শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


ইসলামী ব্যাংক গভীর সংকটে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গভীর সংকটে পড়েছে। ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আলোচিত পরিবর্তনের চার মাসের মাথায় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন পরিচালকরা। একজন পরিচালককে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে- এমন অভিযোগের মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায়। এ দ্বন্দ্বের পেছনে অন্যতম কারণ ব্যাংকটির মালিকানায় আসতে একাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের তৎপরতা। এ ছাড়া তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলার অভাব, নিয়োগ-পদায়ন নিয়ে অনিয়মসহ নানা কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

একাধিক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি), সৌদি আরবের আল-রাজি গ্রুপ ও কুয়েত সরকারের মালিকানায় থাকা বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির খবরের পর থেকেই পরিচালকদের মধ্যে দলাদলি দৃশ্যমান হয়েছে। যদিও শেয়ার বিক্রির আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা এখনও আসেনি। পর্ষদের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে আইডিবির প্রতিনিধি জানান, ব্যাংকে তাদের সাড়ে ৭ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ৫ শতাংশ বিক্রি করতে চান। একইভাবে আল রাজি গ্রুপ ও কুয়েত সরকারও তাদের শেয়ারের একটি অংশ বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করে।

ব্যাংকের এ শেয়ার কেনাবেচার আলোচনার মধ্যেই নতুন পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান গত ১১ মে হঠাৎ ফেসবুকে বিশাল বিবৃতি দিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে একটি পক্ষ হুমকি দিচ্ছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, পর্ষদে মাইনাস-প্লাস ষড়যন্ত্র চলছে। এরপর থেকে অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়ে কয়েক দিন ধরে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান ও ভাইস চেয়ারম্যান আহসানুল আলম পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন।

ব্যাংকের বিভক্ত পরিচালকদের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আলাদা দুটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সার্বিক বিষয় তুলে ধরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হামিদ মিঞা একটি চিঠি পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে নিষ্ক্রিয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ অবস্থায় আগামীকাল মঙ্গলবার ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ সভাকে সামনে রেখে পরিচালকদের প্রকাশ্য বিবাদ নিয়ে ব্যাংকের কর্মী, শেয়ার ধারক ও আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, দেশের বড় দুই শিল্প গ্রুপ ব্যাংকটির শেয়ার কেনার জন্য পর্ষদের কয়েকজন পরিচালকের মাধ্যমে বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এই শেয়ার 'ব্লক ট্রেড'-এর (শেয়ারবাজারের দৈনন্দিন লেনদেনের বাইরে ক্রেতা-বিক্রেতার সমঝোতার মাধ্যমে কেনাবেচা) মাধ্যমে কিনতে চায় তারা। একাধিক স্বতন্ত্র পরিচালক এ যোগাযোগের কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

বড় পরিবর্তনের মুখে ইসলামী ব্যাংক

স্বতন্ত্র পরিচালকদের কেউ কেউ শেয়ার কিনতে আগ্রহী ব্যবসায়ী গ্রুপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনার নেপথ্যে থাকা আরেকটি গ্রুপ, যাদেরকে নিয়ে এ নাটকীয় পরিবর্তনের দিন থেকেই আলোচনা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ এ ব্যবসায়িক গ্রুপ এখন চাইছে ওইসব পরিচালক পর্ষদ থেকে সরে যাক অথবা নিষ্ক্রিয় থাকুক। কিন্তু নতুন করে যেসব ব্যবসায়িক গ্রুপ শেয়ার কিনতে চায়, তাদের ইন্ধনে ওই পরিচালকরা ব্যাংক থেকে সরে যেতে চান না।

আলোচনা রয়েছে, চট্টগ্রামভিত্তিক একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ এ ব্যাংকের মালিকানায় আসতে দীর্ঘদিন থেকে নামে-বেনামে ইসলামী ব্যাংকের বড় অঙ্কের শেয়ার কেনে। পরে গত জানুয়ারিতে এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণেই নতুন পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। আলোচিত এ পালাবদলে নতুন চেয়ারম্যান ও এমডির দায়িত্ব নেন যথাক্রমে আরাস্তু খান ও আব্দুল হামিদ মিঞা। তারা এর আগে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন দুটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডির দায়িত্বে ছিলেন।

এদিকে ব্যাংকটিতে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই সম্প্রতি দেড় শতাধিক কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন পরিচালকরা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এ নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে কোনো কোনো পরিচালকের। আবার মধ্যম ও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদায়ন নিয়েও পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছে বলে জানা গেছে।

আমানতের দিক থেকে দেশের বৃহত্তম ব্যাংকটির চলমান এ সংকট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না এলে তারা ইসলামী ব্যাংকের পরিচালকদের দ্বন্দ্বের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না। ব্যাংক থেকে সম্প্রতি তিনটি চিঠি এসেছে। যেখানে পরিচালকদের দ্বন্দ্ব নিয়ে কিছু বলা নেই। সাম্প্রতিক পর্ষদ বৈঠকে জাকাত তহবিলসহ নানা বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর আহসানুল আলমকে ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে জানানো হয়েছে।

বড় পরিবর্তনের মুখে ইসলামী ব্যাংক

এদিকে গতকাল রোববার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, 'ইসলামী ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে কিছুটা ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে, এটা ঠিক। তবে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায়নি যে, সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। তবে যদি ব্যাংকটির অন্যতম শেয়ারহোল্ডার আইডিবি কোনো অভিযোগ করে তখন হস্তক্ষেপের বিষয়টি ভেবে দেখা হবে। তিনি বলেন, 'বর্তমান চেয়ারম্যান অত্যন্ত যোগ্য। তার সঙ্গে এ বিষয়ে আমি কথা বলব।'

অর্থমন্ত্রী সৌদি আরবে আইডিবির সম্মেলন থেকে গত শুক্রবার দেশে ফেরেন। সেখানে আইডিবির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি 'না'-সূচক জবাব দেন।

গত ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আগের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, নির্বাহী ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরিয়ে নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন পর্ষদের দায়িত্ব গ্রহণের দিন ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় গ্রাহক এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ পর্ষদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠক নিয়েও ব্যাংকপাড়ায় নানা আলোচনা হয়। এস আলম গ্রুপ এই ব্যাংকের মালিকানায় আসছে- এমন আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে।

ইসলামী ব্যাংকে বড় পরিবর্তন ঘটে মূলত জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের সরিয়ে সরকার সমর্থকরা ব্যাংকটির পরিচালনায় আসার মাধ্যমে। অথচ সরকার সমর্থক ব্যক্তিদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। গত শনিবার আহসানুল আলমসহ সাত পরিচালকের পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, জোর করে কাউকে পদত্যাগ করানো হলে অনেক পরিচালক একযোগে পদত্যাগ করবেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী পরিচালকদের একজন সমকালকে বলেন, 'ব্যাংকটি দখলের চেষ্টা চলছে। পর্ষদে যা হচ্ছে তা ওই দখলকে কেন্দ্র করে।' কারা দখলের চেষ্টা করছে জানতে চাইলে বলেন, 'আমার পক্ষে এটা বলা ঠিক হবে না।'

সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান আহসানুল আলম গতকাল সমকালকে বলেন, 'বর্তমান চেয়ারম্যান ও এমডি ইসলামী ব্যাংককে বেসিক ব্যাংক বানাতে চাইছেন। চেয়ারম্যান জাকাত ফান্ডের ১৪৬ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছেন। এর তদন্ত চাই আমরা।' কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে নিয়ে প্রচুর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা চাকরি নিয়েছে তাদের মধ্য থেকেই এ ধরনের ৩৮ জন অভিযোগ করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, ব্যাংকটি দুই হাজার কোটি টাকা মুনাফা করার পরও মাত্র ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এভাবে কৌশলে শেয়ারের দাম কমিয়ে আরমডা বাজার থেকে ব্যাপক শেয়ার কিনেছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আরাস্তু খান সমকালকে বলেন, আইডিবির শেয়ার বিক্রি নিয়ে পর্ষদে আলোচনা হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ সংস্থাটি বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশে ইসলামী ব্যাংকিং চালু করতে বিনিয়োগ করে। পরে সেখানে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের শেয়ার ছেড়ে দেয়। অনেক সময় পুরো বিনিয়োগ তুলে নেয়। কম লভ্যাংশ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি আরও শক্তিশালী করতে সব পরিচালকের সম্মতিতে এবার লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর আহসানুল আলম বিভিন্ন বিষয়ে মিথ্যাচার করছেন। তার অভিযোগগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্বে ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা!

২০১৬ সালের আর্থিক বিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় গ্রাহক। এ গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ সীমা চার হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলিয়ে ঋণ নিয়েছে তিন হাজার ৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। বিভিন্ন সময়ে এস আলম স্টিল অ্যান্ড রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজকে এক হাজার ২৭৫ কোটি ৪৬ লাখ, এস আলম ভেজিটেবল অয়েলকে ৮৩৫ কোটি ৯১ লাখ ও এস আলম সুপার এডিবল অয়েলকে ৮৯৭ কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির শীর্ষ ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে রয়েছে- নোমান গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বিআরবি গ্রুপ, আনন্দ গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপসহ আরও কয়েকটি গ্রুপ।

১৯৮৩ সালে ৩৬ দশমিক ৯১ শতাংশ দেশীয় ও ৬৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ বিদেশি মালিকানায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাংকটি এশীয় অঞ্চলের প্রথম ইসলামী ব্যাংক। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা শরিয়াভিত্তিক লেনদেনে আগ্রহী হওয়ার কারণে অল্পদিনের মধ্যেই ব্যাংকটি জনপ্রিয়তা পায়।

তবে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাংকটি জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি পায়। জামায়াতে ইসলামীর নেতা যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। জামায়াতের উপদেষ্টা আবু নাসের আব্দুজ জাহেরও এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। সর্বশেষ জামায়াতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিনিধি মুস্তাফা আনোয়ার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন।

এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ