বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


কোরআন এবং হাদিসের আলোকে মধুর গুনাগুন ও উপকারিতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মধু হল এক প্রকারের মিষ্টি ও ঘন তরল পদার্থ, যা মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস হতে তৈরি করে এবং মৌচাকে সংরক্ষণ করে। এটি উচ্চ ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি ভেষজ তরল ; এটি সুপেয়। বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতিতে এর ব্যবহারে চিনির চেয়ে এর অনেক সুবিধা রয়েছে। মানবদেহের রোগ প্রতিরোধে মধুর রয়েছে আশ্চর্য ক্ষমতা। কোরআন এবং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে মধুর নানান উপকারিতার কথা । চলুন জেনে নেই  কোরআন-হাদিসের আলোকে মধুর নানান গুনাগুন ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে কিছু উপকরিতার কথা।

”আপনার রব মৌমাছিদেরকে তার অন্তরে ওহী (ইংগিত) করেছেন যে, গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে।” ( নাহল:৬৮)

“.অতঃপর চোষণ করে নাও প্রত্যেক প্রকার ফল হতে, তৎপর তোমরা রবের সহজ সরল পথে চলতে থাকো; আর তার উদর হতে নানা বর্ণের পানীয় (মধু) নির্গত হয়; যাতে মানুষের জন্য আরোগ্য রয়েছে। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সমপ্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন’ (সূরা নাহল, আয়াত  ৬৯)।

আল-হাদীস
হযরত জাবীর (রা) হতে বর্ণিত আছে। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছেন, তোমাদের ওষুধগুলোর মধ্যে কোনগুলোতে যদি শিফা থেকে থাকে তবে সেগুলো হচ্ছে শিঙ্গা লাগানো, মধু পান এবং আগুনের দাগ নেয়া, যেটা যে রোগের জন্যে উপযুক্ত। তবে আমি দাগিয়ে নেয়াকে পছন্দ করি না। (সহীহ আল বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ৬১৭/২০৩২)

একদা এক লোক হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নিকট এসে তার ভাইয়ের পেটের সমস্যার কথা জানালেন। রাসূলে পাক সা: বললেন, তাকে মধু খাওয়াও। লোকটি দ্বিতীয় দিন এলেন। হুজুর সা: বললেন, মধু খাওয়াও। লোকটি তৃতীয় দিনেও এসে বললেন, হুজুর সা:, আমি তো তাকে মধু খাইয়েছি। হুজুর সা: বললেন, আল্লাহ তায়ালা সত্য বলেছেন; তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে। তাকে মধু খাওয়াও। তারপর মধু খাওয়ানোতেই তার পাকস্তলীর সমস্যা ভালো হলো (বুখারি)। হাদিসে আরো এসেছে, নবী করিম সা: বলেছেন, দু’টি আরোগ্য ব্যবহার করো; কুরআন এবং মধু (তিরমিজি, ইবনে মাজা, বায়হাকি)।

তাফসীর
৬৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ইবনে কাসীরে বলা হয়েছে যে, মধু সাদা হলদে লাল ইত্যাদি বিভিন্ন রঙ-এর হয়ে থাকে। ফল, ফুল ও মাটির রং এর বিভিন্নতার কারণেই মধুর এই বিভিন্ন রঙ হয়ে থাকে। মধুর বাহ্যিক সৌন্দর্য ও চমকের সাথে সাথে ওর দ্বারা রোগ হতেও আরোগ্য লাভ হতে থাকে। আল্লাহ্ এর দ্বারা বহু রোগ হতে আরোগ্য দান করে থাকে। এটা ঠাণ্ডা লাগা রোগের প্রতিষেধক। ঔষধ সবসময় রোগের বিপরীত হয়ে থাকে। মধু গরম, কাজেই ঠাণ্ডা লাগা রোগের জন্যে উপকারী। মুজাহিদ (রহ) এবং ইবনু জারীর (রহ) হতে বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা কুরআন কারীমকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কুরআনে শিফা রয়েছে। এ উক্তিটি আপন স্থানে সঠিক বটে; কিন্তু এখানে তো মধুর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ফলে এখানে মুজাহিদের (রহ) উক্তির অনুসরণ করা হয়নি। হ্যাঁ, তবে কুরআন শিফা হওয়ার বর্ণনা সূরা বনী ইসরাঈল : ৮২নং আয়াতে বলা হয়েছে। আল্লাহ পাকের এ বাণী ‘শিফাউন’ দ্বারা উদ্দেশ্য যে মধু তার দলীল হচ্ছে নিম্নের হাদীস ঃ

“হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে এসে বললো: ‘আমার ভাইয়ের পেট ছুটে গিয়েছে। অর্থাৎ খুব পায়খানা হচ্ছে।’ তিনি বললেন, তাকে মধু পান করিয়ে দাও। সে গেল এবং তাকে মধু পান করালো। আবার সে আসলো এবং বললো (এভাবে দু’বার) পুনরায় এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! তার পায়খানা তো আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বললেন, আল্লাহ সত্যবাদী এবং তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যাবাদী। সে গেল এবং তাকে মধু পান করালো। এবার সে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করলো। (সহীহ আল-বুখারী, ৫/২৯১, মুসলিম, তিরমিযী/৬০৭ পৃ, হাদীস নং ২০২৩)

মধুর চাক
মধু যেমন বলকারক খাদ্য এবং রসনার জন্য আনন্দ ও তৃপ্তিদায়ক, তেমনি রোগ-ব্যধির জন্য ও ফলদায়ক ব্যবস্থাপত্র।

হযরত ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তাঁর শরীরে ফোঁড়া বের হলে মধুর প্রলেপ দিয়ে চিকিৎসা করতেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে কি মধু সম্পর্কে বলেননি, ‘ফিহি শিফাউল লিন্নাছ’। -(তাফসীরে কুরতুবী, বরাতে ত. মাআরেফুল কোরআন, ৫ম/৩৫৭)

আম্মাজান হযরত আয়িশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মিষ্টি ও মধু খুব ভালবাসে তন। (সহীহ আল বুখারী, ৫/২৯০, হা.নং ৫২৭০, ৫/১৯৩, হা.নং ৫০২৮)

আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সা: সুন্নতে নিশ্চয়ই মানুষের জন্য উপকার নিহিত। মধুতে নিশ্চয়ই আরোগ্য রয়েছে। প্রাচীনকালে মিসরীয়, গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় ত্বকের ক্ষত চিকিৎসায় ওষুধ হিসেবে মধু ব্যবহারের কথা জানা যায়। ইদানীং বিভিন্ন গবেষণায় মধুর উপকারিতার কথা প্রমাণিত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মধু গলার খুসখুসে ভাব কমায়। লবণ-পানির সাথে সামান্য মধু মিশিয়ে গড়গড়া করলে এ ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়। মধু কাশি কমায়। শিশুদের শ্বাসনালীর সংক্রমণে কাশির চিকিৎসায় মধু কার্যকর (সূত্র : Arch Pediatr Adolesc Med. 2007; 161: 1140-1146, 1149-1153)। মধু মুখের ভেতর রোগজীবাণুর বংশ বৃদ্ধি কমাতে সহায়ক। মুখের ঘায়ে মধু কার্যকর। পাকস’লীর অ্যাসিডিটি ও আলসারে মধু উপকারী। ত্বকের ক্ষত, কাটা বা পোড়ায় মধু খুবই কার্যকর।

মৌ চাকে মৌ পোকা
মধুতে রয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ ফ্রুকটোজ, ৩১ শতাংশ গ্লুকোজ, ১৭ শতাংশ পানি, বাকি অন্যান্য উপাদান। গ্লুকোজ আর ফ্রুকটোজের মিশ্রণে মধুর অসমোলারিটি খুব বেশি। মধুর বেশি অসমোলারিটির কারণে রোগজীবাণু বাঁচতে পারে না। মধুর গ্লুকোজ অক্সিডাইজড হয়ে গ্লুকোনিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। মৌমাছির শরীর থেকে আসা এক পাচক রসের মাধ্যমে মধুতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড তৈরি হয়। এই হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ত্বকের ক্ষতে রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর। মধুর বেশি অসমোলারিটি, গ্লুকোনিক অ্যাসিড ও হাইড্রোজেন পার অক্সাইড- সবই রোগজীবাণু ধ্বংসে সহায়ক।

মধু ত্বকের ক্ষতের প্রদাহ কমায়, ফোলা কমায়। ত্বকের ক্ষতে মধুর পাতলা প্রলেপ ক্ষতে রোগজীবাণুর বৃদ্ধি রোধ করে, প্রদাহ-ব্যথা-ফোলা ইত্যাদি কমায়, ত্বকের সাথে ব্যান্ডেজের লেগে যাওয়া রোধ করে। ঘা শুকাতে সহায়তা করে। ত্বক সামান্য পুড়ে গেলে তাতে সাথে সাথে মধুর প্রলেপ দিলে ফোসকা পড়ে না বা ব্যথা হয় না। পোড়ার দাগ কমাতেও সহায়ক মধু। এক কথায়, ত্বকের ক্ষত চিকিৎসায় মধু খুবই কার্যকর বিভিন্ন ফাইটোকেমিক্যালের উপসি’তির কারণে মধুর আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্ষমতা। শরীরে প্রতিনিয়ত উৎপন্ন হওয়া ক্ষতিকর ফ্রি রেডিক্যাল দূর করতে পারে মধু।

মধু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এক কথায় শরীরকে সুস্থ রাখতে, রোগ প্রতিরোধ করতে ও রোগ নিরাময়ে মধু খুবই কার্যকর। বিজ্ঞানময় কুরআন ও হাদিসে মধুর উপকারের কথা বহু আগেই বর্ণিত হয়েছে। সব পানীয়ের উপাদানের মধ্যে মধু সর্বোৎকৃষ্ট।

রাসায়নিক পরীক্ষায় জানা যায় যে, মধুতে আট প্রকার রাসায়নিক পদার্থ আছে। এর প্রধান উপাদান হলো সুগার বা চিনি। যার ভিতরে লেড উলোজোন ৩৯%, ডেকট্রোজ-৩৯%, সালটোজ – ৯%, প্র“কোজ-১%, ও সুক্রোজ-সামান্য পরিমাণে থাকে।

ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৪, বি-৬, সি, ই, কে, ও ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ বিদ্যমান। এটি স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি করে এবং শোষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রযুক্তির সাহায্যে মধু চাষ
মধু আন্তিক রোগে উপকারী, বিশেষ করে দুর্বল শিশুদের মুখের ভেতর পচনশীল ঘায়ের জন্য খুবই উপকারী।এটা সর্দি,কাশি, টাইফয়েড জ্বর, নিউমোনিয়া ও আমাশয়ে উপকারী। ত্রিফলার (আমলকী, হরিতকী ও বহেরা) সাথে একত্রে মিশিয়ে ব্যবহার করলে চুলপড়া বন্ধ হয়। টনসিলের প্রদাহ, গলা ফুলা রোগ আরোগ্যের জন্য মধুর বিকল্প নেই।

সাউথ আফ্রিকার মেডিক্যাল গবেষকরা দেখিয়েছেন, পোড়া ও ক্ষত পরিস্কার করতে মধুর জুড়ি নেই। এতে সংক্রমণের আশঙ্কা কমে, এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। সাউথ আফ্রিকার গবেষকরা আরো দেখিয়েছেন, মধু ডায়রিয়ার জীবানু নষ্ট করতে সাহায্য করে। গলা ব্যথা ও গলায় ক্ষত চিকিৎসায় মধু অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত।

শরীরের অতিরিক্ত কোলেষ্টেরলের কারণে হতে পারে নানা সমস্যা। এতে হৃদরোগের কারণ এই কোলেষ্টেরল। এটার মাত্রা কমাতে মধু বিশেষভাবে কার্যকর। পাশাপাশি খেতে হবে ফলমূল, সবজি।

মানবদেহের জন্য যত প্রকার ভিটামিন আবশ্যক তার শতকরা ৭৫% ভাগ মধুর মধ্যে বিদ্যমান। চিকিৎসাশাস্ত্র মতে মধু অপেক্ষা শক্তিশালী ভিটামিন যুক্ত কোন পদার্থ পৃথিবীতে আর সৃষ্টি হয়নি। তাই মধু অন্যান্য দ্রব্যের সাথে মিশ্রিত করে সেবন করলে ঐ সকল দ্রব্যের গুণ ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।

মধুর একটি বিশেষ গুণ হল, এটা যৌনশক্তিকে বৃদ্ধি করে, স্থিতিশীল ও অটুট রাখে। নিয়মিত মধু সেবী ব্যক্তির কখনও যৌন দূর্বলতা আসে না।

যক্ষা, বহুমূত্র, হৃদরোগ, ব্লাডপ্রেসার, বাত ইত্যাদি রোগে নিয়মিত মধু সেবন করায় উপশম হয়।

এসএস/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ