বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


তুরস্ক ও এরদোগানের গোপন যুদ্ধ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর

‘সুলতান সুলেমান’ নামের একটি ড্রামা সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে চলছে বাংলাদেশের কোনো একটি টিভি চ্যানেলে। সিরিয়ালটিতে কী দেখানো হয়, তা দেখার কখনো সুযোগ হয়নি আমার। তবে এ সিরিয়ালটির সম্প্রচার নিয়ে একবার বেশ জলঘোলা হয়েছিলো, সে বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি। অন্যান্য কিছু টিভি চ্যানেল প্রতিবাদ করে বসে যে, বিদেশি এ সিরিয়ালটি বাংলাদেশে চলতে দেয়া যায় না। অতি দ্রুত এ সিরিয়ালটির সম্প্রচার বন্ধ করতে হবে... ইত্যকার দাবি-দাওয়া চলতে থাকে বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রী এমনকি সুশীল সমাজ থেকেও।

পরে জানা যায়, সিরিয়ালটি বাংলাদেশে এতোটাই জনপ্রিয়, যে সময় সিরিয়ালটি সম্প্রচার হয় সে সময় অন্যান্য চ্যানেলের রেটিং হু হু করে কমে যেতে থাকে। সুতরাং অন্য চ্যানেলওয়ালাদের আঁতে তো ঘা লাগাটা স্বাভাবিকি। যদিও শেষ পর্যন্ত সিরিয়ালটির সম্প্রচার বন্ধ করা যায়নি। সিরিয়ালটি বেশ জনপ্রিয়তা নিয়েই বর্তমানে বাংলাদেশে সম্প্রচারিত হচ্ছে।

আমার আলোচনার বিষয় ‘সুলতান সুলেমান’ নামক টিভি সিরিয়াল নয়, আমি বলতে চাচ্ছি সাংস্কৃতিক যুদ্ধ নিয়ে। এদেশে ইন্ডিয়ান চ্যানেল রাজত্ব করছে বেশ ঘটা করেই। পাখি, কিরণমালা, রাখী বা এ ধরনের নানা নামে ইন্ডিয়ান অসংখ্য বাংলা ও হিন্দি সিরিয়াল চলছে বাংলাদেশের কেবল টিভিতে। বাংলাদেশের নারীসমাজ তো বটেই, পুরুষসমাজেরও বড় একটা অংশ এসব সিরিয়ালের পাঁড় ভক্ত। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে খুব সহজেই ইন্ডিয়ার সংস্কৃতি আমদানি হচ্ছে। মানুষ এসব সিরিয়ালের মাধ্যমে পরিচিত হচ্ছে ইন্ডিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি, লৌকিক আচরণ, ভৌগলিক পরিচিতি, তাদের ধর্ম, দেব-দেবী এবং ইন্ডিয়াগত সকল কিছুর সঙ্গেই। চলছে দারুণ এক মাইন্ড গেম। ধীরে ধীরে ইন্ডিয়ার সংস্কৃতি ছাপিয়ে যাবে আমাদের। ঈদকে বানানো হবে ফেস্টিভ্যাল, রমজানকে এক্সাইটিং এক্সপেরিমেন্ট, শবে কদর বা শবে বরাত হয়ে যাবে প্রাসাদ খাওয়া আর আতশবাজি উড়ানোর ধুম। এ নিয়ে বিস্তর আক্ষেপ আরেকদিন বলা যাবে। আজকে সুলতান সুলেমান নিয়ে বলি।

‘সুলতান সুলেমান’ ড্রামা সিরিয়ালটি তুরস্কে তৈরি। তুরস্কের কলা-কুশলীদের দ্বারাই এর নির্মাণ ও চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। এখন কথা হলো, এ ড্রামা সিরিয়ালটি বাংলাদেশে ঢুকলো কীভাবে? যেখানে বাংলাদেশে দেদার চলছে ইন্ডিয়ান চ্যানেল সেখানে সুদূর তুরস্কের একটি ড্রামা সিরিয়াল কীভাবে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলকে আগ্রহী করতে পারে?

এর উত্তর জানতে হলে আমাদের আরেকটু সামনে আগাতে হবে।

দুই

এবার নিরেট কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে বাতচিত করা যেতে পারে। সবাই জানেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই তুরস্ক বিশ্ব রাজনীতি এবং আমাদের দেশীয় রাজনীতিতে হরহামেশাই আলোচিত হচ্ছে। এটা হওয়া প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন? এর উত্তর দিতে হলে কিছু সময়ের জন্য আমাদের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে উসমানি খেলাফত ধ্বংসের পর নানা দেশে নানাভাবে খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন হয়েছে। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের মোড়কে এদেশেও দুর্বার হয়ে উঠেছিলো খেলাফত আন্দোলন। মুসলিমদের অন্যতম রক্ষাকবচ মক্কা-মদিনার শাসকগোষ্ঠী আরবের আল-সউদ পরিবার নিজেদের বংশীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিভোর ছিলো। খেলাফতব্যবস্থা ধ্বংস হওয়াটা তাদের জন্য বরং শাপে বর হয়েই দেখা দিলো। তারা খেলাফত রক্ষায় আগুয়ান হওয়ার পরিবর্তে পরোক্ষভাবে খেলাফত আন্দোলনের নানা জায়গায় পেরেক ঠুকতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত খেলাফত আন্দোলন কোথাও আর স্থায়ী হলো না। খেলাফত যে মুসলিমদের একত্ববোধ, ভ্রাতৃত্ব এবং একতার এক অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয় শাসনব্যবস্থা- এই বোধই মুসলিম মানস থেকে দূর হয়ে গেলো।

সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব রিদওয়ান (যদিও আমরা তাকে রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান বলে ডাকি, কিন্তু তার বাস্তবিক নাম রিদওয়ান) নিজের নানা সাহসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিমের একপ্রকার হিরো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। ফিলিস্তিনের প্রতি তাঁর সাহসী পদক্ষেপ, মায়ানমার নিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, সিরিয়া এবং ইরাক বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান এবং সম্প্রতি আরব উত্তেজনায় কাতারের পক্ষ নিয়ে তিনি আবারও নিজের নায়কোচিত ইমেজকে মুসলিমদের কাছে উজ্জ্বল করে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

আল-কুরআনের হাফেজ প্রেসিডেন্ট তৈয়ব রিদওয়ান কতোটা গুড মুসলিম কিংবা সত্যিকার অর্থে কতোখানি মুসলিম ঐক্য কামনা করেন, সেসব তর্কের বিষয়। তবে তিনি যে বর্তমান মুসলিম মানসে একটি আশার আলো হয়ে আবির্ভুত হয়েছেন, এ কথা তর্কাতীত। সবচে বড় বিষয় হলো, তিনি সমগ্র বিশ্বের মুসলিম কমিউনিটিতে একজন আলোচিত ব্যক্তি হতে পেরেছেন এবং তুরস্ককে নতুন করে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই প্রেসিডেন্ট তৈয়ব রিদওয়ানের সফলতা। এবং এর মধ্যেই নিহিত আছে ইতিহাসের অনেক প্রশ্নের জবাব।

প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব রিদওয়ান কি আরেকবার খেলাফতের পথে হাঁটবেন? তিনি কি বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের প্রত্যাশী? তিনি কি আবার উসমানি সাম্রাজ্যের ছাইভস্ম থেকে তুলে আনতে চান খেলাফতের চাঁদ-তারা খচিত হেলালি নিশান?

এসব প্রশ্নের জবাব পেতেই আমাদের কাছে ‘সুলতান সুলেমান’ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যেমন ইস্যু সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কে সম্প্রচারিত আরেকটি ড্রামা সিরিয়াল ‘দিরিলিস এরতুগরুল’। তুরস্কে প্রবল জনপ্রিয় এ সিরিয়ালটিতে উসমানি (অটোমান) সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এরতুগরুলের সংগ্রামী জীবন এবং উসমানি সালতানাত প্রতিষ্ঠার আদ্যোপান্ত দেখানো হচ্ছে। বিশ্বের ৬০টি দেশে ডাবিং করে সম্প্রচার হচ্ছে এ সিরিয়ালটি। বাংলাদেশেও ‘সীমান্তের সুলতান’ নামে একুশে টিভির সৌজন্যে সম্প্রচারিত হয়েছে এ সিরিয়ালটি। এটিও বাংলাদেশে সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে চলেছে।

তিন

বলছিলাম সাংস্কৃতিক যুদ্ধ নিয়ে। এখন আর ঢাল-তলোয়ার বা বন্দুক-কামান নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ জয়ের রীতি নেই। এখন যুদ্ধ হয় তথ্য দিয়ে, সংস্কৃতি দিয়ে- দ্য ইনফরমেশন ওয়ার! উসমানি খেলাফতের অন্যতম সুলতান ‘সুলায়মান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট’কে আমাদের দেশের কয়জন মানুষ চিনতো? হাতেগোনা ইতিহাসের দু-চারজন বোদ্ধা পাঠক মাত্র। কিন্তু ‘সুলতান সুলেমান’ নামের এ ড্রামা সিরিয়ালটি কোটি কোটি মানুষের ঘরে গিয়ে জানিয়ে আসছে- এমন ছিলেন সুলতান সুলায়মান, এমন ছিলো তার সাম্রাজ্য, এভাবে তিনি যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনতেন জয়...। কিংবা কেই-বা জানতো উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উরতুগরুলের নাম? লাখে দু-একজন। কিন্তু ‘সীমান্তের সুলতান’ এসে প্রতিদিন বলে যাচ্ছে- এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো উসমানি সাম্রাজ্য, এভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিলো আজকের তুরস্ক, এই হলো অপরাজেয় কন্সটান্টিনোপলের বিজয়ী ইতিহাস! মানুষের ব্রেইন ওয়াশ হচ্ছে। পাখি আর কিরণমালার জায়গা দখল করে নিচ্ছে হুররম সুন্দরী কিংবা হালিমা খাতুন।

দিস ইজ দ্য গেম! ইনফরমেশন ভার্সেস ইনফরমেশন, কালচারাল ব্যাটল ভার্সেস কালাচারাল ওয়ার। যুদ্ধটা আপনাকে শুরু করতে হবে। এবং সেটা করতে হবে বিশ্বব্যাপী। যেমনটা করছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব রিদওয়ান। জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল এরতুগরুল–এর প্রতি তৈয়ব রিদওয়ানের ভালোবাসা গোপন থাকেনি। তিনি সরাসরি এর সেট পরিদর্শনে যান এবং হাত মেলান অভিনেতাদের সঙ্গে। মূলত রাষ্ট্রীয়ভাবে যে তুরস্ক একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু করেছে, সেটা তিনি বেশ ঘটা করেই বলে যাচ্ছেন। এই যুদ্ধকে তিনি কোথায় নিয়ে যাবেন, সেটাই হলো দেখার বিষয়।

চার

উসমানি (অটোমান) সুলতানদের নিয়ে সম্প্রতি বেশ কিছু বাংলা বই বেরিয়েছে। কিছু ফিকশন কিছু ননফিকশন বই। এসব বইয়ের লেখকগণ সোল্লাসে তাদের বইয়ে অটোমান সুলতানদের হেরেমের নানা সেক্সুয়াল কল্পকাহিনি বয়ান করেছেন। তারা সেসব বইয়ে ড়গড়গে বর্ণনা দিয়ে আলোকপাত করেছেন অটোমান সুলতানদের শোবার ঘরের, তাদের স্ত্রী এবং দাসীদের ওপর। এবং তারা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন- অটোমান সুলতান মানেই হেরেমের ভোগী বাদশাহ মাত্র। অথচ তারা একবারও উচ্চারণ করেনি হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, ভেনিস, পোল্যান্ডে কতোবার উচ্চকিত হয়েছিলো অটোমান নৌবাহিনীর পতাকা।

এই প্রবণতার মূল কারণ হলো, ইংরেজি সোর্স। যারা এসব গ্রন্থ লিখছেন তারা সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন ইউরোপিয়ান লেখকদের ঐতিহাসিক গ্রন্থাদি। যাদেরকে আমরা প্রাচ্যবিদ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। এসব ইউরোপিয়ানদের পূর্বপুরুষরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরাজিত হয়েছে উসমানি খেলাফতের অজেয় নৌবাহিনীর কাছে। পুরো পূর্ব ইউরোপ যুগ যুগ ধরে কব্জা করে রেখেছিলো উসমানি অ্যাডমিরালদের নৌবহর। এসব পরাজিত ইউরোপিয়ানরা কীভাবে লিখবে সেসব পরাজয়ের ইতিহাস? এ কারণেই তারা নানাভাবে উসমানি সুলতানদের হেরেমের কল্পকাহিনি দিয়ে তাদের চরিত্রে কালিমা লেপন করতে চেয়েছে। সুলতানদের চারিত্রিক সামান্য অধঃপতনকে কেন্দ্র করে তারা বিরাট বিরাট গ্রন্থ রচনা করেছে। পৃথিবীর সামনে অটোমান সুলতানদের পরিচিত করতে চেয়েছে স্রেফ ভোগবাদী লীলাকামী কিং হিসেবে। তারা ভুলেও কখনো বলেনি হাঙ্গেরি পতনের ইতিহাস, ভেনিসীয় নৌবাহিনীর পরাজয়ের ইতিহাস, পোল্যান্ড আক্রমণের দুর্ধর্ষ বিজয় কাহিনি। নিজেদের পরাজিত ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে মুসলিম কমিউনিটিসহ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তারা তুলে ধরেছে অটোমান সাম্রাজ্যের নানা অকিঞ্চিৎকর কল্পকাহিনি। আর সেসবই আমরা গোগ্রাসে গিলে লিখে ফেলছি হেরেম সমগ্র কিংবা সুলতানের হেরেমের মতো চটিকাহিনি।

আওয়ার ইসলামের খেদমত স্মরণীয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ

সেদিন ফেসবুকে এক উচ্চশিক্ষিত নারী উসমানি খেলাফত ও খলিফাদের নিয়ে সুলেখক তামীম রায়হান রচিত ‘সুলতান কাহিনি’ নামের অত্যন্ত ইনফরমেটিভ একটি বই পাঠ করে মন্তব্য করেছিলেন- ‘উসমানি’দেরকেই যে ‘অটোমান’ বলা হয় তাই এতোদিন জানতাম না...।’

সুতরাং প্রাচ্যবিদদের ইতিহাস পড়ে বেড়ে উঠা আমাদের বাঙালি লেখকগণ অতীত তুর্কি এবং বর্তমান তুরস্ককে কীভাবে মূল্যায়ন করেন, তার একটা পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায় বৈকি। সেখানে তারা ‘সুলতান সুলেমান’ আর ‘দিলিরিস উরতুগরুল’-এর বিশ্বব্যাপিতার সাংস্কৃতিক যুদ্ধের খবরে আঁৎকে উঠবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।

লেখক: কবি ও গল্পকার


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ