বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


আব্বা আমাদের যা শেখাতে চাইতেন তা নিজেই করা শুরু করতেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জাতির আধ্যাত্মিক রাহবার উলামায়ে কেরামকে আমরা শুধু একজন দাঈ হিসেবেই চিনি। তাদের বিস্তৃত জীবনের বাইরের অংশটুকুই আমরা জানি। কিন্তু একজন বাবা হিসেবেও তারা যে ছিলেন অতুলনীয় এবং পরিবার গঠনেও যে তারা আমাদের আদর্শ হতে পারেন তা হয়তো কখনো ভেবে দেখিনি। আমাদের ভাবনার আড়ালে থাকা সেসব শ্রেষ্ঠ বাবাদের পাঠকের সামনে তুলে ধরছে ourislam24.com।

ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের চতুর্থ পর্বে থাকছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ ও আলেমে দীন, তওবার রাজনীতির প্রবক্তা হজরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ.। প্রিয় বাবাকে নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন তারই সুযোগ্য ছোট ছেলে  হাফেজ মাওলানা কারী শাহ আতাউল্লাহ। তার স্মৃতি, আবেগ ও অনুভূতিগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন এ এস এম মাহমুদ হাসান

বাবা হিসেবে হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন একজন আদর্শ বাবা বলতে যা বোঝায় তা। কিভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায় তিনি আমাদেরকে তা ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমাদের যথেষ্ট সময় দিতেন। স্বভাবে আব্বাজান ছিলেন একজন দুনিয়া বিমুখ মানুষ। সব সময় তার চেহারায় ভাব গাম্ভির্যতা থাকত কিন্তু তিনি যখন আমাদের সাথে মিশতেন, তখন তিনি নিজেকে হালকা করে ফেলতেন।

তার তারবিয়্যাত ছিলো বিস্ময়কর। তিনি আমাদের যা শেখাতে চাইতেন তা নিজের মাধ্যমে শেখাতেন। আমাদের চলাফেরা লক্ষ্য রাখতেন। যখন কিছু চোখে পড়তো তিনি বলতেন, এটা এভাবে করবে বা করবে না। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকেই তিনি আমাদের জীবনের অপরিহার্য বিষয়গুলো শেখাতেন। তাই বইপত্র থেকে যা শিখেছি আব্বার কাছ থেকে আরও অনেক বেশি শিখেছি।

তিনি সব সময় আমাদের আমলি, আখলাকি হওয়ার সবক দিতেন। সকল কাজে আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য বলতেন। তিনি ঘরে এসেই নির্দিষ্ট নামাজের জায়গায় প্রথমে নামাজ আদায় করতেন। তারপর ঘরোয়া কাজ করতেন। আম্মাজানকে যতটুকু সময় পেতেন ঘরের কাজে সাহায্য করতেন।

নিজেই নিজের কাজ সমাধা করার চেষ্টা করতেন। ঘরে এসে অহেতুক সময় নষ্ট করতেন না। হয় ইবাদাত করতেন, নতুবা আমাদের সময় দিতেন। আমরা ভাই বোন তার দৃষ্টিতে কোনো ভালো কাজ করলে উৎসাহ দেওয়ার জন্য পুরষ্কৃত করতেন।

শরিয়তের হুকুমের মধ্যে থেকে আমাদের আবদারগুলো পূরন করতেন। একবার আমি লাল লুঙ্গি পরতে চাইলাম, লাল চেকের লুঙ্গি না দিলে আমি মাদরাসায় যাব না বললে আব্বাজান সাথে সাথে বাজারে গিয়ে আমার জন্য লাল চেকের লুঙ্গি এনে দিয়ে আমাকে মাদরাসায় নিয়ে গেলেন।

বাবা হাসি-রসিকতাও করতেন। আব্বাজান দুধের সর দিয়ে তৈরি দুধ মালাই বেশি পছন্দ করতেন। আম্মাজান আব্বার জন্য দুধ মালাই আলাদা করে রাখতেন। যখন আব্বা খেতে আসতেন, তখন আমি ছোট ছেলে হিসেবে বাবার কাছে যেয়ে হাতের তালু পেতে মালাই চাইতাম, আব্বা আমাকে হাতের তালুতে মালাই খেতে দিতেন। আব্বা রসিকতা করে বলতেন এটা তো ঔষধ, আমি বলতাম: আমি ঔষধই খাব।

তিনি আমাদের লেখা পড়ার নিয়মিত খোজ খবর নিতেন। আম্মাজানের কাছে ঘরে বসেই আমরা সকল ভাই বোন কায়দা আমপারা শেষ করেছি। আমি আমপারা শেষ করলে আব্বাজান আমাকে মাদরাসায় হিফজ বিভাগে ভর্তি করে দেন।

আব্বাজান প্রায় সব সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতেন। শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও আব্বাজান নিয়মিত আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর রাখতেন। তাদের হক আদায় করতেন। নিজেই তাদের জন্য কেনাকাটা করতেন।

নিজেই সব ছেলে মেয়েদের ডেকে আতর লাগিয়ে দিতেন। আমাদের আনন্দ উপভোগের ক্ষেত্র তৈরী করে দিতেন। তবে শরিয়ত পরিপন্থী কোনো কাজ করার সুযোগ দিতেন না। আমরা ভুল করলে শাসন করতেন, পরক্ষণে কাছে ডেকে নিয়ে পরকালের কথা বলে বোঝাতেন।

তিনি আমাদের জন্য বাজার করতেন। তারপর সবাইকে একত্র করে বাজারের ব্যাগ খুলতেন। সবার জন্য কিছুনা কিছু আনতেন। আমাদের সকল ভাই বোনকে সব সময় খুশি রাখতেন। আমরা ভাই বোন এক সাথে খেতে বসতাম। বাবাও আমাদের সাথে খেতে বসতেন।

একবার আমি আর আমার বড় ভাই মিলে আব্বাজানের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। ধীরে ধীরে ব্যবসা বেশ বড় হয়ে গেলেও আব্বাজান তা জানতেন না। একদিন আব্বাকে ব্যবসায়িক অফিসে ঘুরতে নিয়ে গেলে অফিসে বসলেন। যখন আমরা কারখানা দেখালাম, তখন আব্বাজান গম্ভীর হয়ে গেলেন।

আব্বাজান বড় ভাইকে বললেন, তোমরা এত দুনিয়ামূখী হচ্ছো কেন? আমি তো দুনিয়া চাই না। আমি আখেরাত চাই। তোমরা দুনিয়ার জন্য এতো কিছু করবে না। আখেরাতের সামানা প্রস্তুত করো। তখন আব্বাজানের কথা মতো আমরা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলি।

তিনি দীনের দাওয়াতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতেন। তখন যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় তিনি আমাদের কাছে অনুপস্থিতির দিনগুলোতে যেনো ঠিক মতো পড়াশোনা করি এবং ভালো হয়ে চলি সে উপদেশ দিয়ে যেতেন।প্রতিবারই আমাদের থেকে বিদায় নিতেন।

তিনি পারিবারিক ও সামাজিক সব ক্ষেত্রেই দীনকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি দীনের মধ্যে থেকে পরিবারের সাথে মিশতেন, সময় দিতেন। পরিবারের সকলকে শিক্ষা-দীক্ষা, তালিম,তারবিয়্যাত নিজ তত্ত্বাবধানেই করতেন। তিনি একটি উত্তম ও আদর্শ পরিবার প্রতিষ্ঠার জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

আব্বাজন আমাদের শ্রেষ্ঠ গর্ব, শ্রেষ্ঠ রাহবার এবং জাতির জন্য অনুকরণীয় ।

পূর্বের পর্বগুলো-

বাবা হিসেবে শায়খ ছিলেন অতুলনীয়

বাবার মৃত্যুর পর কোনো বিরোধ লাগলে তা নিষ্পত্তির জন্য পারিবারিক কমিটি করে গেছেন

‘বাবার চিঠি পাঠানো দেখে ছাত্ররা বলতো এমন সন্তানপাগল লোক আর দেখিনি’


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ