শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কাওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাবর্ষ; প্রস্তুতি ও কিছু কথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আবদুর রহমান গিলমান

দীর্ঘ ২ মাস বিরতির পর শাওয়াল মাসে কওমি মাদরাসাসমূহের প্রাণচঞ্চলতা ফিরে আসে। ইলমে দীন অন্বেষণের গভীর প্রেরণা নিয়ে তালিবুল ইলমরা সফরের কষ্ট স্বীকার করে বহু দূরদূরান্তে যায়। বাবা-মার স্নেহ, আত্মীয়- স্বজনদের আদর-মমতা সব বিসর্জন দিয়ে নিজ বাড়িতে ভালো থাকা- খাওয়া সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন পরিবেশে গিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট স্বীকার করে তারা। মাদরাসাকে নিজেদের বাড়ি-ঘর বানিয়ে, উস্তাদদের নিজের বাবা-মা’র তুল্য মনে করে এবং ছাত্রদের ভাইয়ের মর্যাদা দিয়ে বছরের পর বছর অতিক্রম করে তারা। নিঃসন্দেহে তাদের এই ত্যাগ ও কুরবানি নজীরবিহীন।

এই ত্যাগ ও কুরবানির বদৌলতে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহর এই সম্প্রদায়কে দান করছেন উলুমে নববীর মতো দৌলত। তাদের এই ত্যাগ ও কুরবানীকে আরও সফল ও সার্থক করে তুলতে ইলমে দীন অর্জনকালীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। বিশেষ করে বছরের শুরু থেকেই সেই বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রেখে মেহনত করতে পারলে ইনশাআল্লাহ নিজের জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে পাবে। দু’একজন তালিবুল ইলমও যদি এর ওপর আমল করে তাহলে এই লেখাটি সার্থক হবে।

প্রথম কাজ নিয়তের বিশুদ্ধতা। ইলম দ্বারা নিজে এবং অন্যের উপকৃত হওয়া নিয়তের শুদ্ধতা এবং বিশুদ্ধতার ওপর নির্ভর। আল্লাহ না করুক- ইলম শিক্ষা দ্বারা উদ্দেশ্য যদি দুনিয়া, মান-মর্যাদা, ধন-সম্পদ কিংবা বড় বড় উপাধি অর্জন করা হয়, তাহলে এই নিয়তের কারণে দুনিয়াতেই সে দুনিয়াবাসীর কাছে লাঞ্ছিত হবে। আর আখেরাতে এই সমস্ত ব্যক্তিদের উল্টো মুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এই ইলমই তখন তার জন্য ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মুসলিম শরিফের হাদিসে এই বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে- ‘কিয়ামতের দিবসে এমন এক ব্যক্তি- যে ইলম শিখেছে এবং অপরকে শিখেয়েছে, কুরআনুল কারিম পড়েছে, তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি যা শিখেছ সে অনুযায়ী কি আমল করেছ? তখন সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি এবং (সে অনুযায়ী আমল করে) অপরকে শিখিয়েছি, কুরআন পড়েছি। তখন তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি এই জন্য ইলম শিখেছ যে, লোকেরা তোমাকে আলেম বলবে। আর তা দুনিয়াতে বলা হয়েছে। (সুতরাং তুমি তোমার প্রতিদান পেয়ে গেছ) তখন তার ব্যাপারে নির্দেশ হবে, তাকে উল্টো মুখ করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার জন্য।

তাই নিয়ত এটা হওয়া উচিৎ, এই ইলম দ্বারা ইসলামকে গোটা দুনিয়ার মাঝে প্রতিষ্ঠা করবো। এই নিয়তে ইলম শিখা অবস্থায় যদি তার মৃত্যুও এসে যায়, তাহলে কাল হাশরের মাঠে তার আর নবীদের মাঝে শুধু একটি মর্যাদার পার্থক্য থাকবে। এইজন্য সর্বপ্রথম কাজ হলো নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেওয়া।

আরেকটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যদি কারও মনে হয় যে, তার নিয়ত সঠিক হচ্ছে না, তাহলে এর জন্য ইলমে দীন শিখা বন্ধ রাখবে না; বরং ইলমে দীন শিখতে থাকবে আর নিয়তকে বিশুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

দ্বিতীয় কাজ ইলমি যোগ্যতাকে (ইস্তে’দাদ) আরও শাণিত করা। নিয়তকে বিশুদ্ধ করার পর যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা হলো, নিজের ইলমি যোগ্যতাকে আরও মজবুত করা। এর জন্য প্রয়োজন প্রথম দিন থেকেই কোমর বেঁধে মেহনত শুরু করা। দীনি মাদরাসাসমূহে যতগুলো বিষয়ে পড়ানো হয়, তার প্রত্যেকটাতে নিজেকে এতটুকু যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা যে, ওই বিষয়ে নিজের কোন দুর্বলতা অন্যের কাছে যেন প্রকাশ না পায়। ওই বিষয়গুলোতে কেউ ভুল করে আপনার সামনে পার পেয়ে যাবে এমন যেন না হয়। এই যোগ্যতা অর্জনের জন্য হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. এর একটি কথা স্মরণ রাখলেই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।

থানবী রহ. বলেন, যে তালিবুল ইলম ৩টি কাজ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে অবশ্যই ইলমের মতো দৌলত দান করবেন। সেই তিনটি কাজ হলো, ১. সামনের সবক মুতালা‘আ, ২. সবকে মনযোগের সাথে উপস্থিতি, ৩. এবং তাকরার। এই তিনটি কাজ হলো ইলমে দীন শিখার সফলতার চাবিকাঠি। এই বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা নিচে করা হলো।

মুতালা‘আ বলা হয়, জানাকে অজানা থেকে পৃথক করা। অর্থাৎ আপনি যখন সবকে বসার পূর্বে আজকের সবক মুতালা‘আ করে সরফী, নাহবী এবং লোগাবী তাহকিক করবেন, তার তারজামা, তারকিব এবং মাফহুম বুঝার চেষ্টা করবেন, তখন এই চেষ্টার দ্বারা আপনার যে সফলতা আসবে তাকে ‘মালুমাত’ বলবে। আর চেষ্টার পরও যেগুলো বুঝে আসেনি সেগুলোকে ‘মাজহুলাত’ বলবে। মুতালা‘আর দ্বারা এভাবে মা’লুমাত থেকে মাজহুলাত পৃথক হয়ে যায়। তবে মাজহুলাতগুলো আপনার মস্তিষ্কে বিদ্যমান থাকতে হবে। যাতে পরবর্তীতে সবকে উস্তাদের থেকে অথবা অন্য ছাত্র থেকে তা হল করা যায়।

দ্বিতীয়ত সবকে মনযোগের সাথে নিয়মিত উপস্থিতি। এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ চেষ্টা এভাবে হতে পারে যে, আপনার থেকে কোন সবক ছুটেও যাবে না এবং কোন সবকে অমনযোগিতাও থাকবে না। সবকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ জাগ্রত থেকে অংশগ্রহণ করতে হবে। এই চেষ্টায় সফলতার জন্য জরুরি হলো, সবক চলা অবস্থায় উস্তাদের মুখ থেকে যে কথাই বের হবে তা ব্যতীত অন্য কোন কথা কানে না দেওয়া। এভাবে আপনার চোখ উস্তাদের দিক থেকে অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করবে না। মোটকথা অন্তর এবং মস্তিষ্ককে পরিপূর্ণভাবে সবকে উপস্থিত রাখতে হবে। উস্তাদ যে বিষয়গুলো আলোচনা করবেন তা মস্তিষ্কে ধারণ করতে হবে এবং পরবর্তীতে কাগজে লিপিবদ্ধ করে নিবে।

তৃতীয়ত তাকরার। সবকে শুনা বিষয়গুলোকে পুনরাবৃত্তি করাকে তাকরার বলা হয়। এর দ্বারা মুতালা‘আ এবং সবকে থেকে যাওয়া ত্রুটিগুলো বের হয়ে আসে। তাকরারের কাজ যত পরিপূর্ণতার সাথে করা যাবে আপনার সবক তত বেশি আয়ত্ব হবে। যে তালিবুল ইলম যতবেশি তাকরারে পারদর্শী হবে সে তত যোগ্যতাসম্পন্ন উস্তাদ হবে।

অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, তাকরারের দ্বারা মুকাররিরের (তাকরারকারী) যে ফায়দা হয়, শ্রোতাদের তা হয় না। এই জন্য উত্তমপন্থা হলো, দুইজনে মিলে তাকরার করবে। প্রথমে একজনে বলবে, পরে দ্বিতীয় জনে বলবে। অবশ্য দুইয়ের অধিক হলে তখন একজনে বলবে বাকিরা শুনবে। পর্যাপ্ত সময় থাকলে একজন একজন করে প্রত্যেকে বলবে। এই তিনটি বিষয়ের ওপর এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। এগুলো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত উস্তাদদের থেকে জেনে নিন।

তৃতীয় কাজ লেখা সুন্দর করা। সুন্দর লেখার দ্বারা একজন আলেম দীনের অনেক খেদমত করতে পারে। এই গুণ অর্জন করার জন্যও প্রথম দিন থেকেই মেহনত শুরু করে দেওয়া প্রয়োজন। সম্ভব হলে কোন অভিজ্ঞ কাতেব থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সময় নিয়ে মশক করবে। আরবি লেখা সুন্দর করার জন্য সর্বপ্রথম হুরুফে তাহাজ্জির আকৃতিগুলো যথা নিয়মে মশক করবে। এরপর মুরাক্কাবাত (বাক্য) এর মশক করবে। বিশেষ করে তিন হরফ বিশিষ্ট শব্দগুলোর পরিচয় জেনে নিবে। যে কোন হরফের ব্যবহার তিন পদ্ধতির যে কোন এক পদ্ধতিতে অবশ্যই হবে। হরফটি হয়তো বাক্যের শুরুতে, না হয় মাঝে, অথবা শেষে হবে। এই তিন পদ্ধতির ব্যবহারে লেখারও ৩টি পদ্ধতি আছে। তাই এই তিন পদ্ধতিতে প্রত্যেকটা অক্ষরের আকৃতি কেমন হবে তা শিখে ভালোভাবে মশক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি উত্তম পদ্ধতি এটাও হতে পারে যে, যেখানেই কোন কাতেবের লিখিত কোন শব্দ দৃষ্টিগোচর হবে সাথে সাথে তা স্মরণ রাখবে এবং পরে তা নকল করার চেষ্টা করবে। এভাবে মেহনত করলে অল্প সময়েই হাতের লেখা সুন্দর হয়ে যাবে। এভাবে বাংলা এবং ইংরেজি লেখাও সুন্দর করার চেষ্টা করতে হবে।

বাংলা লেখার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে- প্রত্যেকটা অক্ষর যেন সমান মাপের হয়। কোনটা বড় কোনটা ছোট হলে লেখা সুন্দর হবে না। ইংরেজি প্রতিটি অক্ষর চারভাবে লেখা যায়। যেমন- প্রত্যেকটি অক্ষর হয় ছোট হাতের হবে না হয় বড় হাতের। এই দুইয়ের প্রত্যেকটি আবার হয় ছাপার আকৃতিতে হবে না হয় হাতের লেখার আকৃতিতে হবে। এভাবে মোট চারটি পদ্ধতি হয়। কোন অভিজ্ঞ রাইটার থেকে ইংরেজি লেখার এই সবগুলো পদ্ধতি শিখে নিবে।

চতুর্থ কাজ বক্তৃতা শেখা। নিজের কথা অন্যের সামনে উপস্থাপন করার জন্য এবং অন্যকে দীনের প্রতি আহ্বান করার জন্য সবচেয়ে ক্রিয়াশীল মাধ্যম হলো মুখের ভাষা। ভালো কথা বলার যোগ্যতা এবং বক্তৃতার নিগুঢ় রহস্য শেখা ব্যতীত সমাজের প্রচলিত অন্যায়সমূহ বন্ধ করা সহজ নয়। একজন ভালো বক্তা ও আলোচক তার বক্তৃতা দ্বারা একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করতে পারে। অবচেতন জাতির মাঝে চেতনা সৃষ্টি করতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মানুষকেই কথা বলার কিছু না কিছু যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহপ্রদত্ত সেই যোগ্যতাকে প্রকাশের মাধ্যমে আরও শাণিত করা। এর জন্য প্রয়োজন হলো অভিজ্ঞ ও দক্ষ বক্তাদের বক্তৃতার কৌশল ভালোভাবে খেয়াল করা। পরবর্তীতে মশক করা। ক্রমান্বয়ে বক্তৃতার স্বর, শরীরের অঙ্গভঙ্গি কন্ট্রোল এবং যথাযথ স্থানে প্রয়োগের যোগ্যতা অর্জন করবে।

পঞ্চম কাজ নিসাব বহির্ভুত কিতাব অধ্যায়ন করা। দরসে নিযামীর কিতাবের পাশাপাশি গায়রে দরসী কিতাবাদী পাঠের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিতে হবে। এর দ্বারা জনসাধারণের মাঝে দীনি কাজ করা সহজ হবে। তবে কোন ক্ষতিকর বই পাঠ করা যাবে না। এই জন্য গায়রে দরসী যে বই বা কিতাবটি পড়বে তা নিজের উস্তাদকে দেখিয়ে পড়বে। উস্তাদের পরামর্শে সবকের সময় ব্যতীত অবসর সময়ে এ সকল বই-পুস্তক পাঠ করবে।

ষষ্ঠ কাজ কুরআন মুখস্থ ও বিশুদ্ধকরণ। যে ছাত্র হাফেজে কুরআন নয়, সে সাধারণত কয়েক জায়গায় সমস্যায় পতিত হয়। প্রথমত কুরআন শরিফ হিফজ না থাকায় বিভিন্ন কিতাবের বিভিন্ন স্থানে সমস্যার সম্মুখীন হয়। নামায পড়ানোর সময়- বিশেষ করে ফজরের নামাযে সুন্নাত কেরাতে নামায পড়ানো যায় না। একান্ত দুই একটা সুরা মুখস্থ থাকলে তাই সব সময় পড়তে হয়। হাফেজ না হওয়ায় অনেককে তাজবিদেও দুর্বল দেখা যায়। এভাবে তার বয়ান এবং আলোচনায় কুরআনের আয়াত কম আসে বা আসলেও অনেক সময় ভুল তিলাওয়াত করে বসে। এই জন্য তালিবুল ইলমদের প্রতি এই আবেদন থাকলো যে, এই অপূর্ণতাকে পূর্ণ করার জন্য বছরের শুরু থেকেই চেষ্টা-ফিকির করবে। প্রতিদিন কিছু না কিছু কুরআনের আয়াত মুখস্থ করবে।

কমপক্ষে শেষ দুই/তিন পারা এবং প্রসিদ্ধ বড় সূরাগুলো অবশ্যই মুখস্থ করে নিবে। কোন অভিজ্ঞ কারী সাহেব থেকে তাজবিদও মশক করে নিবে। এর সাথে সাথে জুম‘আ, ঈদ এবং বিবাহের খুতবাগুলোও মুখস্থ করে নিবে।

সপ্তম কাজ অন্য ব্যস্ততা পরিহার করা। তালিবুল ইলমরা সবসময় একটি কথা স্মরণ রাখবে যে, আমরা নিজেদের ঘর বাড়ি ছেড়ে এসেছি একমাত্র ইলম শিক্ষা করার জন্য। সুতরাং আমাদের প্রত্যেটি সময়ই অনেক মূল্যবান। তাই কোনভাবেই যেন সময় হত্যা না হয়। বিশেষ করে ছাত্রদের জন্য মোবাইল, ফেসবুক, ইন্টারনেট, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডাবাজী, একান্ত প্রয়োজন না হলে ইমামতি, টিউশনী, যে কোন ধরনের সভা-সমাবেশ ও মাহফিলে সব সময় যোগদান ইত্যাদি বিষয় পরিহার একান্ত জরুরি।

ইসলামী রাজনীতি ইসলামের একটি বিধান। তবে কেউ কেউ শরিয়তের নিয়ম-নীতি না মেনে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো এই বিধান পালনের চেষ্টা করছে। তাই এ ধরনের সকল ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী অথবা বস্তুবাদী রাজনীতির সাথে কোনভাবেই জড়িত হওয়া যাবে না। হ্যাঁ, যদি এমন কোন সহিহ ধারার ইসলামী সংগঠন থাকে, যা কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালিত এবং যার লক্ষ্য আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা, যে সংগঠন সাংগঠনিক কর্মসূচির পাশাপাশি ছাত্রদের পড়া-শোনার প্রতিও যত্নবান, এমন কোন রাজনৈতিক সংগঠন থাকলে ঈমানী দায়িত্ব পালনের নিয়তে নিজের পড়ালেখা ঠিক রেখে তাতে অংশগ্রহণ করার অবকাশ রয়েছে। আমাদের আকাবিরদের মাঝে অনেকে ছাত্র জীবনে এমন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে।

অষ্টম কাজ আসাতিযায়ে কিরাম এবং সাথী ভাইদের হক আদায় করা। একজন সত্যিকার তালিবুল ইলম এর মর্যাদা অর্জন করার জন্য অন্তরে উস্তাদের ভালোবাসা থাকা অত্যন্ত জরুরি। উস্তাদের সন্তুষ্টি অর্জন এবং খেদমতকে নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করবে। উস্তাদের আদব রক্ষা করবে এবং তাঁর কথা মনযোগ সহকারে শুনবে। তাঁর উপদেশসমূহকে নিজের সফলতার চাবিকাঠি মনে করে তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে। এই কাজগুলো একজন ছাত্রকে অল্প সময়ে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছিয়ে দেয়। কিন্তু এই কাজগুলো কোনভাবেই যেন বাধ্য হয়ে কিংবা কোন অসতুদ্দেশ্যে না হয়। তখন এর দ্বারা উপকার তো দূরের কথা, তা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।

তালিমি যিন্দেগীতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ছাত্র ভাইদের সাথে ভালো ব্যবহার করা। একথা মনে রাখতে হবে, আমাকে একটি নির্দিষ্ট দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই ইজতেমাঈ পরিবেশে থাকতে হবে। এই দীর্ঘ সময়ের কিছু অংশ আমার দরসগাহের সাথীদের সাথে কাটবে, কিছু অংশ কামরার সাথীদের সাথে এবং আর কিছু অংশ গোটা মাদরাসার সাথীদের সাথে কাটবে। এই সকল অবস্থায় আপনি যদি মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, সকল সাথীদের সর্বপ্রকার হক আমি আদায় করবো। আমার পক্ষ থেকে কাউকে কোন প্রকার কষ্ট দিবো না এবং কারও জিনিস আমি তার অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার করবো না।

এই গুণসমূহ অর্জন করতে পারলে আল্লাহ তা‘আলা সকল ছাত্রের অন্তরে আপনার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিবেন। সকল ছাত্র আপনাকে ভিন্ন মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখবে। অন্যভাবে বললে এভাবে বলা যায়, আপনি যদি সাথী-সঙ্গীদের হক আদায়ে সচেষ্ট না হন, তাহলে তারা আপনার থেকে এভাবে দূরে থাকার চেষ্টা করবে, যেভাবে মানুষ হিংস্র ক্ষতিকর পশু থেকে বেঁচে থাকতে চায়। বাহ্যিকভাবে যদিও তারা আপনার সাথে সালাম-মুসাফাহা করবে, কিন্তু অন্তরে আপনার প্রতি ঘৃণা ও বিদ্ধেষ ভাব পোষণ করবে।

একজন ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গঠন করার জন্য এই সিদ্ধান্তে উপনিত হতে হবে যে, যখন যার সাথে আপনার সাক্ষাৎ হবে, তখন আপনি এমন পদ্ধতিতে বা এমন চরিত্রে তার সাথে সাক্ষাৎ করবেন, যেন সে পরবর্তীতে আমার সাথে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব থাকে। আপনার পাশে বসাকে পছন্দ করে। আপনার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটানোকে সৌভাগ্য মনে করে।

নবম কাজ মাদরাসার নিয়ম কানুন মানা। ইলমের পথে উন্নতির জন্য আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, নিজ প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন আন্তরিকভাবে মান্য করা। এটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট , কোন প্রতিষ্ঠানই নিয়ম কানুন ব্যতীত চলতে পারে না। এটাও পরিষ্কার কথা, নিয়ম-কানুন একটি ইজতেমাঈ যিন্দেগীর সুশৃঙ্খলের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই জন্য প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন মান্য করা পরবর্তীতে আরামদায়ক জীবনের একটি মাধ্যম। এর দ্বারা আলোকিত এবং সুশৃঙ্খল জীবন গঠন হবে। এটা মনে করবে, মাদরাসার সকল কানুন আমার কল্যাণের জন্যই করা হয়েছে। চাই সাময়িকভাবে তা আমার বুঝে আসুক বা না আসুক। আর যদি আমি ভালো হয়ে যাই তাহলে তো কানুনেরই প্রয়োজন নাই। কানুন তো করা হয় কোন অন্যায়ের কারণে। মাদরাসার নিযামুল আওকাত অনুযায়ী নিজের সময় পরিচালনা করবে। খাওয়া, ঘুম, দরসগাহে উপস্থিত সব নির্ধারিত সময়ে করে ফেলবে। নিজের দরসগাহ এবং থাকার কামরা সবসময় পরিষ্কার রাখাকে নিজের দায়িত্ব মনে করে নিবে। মাদরাসার উস্তাদ তো দূরের কথা, কোন কর্মচারীর সাথেও খারাপ ব্যবহার করবে না।

দশম কাজ আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, মাদরাসার তালিমি যিন্দেগীর আমাদের দীর্ঘ দিনের মুজাহাদা ও মেহনত এই জন্য যে, আমাদের মাঝে যেন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার যোগ্যতা তৈরি হয়।

সুতরাং ইবাদাত-বন্দেগী, দোয়া-মুনাজাত ও সর্বাবস্থায় রাসূল সা. -এর সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। রাসূলে কারীম সা. -এর মাসনুন যিন্দেগীর কোন অংশ যেন আমাদের কাছে অস্পষ্ট না থাকে এবং আমাদের কোন কাজ যেন সুন্নাতের খেলাফ না হয়। এই চেষ্টা অন্য সকল প্রচেষ্টার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাথে সাথে এই বিষয়টিও মাথায় রাখবে, আমরা মাদরাসায় অথবা মাদরাসার বাইরে নিজের ইবাদাত, মু‘আমালাত, মু‘আশারাত, আখলাক এবং খেদমতে খালক এর এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবো যে, মানুষ তাদের সন্তানদেরকে আমাদের দৃষ্টান্ত দিয়ে তারবিয়াত দিবে। তাদেরকে আমাদের মতো হতে উদ্বুদ্ধ করবে।

এই দশটি কাজের প্রতি গুরুত্ব দিলে ইলমে দীন অর্জনের পাশাপাশি ইলমের নূরও অর্জন হবে। নিজের জীবনটাও হবে অনুকরণীয়। আল্লাহ তা‘আলা সবাইকে আমল করার তাউফিক দান করুক। আমিন

লেখক : সহযোগী সম্পাদক : মাসিক আল কারীম
শিক্ষক : নুরপুর মাদরাসা, ফেনী।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ