আতাউর রহমান খসরু : রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে কয়েক দশক ধরে। এর ধারাবাহিকতায় প্রথমে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩৩ ভাগ নারী কর্মীর বিধান করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের জন্য শর্ত দেয়া হয় ‘নেতৃত্বের সব স্তরে ৩৩% নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।’
আরপিওর ৯০-এর খ-এর খ(২) অনুচ্ছেদে, কেন্দ্রসহ রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এতে পর্যায়ক্রমে ২০২০ সাল নাগাদ এই লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়েছে।
তবে বিষয়টি ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অনেকটাই আদর্শ বিরোধী। কেননা ইসলামি মতাদর্শ ও বিধান মান্য করে সকল স্তরে নারীর নেতৃত্ব সম্ভব বলে মনে করেন না অধিকাংশ ইসলামি দলের নেতা। তারা মনে করেন, সরকারের এ আইন বাস্তবায়িত হলে সমাজে বিশৃংখলা বৃদ্ধি পাবে।
তবে বাস্তবায়নে দীর্ঘ অবকাশ ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ইসলামি দলগুলো নারী নেতৃত্বের বিষয়টি মেনে নিয়েই দলীয় নিবন্ধন গ্রহণ করে। তবে ইসির এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদও করে কোনো কোনো ইসলামি দল।
নিবন্ধনের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ১০ বছর। দীর্ঘ এ সময়ে ইসলামি দলগুলোতে নারী অন্তর্ভূক্তি প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে গত ১৩ জুন ইসি নারী নেতৃত্ব বিষয়ক শর্তপূরণের তাগিদ দিয়েছে। যা ইসলামি দলগুলোতে নতুন অস্বস্তি তৈরি করেছে বলে জানা গেছে।
মিডিয়া নিয়ে আমাদের আক্ষেপ ও কিছু বাস্তবতা
দেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামি সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট শাহীনুর পাশা মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর উপর এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া; বিশেষত ইসলামি দলগুলোর জন্য এমন শর্ত প্রদান করা উচিৎ হয় নি। কেননা ইসলামি বিধান মান্য করে একজন নারীর জন্য সর্বস্তরের নেতৃত্ব প্রদান করা সম্ভব নয়।’
আওয়ার ইসলামকে তিনি বলেন, নেতৃত্বে না থাকলেও জমিয়ত তার নারী কর্মীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে ইসির কাছে এ ধারার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছি। আমরা চাই সরকার এ ধারা থেকে ইসলামি দলগুলোকে অব্যহতি দিক।
কিন্তু অব্যহতি না দিলে এ সংক্ষিপ্ত সময়ে আপনারা কী করবেন, ‘আমরা চেষ্টা করবো রাষ্ট্রের আইন মেনে যতোটা সম্ভব নারী সদস্য অন্তর্ভূক্ত করতে। তবে কোনো ইসলামি দলের পক্ষে অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে পার্সেন্ট-এর শর্ত পূরণ করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। আমাদেরও হবে না।’
দেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামি দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে, ইসলামি দলগুলোকে চাপে রাখতেই সরকার এমন আইন করেছে। নতুবা এ শর্তে জাতির বৃহত্তর কোনো স্বার্থ দেখছেন না দলটির হাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ। বরং তিনি ক্ষতির আশঙ্কা করে বলেন, ‘নারীদের এভাবে রাজনীতিতে টেনে আনলে ইসলামি রাজনৈতিক দলে অনেক ফেৎনা ও বিশৃংখলা দেখা দিবে। ইসলামি নীতি আদর্শ বিলীন হবে।’
নিবন্ধনের সময় প্রতিবাদ করেছিলেন কি? জানতে চাইলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘না, তখন আমরা প্রতিবাদ করি নি। এখন ইসির আইন ও ইসলামি শরিয়তের নির্দেশনা সামনে রেখে কিভাবে কী করা যায় তা ভাবছি।’
ইসলামী আন্দোলনে নারী নেতৃত্বের অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, তাদের দলের নারী কর্মী থাকলেও তারা নেতৃত্বে নেই। তবে নির্বাচন কমিশন আইন কিভাবে মান্য করা যায় তা নিয়ে ভাবছেন। দলীয় শুরায় এ বিষয়ে একাধিক বার আলোচনাও হয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০ মুসলিম ব্যক্তিত্ব; জরিপ
তিনি বলেন, আমরা দেশের শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করছি। পরামর্শ করছি। ভাবছি নারীদের কিভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। যেমন মহিলাদের পৃথক ইউনিট হতে পারে। যাদের কার্যক্রম হবে সম্পূর্ণ পৃথক। পুরুষ ইউনিটের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস মনে করে, নেতৃত্বে ৩৩ ভাগ নারী সদস্যের শর্তারোপ ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে এক ধরনের হঠকারিতা। দলের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, ‘এমন শর্তের কোনো যৌক্তিকতা নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবাস্তবও বটে।’
নারী নেতৃত্বের ব্যাপারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এখনো আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোনো নারী সদস্য নেই। আমরা ইসির চিঠি পেয়েছি সামনের নির্বাহী বৈঠকে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো। সেখানে দলের করণীয় ও কৌশল নির্ধারণ করা হবে।’
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতী ফয়জুল্লাহ জানান আমাদের দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অনেক নারী সদস্য রয়েছেন। ইসলামের বিধি-বিধান ও নীতি-আদর্শ সামনে রেখে কিভাবে অগ্রসর হওয়া যায় সে চেষ্টা করছি। পারসেন্ট পূরণ হবে কিনা জানি না, দেখা যাক কী হয়।
দলে নারী নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠায় অন্যান্য ইসলামি দলের তুলনায় এগিয়ে আছে খেলাফত মজলিস। দলটির রয়েছে পৃথক কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে একাধিক মহিলা ইউনিট। দলটিতে এখন নারীর নেতৃত্ব কোন পর্যায়ে আছে জানতে চাইলে দলের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘পারসেন্ট বলতে পারবো না। তবে শুরু করছি এবং আগাচ্ছি।’
২০২০ সালে ভেতর ৩৩ পার্সেন্ট পূরণ করা সম্ভব হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না সেটা সম্ভব হবে না। শুধু ইসলামি দলগুলো কেনো দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ৩৩ ভাগ নারীর প্রতিনিধিত্ব নেই এবং ২০২০ সালের ভেতর তা পূরণ করাও সম্ভব হবে না।’
তবে ইসির এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে অভিজ্ঞ এ রাজনীতিবিদ মনে করেন, ‘পার্সেন্ট নির্ধারণের কোনো প্রয়োজন নেই। ইউরোপ-আমেরিকায়ও এমন কোনো পার্সেন্ট নির্ধারণ করা নেই।’
কমিটিতে ৩৩% নারী প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিবন্ধিত হয়ে বিপাকে ইসলামী দলগুলো
আরআর