চরমোনাই, দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী ও জামিয়া সাঈদিয়া কারীমিয়া দেখেছি। এছাড়াও ঢাকার আশ-পাশে কয়েকটি জামিয়ায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।

আমি চেষ্টা করছি তাদের থেকে উপকৃত হতে এবং তারা ইচ্ছে করলেও আমার থেকে উপকৃত হতে পারে।

আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশের ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কী?

ড. আবু ইয়া’লা : আমি বাংলাদেশকে আমার দ্বিতীয় আবাস বলি। মক্কা-মদিনা এবং মিসরের পর আমি বাংলাদেশকে পছন্দ করি। ভালোবাসি। বাংলাদেশ একটি সুন্দর দেশ। বাংলাদেশিরা ভালো মানুষ। এখানে হিংসভাগ মানুষ ইসলামের অনুসারী। তারা আল্লাহ ও তার রাসুলের অনুগত এবং তাদের ভালোবাসে। তাদের মধ্যে গভীর ধর্মীয় অনুরাগ রয়েছে।

বিশেষত জামিয়াগুলোর ধর্মীয় পরিবেশ চমৎকার। সেখানে একই সঙ্গে ধর্মীয় জ্ঞান, শিষ্টাচার ও আত্মশুদ্ধির কাজ হয়। বিশ্ববাসীর জন্য উত্তম দৃষ্টান্ত বলা যায়।

বাংলাদেশ একটি সবুজ সুন্দর দেশ। বাংলাদেশের পরিবেশ চমৎকার, বাংলাদেশের মানুষ সৎ ও তারা মেহমানের প্রতি সম্মান দেখায়। সাধারণ মানুষ আলেমদের শ্রদ্ধা করে।

এজন্য আমি তাদের পছন্দ করি এবং বার বার বাংলাদেশে আসতে চাই এবং বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই।

আওয়ার ইসলাম : আরব মুসলিমদের ধর্মচর্চা এবং বাংলাদেশিদের ধর্মচর্চায় আপনি কোনো পার্থক্য পেয়েছেন কি?

ড. আবু ইয়া’লা : ইসলাম একটি ধর্ম। তার কৃষ্টিকালচার অভিন্ন। তার জীবনব্যবস্থাও অভিন্ন। আল হামদুলিল্লাহ! বাংলাদেশের মুসলিমগণ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারী। আরব বিশ্বও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারী। সবাই আল্লাহ ও তার রাসুল সা. এর অনুসারী। সুতরাং মৌলিক ধর্মীয় জীবনে তাদের তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরং আমি বলবো, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, তাকওয়ার অধিকারী, কোমল হৃদয় তাদের, তারা আধ্যাত্মিক সাধনা ও আত্মশুদ্ধিতে অগ্রগামী। উত্তম আচরণ ও ধার্মিকতার বিচারে বাংলাদেশি মানুষ মিসরীয়দের চেয়ে এগিয়ে। এটাই বাস্তবতা। স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।

হ্যা, প্রাত্যহিক জীবনে প্রত্যেক দেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটা প্রাকৃতিক ও স্বভাবজাত। তবে ইসলামের বিচারে আরব ও আজমের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। আমরা সবাই ইসলামের অনুসারী।

আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশে যারা ইসলামের জন্য কাজ করছে এমন গোষ্ঠিগুলোকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

ড. আবু ইয়া’লা : যারা ইসলামের জন্য কাজ করে আল্লাহ তায়ালা তাদের উচ্চ মর্যাদার ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষত উলামায়ে কেরামের বিশেষ মর্যাদা রাসুল সা. নিজেই ঘোষণা করেছেন। তিনি তাদের নিজের উত্তরসূরী বলেছেন।

বাংলাদেশের আলেমগণ বহুমুখী খেদমত করছেন। তাদের ছাত্র-শিষ্যগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের সেবা করছেন। কেউ দাওয়াত দিচ্ছেন, কেউ দীন শেখাচ্ছেন, কেউ আত্মশুদ্ধির কাজ করছেন। আমি বাংলাদেশের আলেমদের ভালোবাসি।

এ সফরে এসে তাদের অনেকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। জ্ঞানমূলক আলোচনাও হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে। আমি তাদের থেকে উপকৃত হয়েছি।

আওয়ার ইসলাম : মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতের কারণ কী?

ড. আবু ইয়া’লা : মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতের পেছনে অনেকে অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক ও মতবাদকে দায়ি করবেন। আমি মনে করি, মূল কারণ হলো ইসলামের উপর এক হতে না পারা। মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া।

এমন রাজনৈতিক ও মতাদর্শের সংঘাত অতীতেও হয়েছে এবং তার সমাধানও হয়েছে। আমি মনে করি, সর্বোত্তম সমাধান ইসলামের উপর এক হওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য কর। পরস্পরের সাথে বিবাদে লিপ্ত হও না। যদি তোমরা তা কর তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের প্রভাব খর্ব হবে।ধৈয ধারণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈযশীলদের সঙ্গে আছেন।’

এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পারস্পারিক মতবিরোধের সময় ধৈয ধারণের শিক্ষা দিয়েছেন।

আওয়ার ইসলাম : বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের পথে অন্তরায় কী?

ড. আবু ইয়া’লা : বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের পথে অন্তরায় অগণন। কিন্তু সমাধান একটাই। তাহলো আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধর।’ রাসুল সা. বলেছেন, ‘মুসলিম উম্মহ সুদৃঢ় প্রাচীরের মতো যার একটি ইট অন্যটিকে দৃঢ় করে।’

সুতরাং যা কিছু বৃহ্ত্তর মুসলিম ঐক্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে পরিহার যোগ্য। চিন্তা করলে আপনি বুঝতে পারবেন কোন কোন বিষয় ঐক্যের পথে অন্তরায় হচ্ছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ ও তার রাসুল সা. এর আনুগত্যের মাধ্যমে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ইসলামের শত্রুদের প্রতিহত করা সম্ভব হবে। যারা মুসলিম সমাজকে বিভক্ত করে রাখতে চায় এবং মুসলিম সমাজে রক্তাপাতে ইন্ধন দেয়। আমাদের অতীতের সকল অর্জন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে হয়েছিলো।

ঐক্যবদ্ধ না হতে পারলে, আমাদের সম্মান, অধিকার, ধর্ম ও পবিত্র ভূমি কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারবো না।

আওয়ার ইসলাম : এ সমস্যার আশু কোনো সমাধান আশা করেন কি?

ড. আবু ইয়া’লা : সমাধান আশা করি। আমি বলেছি, পূর্বেও এমন অনেক সংকট তৈরি হয়েছিলো এবং তার সমাধানও হয়েছে।

আওয়ার ইসলাম : কীভাবে?

ড. আবু ইয়া’লা : আমি মনে করি, যে কোনো সমস্যার সমাধান আলোচনা ও কূটনৈতিক উপায়ে হতে পারে। পারস্পারিক আস্থা, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সমাধানের রাস্তা বের করে আনতে হবে।

আমি আশাবাদী, কারণ রাসুলুল্লাহ সা. এর ভাষ্য অনুযায়ী এ উম্মতের উপর কল্যাণের ধারা অব্যাহত এবং তা সকল উম্মত ও সব মুসলিম দেশের জন্য। ইনশাআল্লাহ! অতি শীঘ্রই মুসলমানের সুদিন আসবে।

আওয়ার ইসলাম : মসজিদুল আকসার ব্যাপারে আরব নেতাগণ নিরব ভূমিকা পালন করছে কেনো? তাদের কেউ কেউ মসজিদুল আকসাকে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন?

ড. আবু ইয়া’লা : অন্যদের ব্যাপারে দায়বদ্ধ নই। আমি দায়বদ্ধ আমি কি বিশ্বাস করি তার উপর। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, মসজিদুল আকসা ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ব্যাপার। প্রতিটি মুসলিম মসজিদুল আকসার জন্য আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। মসজিদুল আকসা মুসলমানের সম্মান ও সম্ভ্রমের বিষয়। তা রক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব।

আওয়ার ইসলাম : অমুসলিমদের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্ক কেমন হবে?

ড. আবু ইয়া’লা : মানুষ সবাই আদম ও হাওয়া আ. এর সন্তান। আল্লাহ তায়ালা পূর্বে অনেক নবী প্রেরণ করেছেন এবং ইসলামকে চূড়ান্ত জীবনবিধান হিসেবে মনোনীত করেছেন। সুতরাং মুসলমানের দায়িত্ব হলো অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। কেননা মানুষ আদমের সন্তান। এ হিসেবে সবাই ভাই ভাই। মুসলমান অন্যকে ইসলামের দাওয়াত দেয় তবুও মমতা ও ভালোবাসার সাথে দাওয়াত।

আওয়ার ইসলাম : কিন্তু যখন মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্ক মুসলমানের পারস্পারিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলে তখন তার ব্যাপারে কী বলবেন?

ড. আবু ইয়া’লা : আমি বলেছি, মানুষ হিসেবে বা মানব জাতির সদস্য হিসেবে সকলের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব শুধু মুসলমানের জন্য নির্ধারিত।

অমুসলিমদের আমরা প্রজ্ঞার সাথে ইসলামের পথে আহবান করবো। তারা সাড়া দিলে ভালো। না হলে তাদের পথ আর আমাদের পথ ভিন্ন।

আর তারা যদি শত্রুতায় লিপ্ত হলে ভিন্ন প্রশ্ন।

আওয়ার ইসলাম : একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। মিসরের পড়তে যাওয়া বাঙালি ছাত্রদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ড. আবু ইয়া’লা : তারা স্বভাবতই মেধাবী হয়। তারা পরিশ্রমী ও ত্যাগী মানসিকতা সম্পন্ন হয়। আমরা তাদেরকে স্নেহ ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখি।

আওয়ার ইসলাম : যারা আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তাদের করণীয় কী?

ড. আবু ইয়া’লা : প্রথম করণীয় কুরআনের হাফেজ হওয়া। দ্বিতীয়ত তাদের আরবি ভাষায় দক্ষ হতে হবে। কেননা তাদের আরবি মাধ্যমে লেখা-পড়া করতে হবে। তৃতীয়ত বাংলাদেশের সরকারের বৈধ কাগজপত্র তৈরি করতে হবে। কাগজপত্র প্রস্তুত হলে তা আজহারের বিজ্ঞপ্তি দেখে তা পাঠাতে হবে। আল আজহার কোনো ছাত্রের ভর্তি নিলে তার যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে। আবাসিক ব্যবস্থা থেকে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত।

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ