শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বড় ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা আইফোনে ‘টাইপ টু সিরি’ ফিচার যেভাবে ব্যবহার করবেন  স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা আল্লাহকে পেতে হলে রাসূলের অনুসরণ অপরিহার্য: কবি রুহুল আমিন খান ঢাকাস্থ চাঁদপুর ফোরামের সেতুবন্ধন সভা অনুষ্ঠিত অর্থবহ সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়: প্রিন্সিপাল মোসাদ্দেক বিল্লাহ বিস্ময়কর হাফেজ শিশুর সঙ্গে শায়খ আহমাদুল্লাহ মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর জানাযা ও দাফন সম্পন্ন ১৬ টি বছর জুলুম-ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল মাদরাসার ছাত্ররা: ড. শামছুল আলম  ‘সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন’

হলি আর্টিজানের ১ বছর; জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে সারাবছর সোচ্চার আলেমরা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রোকন রাইয়ান: ২০১৬ সালের ১ জুলাই। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার দিন। বিদেশীদের কাছে রেস্তোরাঁটি ছিল খুব প্রিয়। সেদিনও যথারীতি আড্ডা দিচ্ছিলেন তারা। হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর হামলার জালে আবদ্ধ হবেন কে ভেবেছিল।

না ভাবলেও এমন আতঙ্ক হুট করে ছড়িয়ে পড়ল পুরো রেস্তোরাঁয়। সেটা পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এবং বিদেশেও ছড়িয়ে গেল। অস্ত্রসহ চার পাঁচজন জঙ্গি হোটেলটিতে ঢুকে ৩০/৩৫ জন লোককে জিম্মি করে ফেলল। রাতে চালানো হলো হত্যাকাণ্ড। সেই হত্যাকাণ্ডের ছবি ইন্টারনেটে চলে যাচ্ছিল জঙ্গি সংগঠন আইএস প্রধানদের কাছে। তারা ইন্টারনেটে প্রকাশ করছিলেন ছবিগুলো।

পুরো আতঙ্ক আর বিভিষিকাময় একটি রাত পার করে বাংলাদেশ। মুহূর্মুহূ গোলাগুলি আর আতঙ্ক বিরাজ করেছে প্রতি মুহূর্তে। শেষতক শনিবার সকালে জিম্মিদের উদ্ধারে কমান্ডো অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। তবে এর আগে শুক্রবার রাতেই গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন।

কমান্ডো অভিযানে ছয় জঙ্গি নিহত হয়। তারা সবাই বাংলাদেশের উচ্চ ফ্যামিলির সন্তান ছিলেন। সবাই ছিল উচ্চশিক্ষিত। কারো বাবা মা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক ও শিক্ষক। পরিচয় পাওয়ার পর হতবাক হয় পুরো দেশ। এমন ফ্যামিলির সন্তানরাও কি জঙ্গি হতে পারে?

বিভিষিকাময় সে রাতের ১ বছর পূর্ণ হলো আজ। সেদিনের পর পুরো বছর বাংলাদেশ জঙ্গি আতঙ্ক, পুলিশের অভিযান আর নানা কর্মসূচির ডামাডোলে পার করেছে। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আলেমরাও সোচ্চার ছিলেন জঙ্গিবাদের বিপক্ষে। বক্তব্য বিবৃতিসহ মিছিল মানববন্ধন ও পুস্তক প্রকাশনার মাধ্যমে মানুষকে সতেচন করেছেন তারা। আসুন কর্মসূচিগুলোর খোঁজ নিতে একটু পেছনে ফিরে যাই।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বেফাকের মানববন্ধন

কওমি মরদাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের উদ্যোগে ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন

গুলশান জঙ্গি হামলার পর সবচেয়ে দীর্ঘ মানববন্ধনের আয়োজন করে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড- বেফাক। ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মানববন্ধন রাজধানীর সদরঘাট থেকে শুরু হয়ে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ঐতিহাসিক এ মানববন্ধনের ব্যবহৃত হয় ২০ হাজার ফেস্টুন এবং ৫ হাজার ব্যানার। সকাল ১০ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক, ইসলামি রাজনীতিক ও বোর্ড কর্মকর্তাদের সবাই এ মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন। ইতিহাসের দীর্ঘ এ মানববন্ধন দৃষ্টি কারে সবার। ধর্মে উগ্রতা ও সন্ত্রাস নেই সেই ম্যাসেজ সমাজকে পৌঁছে দিতে দারুন কার্যকরি ছিল এ উদ্যোগ।

সোচ্চার ছিল সবগুলো ইসলামি রাজনৈতিক দল

গুলশান জঙ্গি হামলার পর মানুষকে সচেতন করে তুলতে ব্যাপক তৎপরতা দেখিয়েছে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো। ইসলামে জঙ্গিবাদের স্থান নেই এমন স্লোগানে প্রায় সময়ই মিছিলে মুখর ছিল রাজধানী ও সারাদেশের রাজপথগুলো। এসব মিছিল-মানববন্ধনে ধর্মপ্রাণ মানুষগণ ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছেন।

আলেমদের বক্তব্য, ইসলাম মানুষকে আদর্শ-চরিত্র গঠনে এবং মানুষের কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। এ ধর্ম হানাহানি, নৈরাজ্য-সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ইসলাম সমর্থন করে না। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সব সময়ই ইসলামি দলগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

গত বছর পুরোটাই নানা কর্মসূচি গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইসলামি দলগুলো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী অবস্থান তুলে ধরেছে। ২৯ জুলাই জুমার নামাজের পর ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে সন্ত্রাসবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সোচ্চার ভূমিকা পালন করে জঙ্গিবাদের বিপক্ষে। পর্যায় ক্রমে সংগঠনটির নেতৃত্বে সারাদেশে মসজিদে মসজিদে দোয়া ও সাধারণ মানুষকে সতেচন করতে ইমাম খতিবরা ভূমিকা রাখেন।

দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জঙ্গিবাদবিরোধী ওই কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সংগঠনটির ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর কমিটিকে সন্ত্রাসবিরোধী জনমত গঠনের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশও দেয়া হয়।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সে সময়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন খুৎবা নির্ধারণ করেও দিতে চেয়েছিল। তবে সেটি প্রত্যাখ্যান করেন আলেমরা। তাদের মত, আলেমরা শান্তির ধর্মের প্রচার করেন, এমন সন্ত্রাসবাদ আদৌ সমর্থন করেন না। তারা জুমার খুৎবায় আদিকাল থেকেই এসবের বিরোধিতা করে আসছেন।

ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টিসহ সব দলই বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জঙ্গিবাদের বিরোদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এর ফলে ইসলাম জঙ্গিবাদ ও প্রচলিত হামলা আক্রমণ সমর্থন করে না এটি সবার কাছে স্পষ্ট হয়।

লক্ষ আলেমের ফতোয়া

ধারাবাহিক জঙ্গি হামলার ঘটনায় দেশের মানুষ অতিষ্ট ও বিরক্ত। এর দোষারোপ আসছে আলেমদের দিকেও। অথচ আলেমরা সবসময়ই ছিলেন এমন উগ্র ও সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে। তাই আলেমদের ১ লক্ষ আলেমরে স্বাক্ষরসহ জঙ্গিবাদের বিপক্ষে ফতোয়ার উদ্যোগ নেন শোলাকিয়া ঈদগাহ’র ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ।

গুলশান জঙ্গি হামলার মাত্র ১২ আগে এই ফতোয়া প্রকাশ হয়। রাজধানীর রিপোর্টারর্স ইউনিটি মিলনায়তনে ১৮ জুন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উন্মোচন করা হয় এ ফতোয়া। তবে এর ব্যাপক আলোচনায় আসে গুলশান হামলার পর। লক্ষাধিক আলেমের এ ফতোয়া বাংলাদেশের আলেমদের অবস্থান স্পষ্ট করে সাধারণ মানুষ ও সরকারের কাছে। যেখানে প্রচলিত জঙ্গিবাদকে হারাম ঘোষণা করা হয়।

লক্ষাধিক আলেমের এ ফতোয়া বাংলাদেশ ছাড়াও জাতিসংঘ ও জাপানে মূল্যায়িত হয়।

দেশের সব মসজিদ থেকে জঙ্গিবাদের বিপক্ষে ভূমিকা

জুমাবাদ মসজিদের খুৎবায় ইমামগণ মানুষকে ইসলামের হুকুম আহকাম শেখানোসহ খারাপ মন্দকাজ থেকে বিরত রাখার শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে জঙ্গিবাদ, মাদক, চুরি ছিনতাইসহ যাবতীয় অন্যায় কাজের বিরোধিতা করেও বক্তব্য দেন তারা। নিয়মিক বয়ানের পাশাপাশি জুলাইয়ের পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে জুমার খুৎবা নির্দিষ্ট করে দেয়ার একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। যদিও সেটি কার্যকর হয়নি কিন্তু আলেম উলামা তাদের বয়ানে মানুষকে ব্যাপকভাবে জঙ্গিবাদের বিপক্ষে সচেতন করতে ভূমিকা রাখেন।

নিজের সন্তানের লালন পালনে বাবা মার দায়িত্ব কর্তব্য, সে কোথায় গেল কী করল তার খোঁজ রাখাসহ যাবতীয় কাজের তদারকির জন্যও উদ্বুদ্ধ করেন খতীবগণ। এভাবে সারা দেশের মসজিদগুলো জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যায় পুরো বছর।

খতীবদের অভিমত, প্রচলিত জঙ্গিবাদ মানুষকে বিপথগামিতার দিকে নিচ্ছে। ইসলাম এরকম উগ্রবাদ সমর্থন করে না। ইসলাম মানুষকে জীবনবোধের গল্প শেখায় যেখানে সবাই আকৃষ্ট হয় এর মহানুভবতা দেখে।

উলামা মাশায়েখ সম্মেলন

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইসলামী কানুন বাস্তবায়ন পরিষদ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় উলামা সম্মেলন। চলতি বছরের ৯ এপ্রিল ওই সম্মেলনে ইসলামী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে জঙ্গিবাদকে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দেন আলেমগণ।

নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘জঙ্গিরা বোমা মেরে নারায়ে তাকবির বললেই অনেকে মনে করে এটা ওলামারা করেছে। কিন্তু এই ধরনের স্লোগান দিয়ে আলেম ওলামাদের বদনাম করার জন্য ইহুদিরা এই ষড়যন্ত্র করছে।’

ইসলাম জঙ্গিবাদ পছন্দ করে না উল্লেখ করে তারা বলেন, ‘ইসলাম শুধু মানুষের নয়, সকল জীবের শান্তির জন্যই কাজ করে। ইসলাম জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ পছন্দ করে না। এরপরও গায়ে পড়ে যদি কেউ বলে ‘তুমি জঙ্গিবাদী’, তবে ইসলামের প্রশ্নে তৌহিদী জনতা দুর্বার আন্দোলনে নেমে পড়বে।’

ঢাকায় আরবের আলেম-ইমাম

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার জন্য চলতি বছর ঢাকায় আসেন সৌদি আরবের বিশিষ্ট দুই আলেম। এরা হলেন, মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. শায়খ মুহাম্মদ বিন নাসের আল খুজাইম ও পবিত্র মদিনার মসজিদে নববির ইমাম ও খতিব শায়খ ড. আবদুল মুহসিন কাসেম।

৬ এপ্রিল ১৭ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৪২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত উলামা সম্মেলনে তারা বক্তব্য রাখেন।

জঙ্গিবাদ বিষয়ে তারা বলেন, ‘নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা অনেক বড় অবরাধ। কোনো মুসলমানকে কোনো মুসলমান হত্যা করতে পারে না। এমনকি বিধর্মীকেও কোনো মুসলমান অন্যায়ভাবে হত্যা করতে পারে না। কোনো মুসলমান যদি কোনো মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে তাহলে তার জন্য জাহান্নাম নির্দিষ্ট রয়েছে। এ থেকে কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের দেশে বিধর্মীদেরও হত্যা করা যাবে না। তাদের জান ও মাল হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহ মুসলমানদেরকে দিয়েছেন।’


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ