জাতির আধ্যাত্মিক রাহবার উলামায়ে কেরামকে আমরা শুধু একজন দাঈ হিসেবেই চিনি। তাদের বিস্তৃত জীবনের বাইরের অংশটুকুই আমরা জানি। কিন্তু একজন বাবা হিসেবেও তারা যে ছিলেন অতুলনীয় এবং পরিবার গঠনেও যে তারা আমাদের আদর্শ হতে পারেন তা হয়তো কখনো ভেবে দেখিনি। আমাদের ভাবনার আড়ালে থাকা সেসব শ্রেষ্ঠ বাবাদের পাঠকের সামনে তুলে ধরছে ourislam24.com।
ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের ষষ্ট পর্বে থাকছেন সাবেক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জমিদার, মাসিক মদীনা’র সম্পাদক, সীরাত গবেষক মাওলানা মুহীউদ্দীন খান। প্রিয় বাবাকে নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন তারই ছেলে মাসিক মদীনার বর্তমান সম্পাদক আহমদ বদরুদ্দিন খান।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, আতাউর রহমান খসরু ।
আমার বাবা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। তার কাজের ক্ষেত্র ছিলো অনেক বিস্তৃত। তিনি অনেকগুলো সেক্টরে কাজ করতেন। তারপরও তিনি আমাদের নিয়মিত সময় দিতেন। আমরা তাকে সকালে ও রাতে খাবার টেবিলে পেতাম। তিনি আমাদের নিয়ে এক সাথে খেতেন। কেউ যদি খেতে নাও চাইতো, তবুও তাকে ডেকে পাশে বসিয়ে রাখতেন। এ দুই সময় তিনি পরিবারের সব সদস্যকে পাশে পেতে চাইতেন। তিনি খেয়াল করতেন সবাইকে। কারো যদি শরীর খারাপ থাকতো, মন খারাপ থাকতো তিনি চেহারা দেখে বুঝতে পারতেন এবং আলাদাভাবে কাছে ডেকে কারণ জানতে চাইতেন।
বাবা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে দরদি অভিভাবক ছিলেন। আমি নিজে অনেক সময় আব্বার সঙ্গে কোথাও যেতে ইচ্ছে না করলে বলতাম আমার শরীর ভালো নেই। তখন আব্বা বলতেন, তোমার কাজে যাওয়া লাগবে না। আমার পাশে বস। তিনি পাশে বসিয়ে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেখতেন। আমাদের প্রতি তার আদরটাই প্রবল ছিলো। এমনকি আমাদের বাচ্চাগুলোর স্কুলে অভিভাবক হিসেবে আমাদের পরিবর্তে তিনি নিজের নাম ব্যবহার করতেন।
শুধু আমি না পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের খোঁজ খবর তিনি আলাদা করে রাখতেন। কেউ কোনো বিপদে পড়লে, কারো অসুখ হলে তার মতো উদ্বিগ্ন হতে আমি আর কাউকে দেখি নি।
বাবা গত বছর রমজানে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর আমরা অনুভব করি, তার প্রতি পরিবারের কারো কোনো অভিযোগ নেই; বরং তার শূন্যতা সবাই অনুভব করে। এমনকি আমাদের সন্তান যারা আছে তারা এখনো দাদার কথা মনে করে কাঁদে। বলে দাদার মতো কেউ আমাদের আদর করে না। কেউ তার মতো আমাদেরকে জোর করে খাওয়াবে না।
পরিবারে আব্বা খুবই স্বাভাবিক একজন মানুষ ছিলেন। হাসি-কৌতুকও করতেন। কারো মন খারাপ দেখলে তিনি এমন কিছু বলতেন যাতে তার মন ভালো হয়ে যায়। হাসতো। নাতি-পুতির কাছে তিনি খুবই রসিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
মনের দিক থেকে বাবা খুবই উদার ছিলেন। শরিয়ত পরিপন্থী না হলে তিনি কোনো কাজে আমাদের বাধা দেন নি। যেমন তিনি তার প্রত্যেক সন্তান ও নাতি-পুতিকে বলেছেন তোমরা দীন শিক্ষা কর এটাই আমি চাই। কিন্তু কেউ যদি ভিন্ন ইচ্ছা পোষণ করলে তিনি বাধা দেন নি। শুধু বলেছেন, আল্লাহকে চেনো, আল্লাহর রাসুলকে চেনো এবং দীন মেনে চল। এরপর তুমি স্বাধীন।
বাবা অনেক স্বাধীনতা দিয়েছেন আমাদের। অনেক আদরও করেছেন কিন্তু তার আদর এমন মার্জিত ছিলো যে, শাসন হিসেবে তাই যথেষ্ট ছিলো। তার ব্যক্তিত্বের এমন প্রভাব ছিলো যে আমরা কেউ তার সামনে কিছু লোকাতে পারতাম না। মিথ্যে বলতে পারতামন না। কোনো অপরাধ করে তার মুখোমুখি হতে পারতাম না।
আব্বা আমাকে একটু বেশিই আদর করতেন মনে হয়। তিনি অন্যান্য ভাইবোনকে কখনো-সখনো শাসন করলেও আমাকে কখনো ধমকও দেন নি। একবার আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। তিনি সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে হাসতাপালে আসতেন। দুই রাকাত নামাজ পড়ে দোয়া করতেন, আল্লাহ! আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার সন্তানকে তুমি সুস্থ করে দাও।
আমি যখন মদীনায় পড়তাম আব্বা সেখানে গেলে ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে পাশে রাখতেন। হোটেলে তার সাথে থাকার ব্যবস্থা করতেন। আর দেশ থেকে চিঠি লিখতেন। এ আধুনিক যুগেও তিনি লম্বা লম্বা চিঠি লিখতেন। আমি বললে, বলতেন আমি যখন থাকবো না তখন এগুলো পড়ে দেখবা।
ঈদ-উৎসবে বাবা খুব উচ্ছ্বসিত থাকতেন। আমাদের সবার জন্য কেনাকাটা করা এবং ঈদ বখশিশ দেয়ায় তার বিশেষ আনন্দ ছিলো। আমার সন্তানরা যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে, তখনও আমি বাবার আগে তাদের ঈদের পোশাক ও বখশিশ দিতে পারি নি। উৎসবের দিনগুলোতে তিনি সবাইকে নিয়ে মেতে থাকতেন। চাঁদ রাতে তিনি রীতিমতো আড্ডা জমিয়ে দিতেন।
ঈদের সময় তিনি আমাদের সব যন্ত্রণা সহ্য করতেন। আমার মনে আছে, শৈশবে প্রায় সব ঈদেই বাবাকে সাথে নিয়ে মার্কেটে যেতাম। আমার পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত তিনি মার্কেটে মার্কেটে ঘুরতেন। কোনো কোনো ঈদে আব্বাকে আমি দুই তিন দিন পর্যন্ত মার্কেটে ঘুরিয়েছি। আব্বা হাসিমুখে ঘুরেছেন। শুধু একবার বলেছিলেন, তুমি যদি তোমার বাবার সময়ের মূল্য বুঝতে তাহলে আমার এতো সময় নষ্ট করতে না। কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। বললাম, আগে আমার কাপড় কিনে দাও তারপর তোমার ছুটি। আব্বা আমার সাথে সারা দিন ঘুরলেন।
স্বভাবতই সব পিতার মতো তিনিও সন্তানদের মাঝে নিজের ছায়া খুঁজতেন। আমরা যেনো তার মতো ভালো আলেম ও লেখক হই। এ ঘটনা বললে আমাদের নিয়ে বাবার স্বপ্নটা বোঝা যাবে। মদীনা ভার্সিটিতে পড়ালেখা শেষ করার পর ইউরোপের একটি মুসলিম সংস্থায় আমার চাকরি হয়। আব্বা সংস্থার কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লেখেন, আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম আমার সন্তান আমার পর আমার শূন্যতা পূরণ করবে, অথচ আপনারা বৃদ্ধ বয়সে তাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেন। এ চিঠি পাওয়ার পর তারা আমাকে দেশে ফেরৎ পাঠায়।
আমি শুধু এতোটুকু বলবো, আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বড় বাবা আল্লাহ আমাদের দান করেছিলেন।