শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


আরিফুল্লাহকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গেলাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাসান আল মাহমুদ : দু-তলার গ্রীলে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদছে মুহাম্মদ আরিফুল্লাহ। তার কান্নাটা শব্দহীন। তবে তা যে অনেক কষ্টের, অনেক গভীরের তা তার চোখের পানি দেখে বোঝা যায়। ঘন ঘন চোখ মুছছে আর নিচে তাকিয়ে দেখছে মানুষের আনাগোনা। শুণছে আলেমদের আবেগময়ী ভেজা-সজল বক্তৃতা। আরিফুল্লাহ কে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গেলাম। পিঠে হাত রাখলাম।

আরিফুল্লাহ এবারের দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষার্থী। মালিবাগ জামিয়ার ছাত্র। তার প্রিয় উস্তাযে মুহতারাম গবেষক,লেখক মালিবাগ জামিয়ার মুহাদ্দিস আল্লামা ফাতাহ ইয়াহইয়া রহঃ এর জানাযা উপলক্ষে জামিয়ার মসজিদ,মাঠে লোকে লোকারণ্য। ধবধবে সাদাময় পরিবেশ। এসেছেন দেশের শীর্ষ আলেম,গুণী মানুষজন। তাঁরা মরহুমের স্বর্ণালী কর্ম নিয়ে আলোচনা করছেন। আরিফুল্লাহ সেসব শুনেই কি পরীক্ষার পড়া ফেলে কাঁদতে এসেছেন বারান্দায়?

সারাদেশে চলছে আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে দাওরায়ে হাদিস মাস্টার্স সমাপনি পরীক্ষা। রাজধানী ঢাকার জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের ৫৬ জন ছাত্র এবার দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা দিচ্ছে। আল্লামা আবুল ফাতাহ রহঃ এর ইন্তেকালের দিন ছিল বুখারী আউয়াল পরীক্ষা। তারপরের দিন হচ্ছে মুসলিম ২য় খন্ডের পরীক্ষা। জানাযা উপলক্ষের এই সময়ে (বাদ এশা) দাওরায়ে হাদিসের রুমগুলোতে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। আত্মস্থ করে যাচ্ছেন তারা পরীক্ষার পড়া। দু-একজন পরীক্ষার্থীকে কেমন বিষন্নতায় দেখলেও পড়ায় দেখা গেলো মনোযোগী। আরিফুল্লাহ সেসব মনোযোগী ছাত্রদের একজন। আরিফুল্লাহর মত আরো কয়েকজনকেও তো পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চোখ মুছতে দেখা যায়। ওইতো এক ছাত্রের চোখে পানি। আরিফুল্লাহদের কান্নাগুলোর চেয়ে হৃদয়টা আরো বেশি মুছড়ে দিলো আব্দুল্লাহ আল মামুনের কথা। মালিবাগ জামিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান 'কালকে আমাদের যে কিতাবের (মুসলিম সানী)পরীক্ষা সে কিতাব প্রিয় উস্তায ফাতাহ সাহেব হুজুর পড়িয়েছেন'।

আবুল ফাতাহ মোহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেব মালিবাগ জামিয়ার দাওরায়ে হাদিস ক্লাসে মুসলিম ২য় খন্ডের দরস দেন। সারা বছর পড়ালেন ছাত্রদের। শেখালেন কিতাবুল বুয়ু (ব্যবসা,অর্থনীতি অধ্যায়)সহ নানান বিষয়ে হাদিসের পাঠ। বছরের শেষ দিকে এসেই স্বাধারণত কওমি মাদরাসাগুলোর ক্লাসিক কিতাবগুলোর সমাপনি হয়। শেষ সবক,শেষ ক্লাস কওমি ছাত্রদের কাছে শুরু সবকের মতই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শেষ সবকে প্রত্যেক উস্তায অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও করেন। হাদিসের শিক্ষক মুহাদ্দিস আবুল ফাতাহ সাহেব শেষ সবকের আগের দিন বললেন 'ইনশাআল্লাহ কাল সবক শেষ করব'। কিন্তু কাল কালই থেকে গেল। হুজুর পড়ে গেলেন অসুস্থে। সে অসুস্থেই আজ তাঁর কিতাবের পরীক্ষার আগের রাতটি জানাযা নিয়ে এলো। তেমনটাই জানালো চোখ মুছতে মুছতে মালিবাগ জামিয়ার মুহাম্মদ আরিফুল্লাহ ও  আরেক দাওরা পরীক্ষার্থী ছাত্র ।
মালিবাগ জামিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষার্থী মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনকেসহ আরেকজন ছাত্রকে পাই একটি রুমে পড়তে। বাইরে জানাযা উপলক্ষে ধবল সাদায় পরিপূর্ণ। নূরানী পরিবেশ। আলেম,তালিবে এলেম,গুণিজনের ভিড়। এমন ভিড় ঠেলেই ঢুকে ছিলাম দাওরার রুমে। তার কাছে জানতে চইলাম 'আজকে যে বিষয় পড়তেছেন, সে বিষয় তো ফাতাহ সাব হুজুর পড়িয়েছেন তাই না? চোখের কোণে পানি এসে গেল মামুনের। এতক্ষণ যে পানিতে বাঁধ দিয়ে রেখেছিলেন। তা যেন ছুটতে শুরু করছে। তাকে শান্ত করে বললাম 'এই যে আজ যার জানাযা কাল তার পরীক্ষা দিচ্ছেন' বিষয়টা কিভাবে দেখছেন ? মামুন জানায় 'আসলেই বিষয়টা অনেক কষ্টের। অসহ্য রকম। এইতো আজকের পরীক্ষায় আমার কলম চলছিল খুব দ্রুত।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার প্রায় আধা ঘন্টা আগে হলের বাইরে থেকে আমাদের এক উস্তাযের ফোনে কথাবার্তার ধরণ শোনা গেল। উস্তায বলছিলেন 'কীহ! আবুল ফাতাহ সাহেব মারা গেছেন! ইন্নালিল্লাহ লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিউন'। আমার বুকটা তখন মুছড় দিয়ে উঠলো। আমার কলম যেন আর চলছিল না। অনেক কষ্টে পরীক্ষা শেষ করে এলাম। হুজুরের লাশ আনা হলে আমি উমায়ের সাদীসহ চারজন ছাত্র গোসল করালাম। সবকিছু এখন কেমন যেন লাগছে। কিন্তু কাল পরীক্ষা। তাও হুজুরের কিতাবের। বিষয়টা অনেক কষ্টের। না পারছি সইতে। একদিকে কাল পরীক্ষা মানেই প্রতিযোগিতা। আরেকদিকে আজকের প্রিয় হারানোর কষ্ট। পড়ছি দুটানায়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই নাহ! কষ্টকে বুকে চেপে রেখেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। আজকের কষ্টের কারণে পরীক্ষার পড়া ভালো করে না পড়লে সারা জীবন কষ্টে পড়তে হবে। তাই সারা জীবনের কষ্টের চেয়ে আজকের কষ্টটাকে বুকে চাপা দিলাম এই ভেবে যে, পরীক্ষা ভালো হলে হুজুরকে খুশি রাখতে পারব। খারাপ হলে আমি নিজেও কষ্টে পড়ব, হুজুরকেও কষ্টে পালাবো'।

জানাযা শেষে একই বিষয়ে
মালিবাগ জামিয়ার দাওরায়ে হাদিসের আরেক পরীক্ষার্থী মুহাম্মদ উমায়ের সাদীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান 'অনেক কষ্টেরই বিষয়টা। দমিয়ে রাখতে পারছি না কষ্টটা। তবে আমাদেরকে হুজুরের কিতাবে পরীক্ষায় ভালো করতেই হবে এই মানষিকতা সামনে রেখে আমরা বিচলিত হয়ে যাইনি। কষ্টকে বুকে চেপেই প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছি। এখন তো জানাযা শেষ হল, পড়তে যাচ্ছি এখন'।

এসএস/


সম্পর্কিত খবর