শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


পাহাড় নিধনও মানবতাবিরোধী অপরাধ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

যুবায়ের আহমদ : নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মনকাড়া আয়োজন পাহাড় মহান আল্লাহ তাআলার কুদরতের অন্যতম নিদর্শন। মহান আল্লাহ তাআলা পাহাড়কে অযথা সৃষ্টি করেননি। পাহাড়ের রহস্যময়ী সৌন্দর্য যেমন প্রকৃতিকে রূপকথার স্বপ্নপুরীতে পরিণত করেছে, তেমনি গাছপালা, উদ্ভিদ আর উপকারী সব বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে তা পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জমিনের স্থিতিশীলতা রক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা ও ভূমিকম্প থেকে সৃষ্টিকুলকে হেফাজতের মাধ্যমে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে রাখতে যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, সেখানে ততটুকু পাহাড় সৃষ্টি করেছেন।

পবিত্র কাবার নিকটবর্তী দুটি পাহাড় ‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’কে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কোরআনুল কারিমের ২৭তম পারায় ‘তুর’ নামে একখানা সুরা রয়েছে। ‘তুর’ অর্থ হলো এমন পাহাড়, যাতে লাতাপাতা ও বৃক্ষ উদগত হয়। (মা’আরেফুল কোরআন : ১২৯৯ পৃষ্ঠা) এ সুরার শুরুতে আল্লাহ তাআলা  পাহাড়ের কসম করেছেন। পাহাড়ের কসম করার মাধ্যমে মানবসভ্যতার জন্য পাহাড়ের বিশেষ গুরুত্ব প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরায় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে পাহাড় প্রসঙ্গ। মহান আল্লাহ তাআলা  পাহাড়কে জমিনের পেরেক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি কি ভূমিকে করিনি বিছানা। আর পর্বতমালাকে কি করিনি পেরেক?’ (সুরা নাবা : ৬-৭) দেড় হাজার বছর আগে দেওয়া পবিত্র কোরআনের এ তত্ত্বকে বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় সত্য বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ববিদ্যার রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত ‘Earth’ নামক গ্রন্থে বইটির লেখক যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান একাডেমির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা. ফ্রাংক উল্লেখ করেন, পাহাড় হলো গোঁজ বা পেরেকের আকৃতির। ভাসমান খুঁটির মতো তা পৃথিবীর স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাহাড়ের গভীর শিকড় পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রোথিত। তার মাত্র ১০ শতাংশ ওপরে আর ৯০ শতাংশই পানির নিচে। পবিত্র কোরআনুল কারিমের অন্যত্রও ইরশাদ হয়েছে যে পাহাড়কে তিনি পৃথিবীর স্থিতিশীলতা রক্ষায় তৈরি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘পৃথিবীকে স্থিতিশীল করে রাখতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পাহাড় সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি পৃথিবীতে এ জন্য ভারী বোঝা (পাহাড়) রেখেছি, যেন তাদের নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে। ’ (সুরা আম্বিয়া : ৩১) এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা  জমিন সৃষ্টি করলে তা নড়াচড়া শুরু করল। অতঃপর তিনি পাহাড় স্থাপন করার পর জমিনের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হলো। (তিরমিজি : ৩২৯১)

মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রতি মুহূর্তে অক্সিজেনের প্রয়োজন। অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আর পাহাড় হলো অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি। পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো হাজারো রকমের গাছপালা প্রতিনিয়ত আমাদের জন্য মহামূল্যবান অক্সিজেন সরবরাহ করছে বিনা মূল্যে। এর বিপরীত দিকে আমাদের শ্বাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ছেড়ে দেওয়া বিষ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস টেনে নিচ্ছে গাছ। আর এর মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলকে পরিশুদ্ধ করে আমাদের বসবাসের উপযোগী করে রাখে। কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তার সামগ্রিক আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি সংরক্ষণ অনিবার্য। তা না হলে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে। পৃথিবী ক্রমেই উষ্ণ হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় Global warming বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের। গাছগাছালি না থাকলে প্রভাব পড়ে পানিচক্রেও। গাছের এ বিশাল প্রয়োজন পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পাহাড়ের।

পাহাড়ের এ বহুমুখী উপকারের কথা বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তাআলার ভাষায়। তিনি বলেন, ‘তিনিই এ (জমিনের) বুকে এর ওপর থেকে পাহাড়গুলো গেড়ে দিয়েছেন এবং তাতে বহুমুখী কল্যাণ রেখে দিয়েছেন। আর তাতে সবার আহারের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (সুরা হা-মীম আস সাজদাহ : ১০)

বন্য পশুপাখিরা পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে। উপকারী হাজারো রকমের বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাস হলো পাহাড়। আল্লাহ তাআলা বন্য পশুপাখিদের খাবার পাহাড়-জঙ্গলে ছড়িয়ে রেখেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি জমিনে পাহাড়গুলো স্থাপন করে রেখেছেন, যাতে তা তোমাদের নিয়ে কখনো টলে না পড়ে। তাতে প্রত্যেক প্রকারের বিচরণশীল জন্তুও তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন। ’ (সুরা লুকমান : ১০)

পাহাড় ধ্বংসের ফলে এসব প্রাণীর খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ায় অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে পৃথিবীর ভারসাম্য।

সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এলে তা পৃথিবীকে বসবাসের অনুপোযোগী করে তোলে। সৃষ্টি হয় বিভিন্ন জটিল ও দুরারোগ্য রোগব্যাধির। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির খারাপ প্রভাব থেকে মানবজাতিসহ সৃষ্টিকুলকে বাঁচাতে মহান রব ভূপৃষ্ঠের ২৫ কিলোমিটার ওপর থেকে ৩০ কিলোমিটার ওপর পর্যন্ত যে কুদরতি ছাঁকনির ব্যবস্থা করেছেন, তা ওজোন স্তর। ওজোন লেয়ার ভেদ করে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির যে অংশ পৃথিবীর দিকে চলে আসতে থাকে তার বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় পাহাড়। পাহাড়ের কারণেই তা সরাসরি পৃথিবীতে আসতে পারে না। এভাবে পাহাড়ের কল্যাণে মারাত্মক দূষণ থেকে বেঁচে যায় পরিবেশ।

যে পাহাড়কে আল্লাহ তাআলা  পৃথিবীর জন্য পেরেক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, যে পাহাড়ের গাছপালা অবিরত অক্সিজেন সরবরাহ করে, যার মাধ্যমে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা পায়, সেই পাহাড়ই আজ এক ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে পাহাড় ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণ যায়। পাহাড় নিজে নিজেই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়নি, বরং আমাদের সামান্য লাভের জন্য জাতির বৃহৎ স্বার্থকে গলাটিপে হত্যা করে পাহাড় কেটে তাকে মৃত্যুকূপে পরিণত করেছি। আল্লাহ তাআলা  ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয় তা তোমাদেরই কর্মের ফল.। ’ (সুরা শুরা : ৩০)

পবিত্র কোরআনের স্থানে স্থানে পাহাড়ের আলোচনা করে আল্লাহ তাআলা বুঝিয়েছেন যে পাহাড় মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। মানুষ যেন নিজেদের স্বার্থেই তা রক্ষা করে। কিন্তু পরিবেশের প্রাণ পাহাড় আজ এক শ্রেণির বিবেকবর্জিত ও সমাজবিরোধী ‘মানুষের’ লালসার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সামান্য স্বার্থে তারা নির্বিচারে পাহাড় কেটে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। গত ২০ বছরে শুধু চট্টগ্রামেই প্রায় ২৫ হাজার একর পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করেছে দুর্বৃত্তরা। সিলেট, কুমিল্লা, বান্দরবান ও কক্সবাজারেও পাহাড় নিধন অব্যাহত। ফলে পাহাড় নিধনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ক্রমেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে পাহাড় ধস। ২০০৭ সালে ১২৮ জন হতভাগ্য মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে পাহাড়ে মৃত মানুষের তালিকা। দুঃখজনক হলো, পাহাড় নিধনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে চলে যায় অথবা ক্ষমতাবলে অধরাই থেকে যায়। কয়েক দিন পর আমরাও এ মানবতার শত্রুদের ভুলে যাই। বছর গড়িয়ে নতুন বছর আসে। আসে বর্ষা। আবার ধসে পড়ে পাহাড়। বছর ঘুরে আসতে না আসতেই আবারও পাহাড়ের কিনারায় কুঁড়েঘরে বেজে ওঠে কান্নার রোল। বাতাসে ভাসে শিশুর আর্তনাদ। কঠোর শাস্তি না হওয়ায় পাহাড় নিধনকারীরাও একে নাথিং মনে করে তা অব্যাহত রেখেছে। একদিকে পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে আবার পরিবেশ বিপর্যয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ এর নেতিবাচক প্রভাবে মুখোমুখি হচ্ছে।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে প্রকৃতি ও পাহাড় ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। নিজ স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করার অধিকার তিনি কাউকে দেননি। যে পাহাড়ের সঙ্গে ১৭ কোটি মানুষের অধিকার জড়িত, সে পাহাড় নিধন করলে হক্কুল ইবাদ (বান্দার হক) নষ্ট করার কারণে কঠোর জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। এমন লোকেরা নিজেদের জান্নাতে যাওয়ার সম্ভাবনাকেই গলাটিপে হত্যা করছে। আল্লাহর বান্দাদের হক নষ্ট করার কারণে তাদের জাহান্নামি হতে হবে।

-এজেড


সম্পর্কিত খবর