বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


বাংলাদেশের তাখাচ্ছুছ বিভাগের জন্য সবার সমন্বয় ও নীতিমালা জরুরি: মুফতি মোহাম্মদ আলী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাসান আল মাহমুদ
প্রতিবেদক, আওয়ার ইসলাম

বাংলাদেশে তাখাচ্ছুছ (উচ্চতর ইসলামি গবেষণা) শিক্ষা চর্চা ও প্রসারের নিরলসভাবে কাজ করছেন মুফতি মোহাম্মদ আলী। জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সমাপন করে দারুল উলূম দেওবন্দ ভারতে গিয়ে দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদিস পড়ে ওখানেই 'তাখাচ্ছুছ ফিল ফিকহীল ইসলামি'র উপর উচ্চতর গবেষণা করেন।

বাংলাদেশে এসে সাভারের জামিয়া মাদানিয়া রাজফুলবাড়ীতে প্রথমে শিক্ষকতা করেন। পরে শেখ জনরুদ্দীন দারুল কুরআন চৌধুরী মাদরাসা ঢাকার হাদিসের অধ্যাপনা করেন সাত বছর যাবত। মুহাদ্দিস হিসেবে দীর্ঘ নয় বছর অধ্যাপনা করেন জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকায়। তারপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একাধিক জামিয়া প্রতিষ্ঠান।

২০০৬ সালে জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা, ২০১০ সালে আল জামিয়াতুল ইসলামি ইদারাতুল উলূম আফতাবনগর ঢাকা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া নিজ জন্মভূমি নরসিংদীতে জামিয়া ইসলামিয়া হানীফিয়া বাঘীবাড়ি (১৯৯৩ সালে) , লালমনিরহাটে দারুল উলূম মাদানিয়া, আড়াইহাজারে মাদিনাতুল উলূমসহ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত আরো প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সম্প্রতি দাওরায়ে হাদিসের মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কওমি মাদরাসার ছয়টি বোর্ডের অন্যতম একটি বোর্ড 'বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়া বাংলাদেশ'র তিনি মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যতম সদস্য হিসেবে আছেন সমন্নিত কওমি বোর্ড 'আলহাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ' এর। অধ্যাপনা, খেতাবত, আত্মশুদ্ধিমূলক ইসলাহি বয়ান ছাড়াও তিনি লিখেছেন 'নামায মিরাজুল মুসলিমীন, মুমিনের সম্বল, (৩ খন্ডে) সত্যের দিশারী, সীরাতে রাসূলে আজম (অনুবাদ), ফতওয়ায়ে আলমগীরের আংশিক অনুবাদ, বিশ্বকোষ (প্রবন্ধ ও অনুবাদ) এবং ফতওয়া ও মাসায়িল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।

বাংলাদেশে তাখাচ্ছুছ শিক্ষা চর্চা ও প্রসারের স্বপ্নে তিনি দারুল উলূম থেকে ফিরেই 'ইদারাতুল উলূম' নামটি চয়ন করে রাখেন। দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নের স্বতন্ত্র পরিস্ফুটন ঘটতে শুরু করে ২০১০ সালে রাজধানীর আফতাব নগর জহুরুল ইসলাম সিটির সুবিশাল নিজস্ব জায়গায় 'আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া ইদারাতুল উলূম আফতাবনগর, ঢাকা' নামে।

জহুরুল ইসলাম সিটির একাধিক জায়গায় নিজস্ব ভবনে রয়েছে জামিয়ার শিক্ষা বিভাগ। মক্তব, হেফজ থেকে শুরু করে কিতাব বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস এবং তাখাচ্ছুছের ইফতা (উচ্চতর ইসলামী ফিকহ বা আইনশাস্ত্র) বিভাগ, তাখাচ্ছুছ ফিল হাদিস বিভাগ ও ক্বিসমুদ দাওয়া বিভাগসহ জনসাধারণদের উপযোগী বয়স্ক শিক্ষা বিভাগও রয়েছে।

২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, সাউথ আফ্রিকাসহ বিশ্বের বরেণ্য মুফতিগণের অংশগ্রহণে 'আন্তর্জাতিক ফেকহী সেমিনার' অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে জামিয়া ইদারার সেমিনার হলে।

মুফতি মোহাম্মদ আলী’র সভাপতিত্বে এই আন্তর্জাতিক ফেকহী সেমিনারে নির্দিষ্ট একই বিষয়ে তত্ত্বমূলক আলোচনা করেন আমন্ত্রিত মুফতিগণ। বাংলাদেশের তাখাচ্ছুছ চর্চা ও শিক্ষা প্রসারের একজন দায়িত্বশীল সেবক এই মুফতি মোহাম্মদ আলী নানা বিষয়ে কথা বলেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে।

আওয়ার ইসলাম: আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে আপনাকে 'তাখাচ্ছুছ' বিষয়ে আলোচনা পর্বে অভিনন্দন।

মুফতি মোহাম্মদ আলী: জ্বি, শুকরিয়া।

আওয়ার ইসলাম: কোন্ উপলব্ধি বা স্বপ্ন থেকে আপনি আফতাবনগরে তাখাচ্ছুছের প্রতিষ্ঠান খোলেন?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: ১৯৮৯ তে আমি যখন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে বাংলাদেশে আসি, তখন বাংলাদেশে তাখাচ্ছুছের প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করি। সে সময় তাখাচ্ছুছাতের যে প্রতিষ্ঠান করব তার একটা নামও নির্বাচন করি, যে নামটা আজকে আমার এই প্রতিষ্ঠানের নামে হয়ে গেছে। আর তা হচ্ছে ইদারাতুল উলুম। প্রথমে আমি তাখাচ্ছুছগুলো নির্ণয় করি।

তাখাাচ্ছুছ ফিল হাদিস, তাখাচ্ছুছ ফিল ফেকাহ, তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়া ওয়াল ইরশাদ, তাখাচ্ছুছ ফিল তাফসির ওয়াল আদব। আর সে সময়ে যারা পড়বে তাদের মধ্যে বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রফেসর আনোয়ার সালামসহ অন্যান্যরা ছিল, তো তারা উদ্যোগ নিয়েছিল যে, আমরাই পড়ব। তখন তাখাচ্ছুছের সে প্রতিষ্ঠান করার জন্য আমি বাসা ভাড়াও নিয়েছিলাম। কিন্তু সার্বিক অবস্থা মিলিয়ে তা চলতে পারেনি। পরিকল্পনা শুধু পরিকল্পনাই থেকে গেল। তাখাচ্ছুছের প্রতিষ্ঠান খুলতে না পারলেও আমি সাভারের যে জামিয়া মাদানিয়া রাজফুল বাড়ীয়া মাদরাসায় মুদাররিস হিসাবে ছিলাম সেখানে তাখাচ্ছুছের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা রাখতাম। এ বিষয়ে তখন কিছু লেখালেখি, গবেষণাও করেছি।

সে মাদরাসায় আমি মাসলা-মাসায়িলের দায়িত্বেও ছিলাম। যার ফলে ছাত্রদের আমি এ বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করেছি। তার দুই বছর পর ঢাকার চৌধুরী পাড়া মাদরাসায় দীর্ঘ সাত বছর অধ্যাপনা করি। এখানে আমি ফতোয়া প্রদানের যিম্মাদার ছিলাম। তারপর মালিবাগ মাদরাসায় দীর্ঘ নয় বছর অধ্যাপনা করি। এখানেও ফতোয়া প্রদানের কাজে একজন দায়িত্বশীল ছিলাম।

অধ্যাপনার এ সমস্ত বছরগুলোতে তাখাচ্ছুছ খোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি ও অনেকের সাথে আলাপ আলোচনা শেয়ার করলেও অন্যের প্রতিষ্ঠানে নিজের ইচ্ছামত খোলার কোনো সুযোগ সাধারণত হয়ে উঠে নাই। মালিবাগ মাদরাসা থেকে চলে আসার কিছুদিন পূর্বে তাখাচ্ছুছ ফিল ফিকহ বিভাগ হয়েছে। তারপর সেখান থেকে জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়ায় ছিলাম তখন সেখানে তাখাচ্ছুছ খোলার আলোচনা উঠলেও সকলের ঐক্যমত্যের অভাবে তা হয়ে উঠেনি। আল্লাহর রহমতে আলজামিয়াতুল ইসলামিয়া ইদারাতুল উলুম -যে নামে তাখাচ্ছুছের প্রতিষ্ঠান করার আমার স্বপ্ন ছিল, তা বাস্তবায়ন হয়, তখন আমি এখানে তাখাচ্ছুছের বিভাগ খোলা শুরু করি।

এখানে প্রথম বছরে তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়া খুলি। আমার জানামতে এর পূর্বে বাংলাদেশে তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়া ওয়াল ইরশাদ বিভাগটি কোথাও খুলেছে কি না তা জানা নেই। পরবর্তী বছর বাংলাদেশের অনেক অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে এ বিভাগটি খোলে। মূলত সেই ২৭ বছর আগে যে স্বপ্ন আমি লালন করেছিলাম- যা বাস্তবায়নে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আলোচনাও করতাম এবং তাখাচ্ছুছের জন্যই যার নাম দিয়েছিলাম 'ইদারাতুল উলুম'।

সেই ইদারাতুল উলুমের সাথে মাদরাসা ও জামিয়া অন্তর্ভুক্ত করে তার নামের আগে যুক্ত করি 'আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া' বাক্যটি। আমার পরিকল্পনা মূলত তাখাচ্ছুছ কে কেন্দ্র করেই ছিল।

আওয়ার ইসলাম: তাখাচ্ছুছের প্রয়োজনীয়তা আপনি কেন উপলব্ধি করলেন?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: দারুল উলুম দেওবন্দে থাকতেই আমি এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। বিশেষ করে ফরিদাবাদ জামিয়ার মুহাদ্দিস হজরত আব্দুল হাফিজ সাহেব দেওবন্দে দাওরায়ে হাদিস পড়াকালীন তিনি আমাকে বলেছিলেন 'তাখাচ্ছুছ ফিল ফেকাহ না পড়ে কিন্তু আসবা না'। আমাদের এই দেশে তাখাচ্ছুছের প্রয়োজনীয়তা এজন্য মনে করি যে, দাওরায়ে হাদিস পাস করলে স্বাভাবিকভাবে একটা ছাত্র কোনো বিষয়ে কথা বললে মনে হবে যেন 'কিছুই শিখি নাই'; এ বিষয়ে পড়াশোনা থাকলে মনে হত যে 'না আমি পারব'। আসলে এই তাখাচ্ছুছ অন্যের জন্য নয় নিজের জন্যেই জরুরি। সে সময় থেকে তাখাচ্ছুছের মূল্যায়ন, প্রয়োজনীয়তা আমার অন্তরেও ছিল এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে বলে আমি উপলব্ধি করি।

আওয়ার ইসলাম: বাংলাদেশে তাখাচ্ছুছের যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান আছে কি?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: কোনো পরিসংখ্যান আছে বলে জানা নেই।

আওয়ার ইসলাম: বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল ফতোয়া বিভাগ আপনার মতে কোন্গুলি?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: তা তো বলা বড় মুশকিল। প্রসিদ্ধ কিছু ফতোয়া বিভাগ রয়েছে যেমন, আব্দুর রহমান সাহেব, আব্দুল মালেক সাহেব, দেলোয়ার সাহেব, মিযান সাহেব, রাহমানিয়া, ফরিদাবাদের ফতোয়া বিভাগ ও আবু সাঈদ সাহেবের দারুর ফিকরিল ইত্যাদি ফতোয়া বিভাগ। এগুলো (ঢাকার) উলে­খযোগ্য হিসাবে বলেছি।

আওয়ার ইসলাম: তাখাচ্ছুছ বিভাগ খোলার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা আছে কি?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: এর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা হওয়া উচিত। তবে যেহেতু এ বিষয়টা বাংলাদেশের জন্য নতুন, তাই সামগ্রিকভাবে কোনো নীতিমালা এখনো হয়নি। প্রত্যেকে তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের জন্য নীতিমালা তৈয়ার করে থাকে। সকল প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা তো আছে, তবে এতে পরিপূর্ণ হয় না। তো, যারাই তাখাচ্ছুছ খোলেছেন সকলের সম্মিলিতভাবে যদি একটা নীতিমালা হয়, হওয়া উচিতও তাহলে সবাই এতে উপকৃত হবে।

আওয়ার ইসলাম: বাংলাদেশে তাখাচ্ছুছ প্রতিষ্ঠান এবং অনেক মুফতি রয়েছে। তো, সকলের সমন্নয়ে কোনো বোর্ড বা কমিশন হতে পারে কি না?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: এখানে দুইটা বিষয় আছে। একটা তাখাচ্ছুছাতের বোর্ড। আরেকটা হল মুফতিগণের বোর্ড। তাখাচ্ছুছের ব্যাপারে আমি বলব, যারা যারা তাখাচ্ছুছ খুলেছেন তাদের একটা সমন্নয় হওয়া উচিত। এটার উপলব্ধি আরো আগে থেকেই করতে ছিলাম। কিন্তু যেহেতু সবাই স্বাধীন। আমাদের পরস্পরের যোগাযোগটা খুবই কম। তখন ভাবলাম যে, একটা সমন্নয় শুরু করি। তো, সমন্নয় শুরু করার একটা প্রক্রিয়া আমরা শুরু করলাম এভাবে, কমপক্ষে আমাদের মন-মানসিকতার সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদেরকে প্রথম একত্রিত করি।

আপনি জানেন অবশ্যই বাংলাদেশের অবস্থা, সবাইকে যদি একত্রিত করে একদিন একটা কথা বলা হয়, তাহলে পরের দিন দেখবেন থাকবে না এখানে। তো, আমরা যারা আপন, একই মনের অধিকারী আছি, তাদেরকে এক করার জন্য আমরা বসলাম। যাতে আমাদের যে সকল তাখাচ্ছুছাত আছে, এদের একটা পরীক্ষা নিই। আর এতে আমাদের পরস্পরের একটা সমন্নয় হয়ে যাবে আর পরীক্ষা দেয়ার মধ্য দিয়ে তাখাচ্ছুছের একটা মানও বের হয়ে আসবে। তা এই চলতি বছর থেকেই শুরু হয়েছে। আমাদেও বেফাকুল মাদারিসিদ দীনিয়া বোর্ডের অধীনে। এতে পাঁচটা মাদরাসার তাখাচ্ছুছ বিভাগ অংশ গ্রহণ করেছে। খোলার ব্যাপারে তো সবাই স্বাধীন, এটা করেছি শুধু সমন্নয়নের জন্য।

আওয়ার ইসলাম: তাখাচ্ছুছ যারা পড়ায় এবং যারা পড়ে তাদের যোগ্যতা, মেধা কিংবা কোয়ালিটি কী রকম হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: একটা জাহেরি কোয়ালিটি আরেকটা হল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোয়ালিটি। একটা হল ভালো কাজ করা, মুমতায মার্ক থাকা। তবে যারা পড়াবেন তাদের জন্য এটা যথেষ্ঠ না। বরং যে যেই পনে (বিষয়ে) পড়াবেন সে সেই বিষয়ে দিলচসবি (মনোযোগী) হতে হবে। দিসচসবি যদি হয় তাহলে আলা মিয়ারের হোক, মুতাওয়াস্সিতাহ মিয়েরর হোক তার দ্বারা ছাত্রদের অনেক ফায়দা হয় ।

কারণ এমনও আছে যে, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার পরেও দেখা গেল যে, তাতে তার আগ্রহ নাই। তাহলে তো তার দ্বারা কোনো ফায়দা হবে না । যদি মেধা থাকে এবং আগ্রহ থাকে তাহলে নুর আলা নুর। মেধা থাকার সাথে সাথে তাকে সে বিষয়ে দিলচসবি বা আগ্রহ, মনোযোগী হতে হবে। কারো তাফসিরের দিকে থাকে, কারো আদবের দিকে থাকে, কারো ফেকাহের দিকে থাকে, কারো দাওয়ার দিকে থাকে। তো, যে যেই বিষয়ের প্রতি আগ্রহী সে সেই বিষয়ে পড়ালে এর দ্বারা ফায়দা হবে। অনেক সময় সে নিজেই নির্বাচন করে,অনেক সময় তার উস্তাদ তার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বলে যে, তোমাকে এ দিকটা ভালো হবে। যেমন অনেক উস্তাদ আছেন যে, হাদিসের বড় বড় কিতাব পড়ানোর তার সুযোগ আছে কিন্তু বলে যে, না আমি ফেকাহের উপরেই থাকি। অন্য দিকে যাওয়ার খেয়াল নাই। তাহলে বুঝা গেল যে, শাইখুল হাদিস হওয়ার তার সুযোগ আছে, সে সুযোগ বাদ দিয়ে ফেকাহ নিয়ে পড়ে আছে। বুঝা গেল তার ওই বিষয়ে মনোযোগ নাই।

ছাত্রের ক্ষেত্রেও তাই। এটা শুধু মার্কের উপর নির্ভর করে না। তবে মার্ক তো একটা থাকতেই হবে।

আওয়ার ইসলাম: তাখাচ্ছুছের জন্য সুনির্দিষ্ট সিলেবাস কি?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: অবশ্যই একটা সিলেবাস সুনির্দিষ্ট থাকা উচিত। সুনিদির্ষ্ট সিলেবাসের মধ্যে তাখাচ্ছুছ ফিল ফেকাহ-। এখানে আগে মৌলিক একটা কথা বলি, 'এই সিলেবাসও কাউকে ফেকাহের উপর দক্ষ বানাবে না। এটা শুধু দিক নির্দেশনামূলক'।

যেমন উদাহরণ স্বরূপ আমরা দারুল উলুম দেওবন্দে যেসব কিতাব পড়েছি, উস্তাদগণ কিতাব পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই কথা বলতেন যে, এই কিতাবগুলো পড়িয়ে তোমাদেরকে শুধুমাত্র গাইড লাইন দেয়া হয়েছে। সারা জীবন তুমি কী করবা। আমাকে পাঁচটা কিতাব যথা- ফতোয়া শামি, ফতোয়া আলমগিরী, বাহরুর রায়েক, ফাতহুল ক্বাদির ও বাদায়িউস সানায়ে দিয়ে বলে দিলেন যে, এই কিতাবগুলো যদি তুমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুতালা'য়া করতে পারো, তাহলে মনে করবা যে, কিছুটা তোমার হয়েছে। তো, একটা সুনির্দিষ্ট সিলেবাস থাকা উচিত, তবে তার উপরই যথেষ্ঠ মনে না করে ব্যাপক মুতালায়া এবং তামরিনের গুরুত্বটা বেশি দেয়া হয়।

আওয়ার ইসলাম: অনেকগুলো তাখাচ্ছুছের মধ্যে কোনটির গুরুত্ব আপনার বেশি মনে হয়?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: যেহেতু অনেকগুলো তাখাচ্ছুছ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়ার গুরুত্ব বেশি দেয়া উচিত।

আমাদের দেশে তাখাচ্ছুছ ফিল ফিকহের গুরুত্বটা বেশি দেয়া হয়। ইদানিং উলুমুল হাদিসকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দাওয়াটা শুরু হয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়ার গুরুত্বটা আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশি উপলব্ধি করি।

তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়ার অর্থ দুই ধরনের। একটা হল গবেষণামূলক। আরেকটা হল মাঠ পর্যায়ে কাজ করা। উম্মুল ক্বুরা, মদিনা ইউনিভার্সিটিসহ সারা বিশ্বের মুসলিম ভার্সিটিগুলোতে কুলি­য়াতুদ দাওয়া নামে একটা পাঁচ বছরের কোর্স হয়। তার থেকে কিন্তু কোনো দা'ঈ বের হয় না। শুধু গবেষণার উপরই ছেড়ে দেয়া হয়। তাই আমাদের দেশে এই দাওয়ার উপর গবেষণা করে মাঠ পর্যায়ে তা প্রয়োগ করতে হবে।

যারা অমুসলমান তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে মুসলমান বানানো। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশে যেসব অমুসলমান, খৃষ্টান পাদ্রী মুসলমাদের অমুসলমান বানিয়ে দিচ্ছে তাদেরকে মুবাল্লিগ বানিয়ে মাঠে ময়দানে ছেড়ে দেয়া।

তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়ার গুরুত্ব ঈমান আনার ব্যাপারে নয়, ঈমান রক্ষার জন্য খুবই জরুরি। কাদিয়ানি, খৃষ্টানরা যেসব মুসলমানদের অমুসলমান বানাচ্ছে, তাদেরকে মুসলমান রাখা অত্যন্ত জরুরি। তা শুধু আমাদের দেশের জন্য নয়। আমি সাউথ আফ্রিকায় একাধিকবার সফর করেছি। সেখানে বাংলাদেশী প্রায় দুই লাখ মুসলমানকে দেখেছি, তাদের দ্বীনি হালাত খুবই খারাপ। তাই তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়ার উপর অভিজ্ঞ লোকদের সেখানে পাঠানো উচিত। এ ব্যাপারে সেখান থেকে এক আলোচনায় আমাকে বলাও হয়েছে ‘তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়ার উপর কমপক্ষে ১৫ জন অভিজ্ঞ লোককে পাঠান। আমরা বাংলাদেশিদের উপর কাজ করতে পারছি না’। তাই সার্বিকভাবে আমি মনে করি তাখাচ্ছুছ ফিদ দাওয়ার উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত।

আওয়ার ইসলাম: তাখাচ্ছুছ শিক্ষার জন্য বছরের মতান্তর দেখা যায়। এ ব্যাপারে আপনার মত কি?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: তাখাচ্ছুছ হলো দিক নির্দেশনা লাভ করা। তাই এর জন্য এক বছরই যথেষ্ট। কিন্তু যদি বলা হয় যে, এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করা। তাহলে এর জন্য দুই-তিন বৎসর যথেষ্ঠ হবে না। বরং অভিজ্ঞ হওয়ার জন্য দীর্ঘ বছর মেহনত করতে হবে। (সংক্ষেপে বললে) তাখাচ্ছুছের জন্য এক বছর হওয়া উচিত বাকি অভিজ্ঞতার জন্য লেগে থাকা উচিত। যেটা সালমান মনসুরপুরী, আব্দুল্লাহ মাআরিফীসহ দেওবন্দ উলাম্য়ে কেরাম বলে থাকেন যে, আলাদা করে দুই বছর দরকার নেই, এক বছরই যথেষ্ঠ।

বাকি পাকিস্তানে যারা পড়েছেন যেমন আব্দুল মালেক সাহেব, মুফতি মিযান সাহেব। তাঁদের মতে এক বছর কিছুই হয় না। কমপক্ষে দুই বছর লাগবে।

আওয়ার ইসলাম: আপনি বললেন এক বছরই যথেষ্ঠ। কিন্তু এক বছর-দুই বছর পড়া তাখাচ্ছুছের ছাত্র এক সাথে দাঁড়ালে দুই বছর পড়াকেই প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। এই বৈষম্য কেন?

মুফতি মোহাম্মদ আলী: আসলে বিষয়টা এরকম নয়। এক বছর যে পড়ল তারও মূল্যায়ন আছে, দুই বছর যে পড়ল তারও মূল্যায়ন আছে। বিষয়টা ইস্তে'দাদের ব্যাপার। বছরের সাথে কোনোদিনই সংযুক্ত হতে পারে না। দুইজন এক সাথে দাঁড়ালে তাদেরকে যখন কোনো বিষয়ে সওয়াল করা হয়, তখনই বুঝা যায় যে, কার যোগ্যতা আছে আর কার নেই। কার কম আর কার বেশি। তাই তাখাচ্ছুছ বৎসরের উপর নির্ভর নয় বরং যোগ্যতা,ইস্তে'দাদের উপর নির্ভর করে।

আওয়ার ইসলাম: আওয়ার ইসলামকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মুফতি মোহাম্মদন আলী: আপনাকে এবং আওয়ার আসলামকেও ধন্যবাদ।

এটিও পড়ুন: বাংলাদেশের তাখাচ্ছুছের মান দেওবন্দ-করাচীর তুলনায় কোনো অংশে কম নয়

ফতোয়া বিভাগের জন্য নীতিমালা জরুরি: ফিকহবিদদের অভিমত


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ