শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


যুগে যুগে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার: একটি সমীক্ষা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম

এক. মানুষে মানুষে বৈষম্য আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। বিভিন্ন পেশা, শ্রেণি, ভাষা, লিঙ্গ, বর্ণ নানা কারণে এই বৈষম্য। ইসলামপূর্ব যুগে শ্রমজীবী মানুষ ছিল সবচেয়ে উপেক্ষিত। অনেকটা বাজারের পণ্য হিসেবে গণ্য হতো তারা। সমাজে চালু ছিল দাসপ্রথা। হাটবাজারে গরু-ছাগলের মতো তাদেরও বেচাকেনা হতো। কাজ করার সময় তাদের পায়ে শিকল পরিয়ে দেওয়া হতো, যেন পালিয়ে যেতে না পারে। প্রাণ রক্ষা ও পরিশ্রমের উপযোগী রাখার জন্য যতটুকু খাদ্যের প্রয়োজন দাস-ভৃত্য বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য শুধু সেই পরিমাণ খাবারের ব্যবস্থাই থাকত বর্বর সমাজে। কাজে সামান্য ভুলের অপরাধে পশুর মতো চাবুক অঘাত সইতে হতো তাদের। বাসস্থানের জন্য ভালো কোনো ব্যবস্থা করা হতো না। গোয়ালের গরু বা আস্তাবলের ঘোড়া-গাধার সাথেই হতো তাদের রাত-যাপন। অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণের অধিকারটুকুও ছিলো না মেহনতি মানুষের।
তলোয়ার ও বর্শা হাতে দাসদেরকে প্রভুর আঙিনায় লড়াই করার জন্য লাগিয়ে দেয়া হতো। খেলার চরম মুহূর্তে কোনো দাস তার ভাইকে হত্যা করলে মালিকশ্রেণি দর্শক হাততালি, অট্টহাসি ও চরম আনন্দ-উল্লাসে হত্যাকারীকে বাহবা দিতো। প্রভুরা দাসদের নির্দয়ভাবে হত্যা ও শোষণ-শাসন করার একক অধিকার লাভ করেছিলো। সব দেশে সব যুগে ছিলো একই চিত্র। প্রাচীন মিসরে তো রাজা-বাদশাহদের মৃত্যু হলে দাস-ভৃত্যদেরকে হত্য করে পিরামিডে তাদের সঙ্গী করে দেয়া হতো। মৃত্যুর পর রাজা-বাদশাহদের সেবার জন্যই প্রচলিত ছিলো এই জঘণ্য প্রথা।

দুই. অন্যদিকে ইসলামের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হওয়ার পর অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদনের সব উপায়-উপকরণ পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। ফলে তারা সর্বহারা মজুর জনতার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের মনিবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং তাদের নিজেদের দাস মনে করতে থাকে। মৌলিক চাহিদাটুকু লাভ করার জন্য সে সমাজব্যবস্থায় শ্রমিকের কী মূল্য দিতে হয়েছে তার একটি খ-চিত্র দেখতে আসুন ফিরে যাই ১৮৮৬ ঈসাব্দের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।

“১৮৮৬ সালের ১ মে। সর্বোচ্চ আটঘণ্টা শ্রমসহ শ্রমিকদের অন্যান্য মৌলিক দাবি আদয়ের লক্ষ্যে শ্রমিক সংগঠন এবং প্রতিবাদী শ্রমিকদের আহবানে আমেরিকাজুড়ে চলছে হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি। টানা তিনদিনের মিছিল আর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে আমেরিকার শিকাগো শহর। ৪ মে সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিছিল বের করে আন্দোলনত শ্রমিকরা। শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেট চত্বরে চলতে থাকে বক্তৃতাপর্ব। শেষে ভাষণ দেন আমেরিকার সমাজ-সংস্কারক ও শ্রমিক-নেতা স্যামুয়েল ফিন্ডেন। রাত সাড়ে দশটার দিকে তার বক্তৃতা শেষ হতেই এগিয়ে আসতে দেখা যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। পুলিশের এগিয়ে আসার পথে বিস্ফোরিত হয় ঘরে তৈরি একটি বোমা । এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন একজন পুলিশসদস্য । আহত হন আরও ৬৬ জন। তাদের ছয়জন পরবর্তী সময়ে মারা যান। বোমা বিস্ফোরণের পর উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হওয়ার কথা পুলিশ দাবি করলেও ঐতিহাসিকদের মতে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছিলো শুধু প্রশাসনের পক্ষ থেকেই। নিহত পুলিশ সদস্যেরাও মূলত নিজেদের গুলিতেই মারা যান। মুহূর্তেই ‘হে’ মার্কেট চত্বর ফাঁকা হয়ে গেলেও রক্তস্নাত রাস্তায় পড়ে থাকে শ্রমিকের লাশ।

চারজন শ্রমিক নিহত এবং ৬০ জন আহত হওয়ার কথা প্রকাশ করা হলেও প্রকৃত সত্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। শুরু হয় প্রহসনের তথাকথিত বিচার-কার্য। আন্দোলনকারী শতাধিক শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়। সাতজন শ্রমিককে পুলিশ হত্যায় দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। একজনের হয় ১৫ বছরের কারাদ-।

আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ইলিনয়ের গভর্নর রিচার্ড জেমস প্রতিবাদী শ্রমিক নেতা ফিন্ডেন এবং স্ত্রোয়ারের মৃত্যুদ- মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেন। এরপর শুরু হয় বাকি পাঁচজনের মৃত্যুর প্রহর গোনার পালা। কিন্তু তখনই ঘটে আরেক বিষাদময় ঘটনা। লিঞ্জ নামের এক সাজাপ্রাপ্ত শ্রমিক কৌশলে চুরুটের মতো দেখতে বিশেষ ধরনের হাতে তৈরি বোমা সংগ্রহ করেন। চুরুটের মতোই তা মুখে পুরে তিনি সেটি বিস্ফেরণ ঘটান। মুহূর্তেই লিঞ্জের মুখের বিরাট অংশ আলগা হয়ে খসে পড়ে। তারপরও ছয় ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন লিঞ্জ। পরদিন ১১ নভেম্বর ১৮৮৭ ঈসাব্দে এঞ্জেল, ফিসার, পারসন্স এবং স্পাইসকে নেওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে।”

তিন. শ্রমিক শ্রেণির রাজ্যত্ব কায়েমের আবেগময় বাণী শুনিয়ে, লাখো মানুষের রক্তস্নাত সমাধির উপর সমাজতন্ত্র নামের শ্রমিকদের তথাকথিক যে স্বপ্নরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে যে শ্রমিক শ্রেণির যাবতীয় সমস্য আরো প্রকট হয়ে উঠেছিলো তা বলাই বাহুল্য। একজন ভুক্তভোগী শ্রমজীবী মানুষের মুখে শোনা যাক তথাকথিত স্বর্গরাজ্যের শ্রমিক-স্বাধীনতার একটি গল্প।

“আমাকে ধরে এনে ঘন্টার পর ঘন্টা তীব্র ভোল্টেজের বাল্ববের দিকে পলকহীন নেত্রে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। আলোর তীব্রতায় আমার চোখগুলো ঝলসে যাচ্ছিল, কিন্তু চোখের পানি ফেললে কিল-ঘুষির বর্ষণ ও বুটের আঘাত ছিল অবধারিত। এভাবেই বাহাত্তরটি ঘণ্টা আমার উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়ে যায়। এর পর মাঝে মাঝে নুনে পোড়া খাদ্যের নামে অখাদ্য পরিবেশন করা হতো। পানির অভাবে লাগাতার কয়েক দিন পর্যন্ত পিপাসায় কাতর থাকতাম আমি। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে গেলেও একফোটা পানি মুখে তুলে দেওয়ার করুণাটুকুও ছিলো না ওদের। শুধু কি তাই ? কষ্ট বাড়ানোর জন্য দেখিয়ে দেখিয়ে পানি পান করতো ওরা। একপর্যায়ে হাত-পা বেঁধে উল্টো করে চল্লিশ ঘন্টা পর্যন্ত লটকে রাখা হয় আমাকে। শরীরের লোমগুলো একটি এাকটি করে এমন নিষ্ঠুরভাবে তুলে ফেলা হয় যে চামড়া পর্যন্ত উঠে যায়। একদিন সেই মানুষরূপী কসাইগুলো আমার বস্ত্র হরণ করে বিবস্ত্র শরীরে বেদম প্রহার করতে থকে। এরপর মেঝের উপর চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে দুজন আমাকে মাটির সাথে চেপে ধরে রাখে এবং তৃতীয় পশুটি আমার ঊরুদেশ এবং অন্যান্য স্থানে উপর্যুপরি চাবুকের আঘাত করতে থাকে। সহ্য করতে না পেরে বেহুশ হয়ে যাই আমি। কয়েক দিন পরে হুশ ফিরে এলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করি। হাসপাতাল থেকে বিদায় নেয়ার পর দাম্পত্য জীবন চালিয়ে নেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।”

চার. বর্তমানে শ্রমিক বলতে সাধারণত কর্মচারী, দিনমজুর, মেথর, কুলি, তাঁতী, মুচি, জেলে, ধোপা, রিকশাচালক, গাড়িচালক ও হেলপার প্রভৃতি পেশাজীবীকে বোঝায়। তারা সর্বকালেই সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত। সমাজের মানুষ বরাবরই তাদেরকে নিচু শ্রেণির মানুষ গণ্য করে থাকে । সবচেয়ে কৌতুকপ্রদ বিষয় হলো, মুক্ত-সভ্যতার যুগে যখন ‘গোলামী’ মানবতার এক চরম অপমান হিসেবে স্বীকৃত, তখন দাসপ্রথার বিরুদ্ধে শ্লোগানদাতারাই ‘শ্রমিক’ নামের আধুনিক দাসের জন্ম দিয়েছে। মধ্যযুগের দাস-শ্রমিকদের তুলনায় সমকালিন শ্রমিক শ্রেণির আর্থ-সামাজিক অবস্থার তেমন পার্থক্য কোথায়? আগে শোষণ চলত বর্বর কায়দায়, এখন চলে আধুনিক নিয়মে। বর্বর আর আধুনিক পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য কেবল শব্দের, জুলুমের চিত্র অভিন্ন। আজো যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখব শ্রমজীবী মানুষ নানাভাবে নিপীড়িত-নির্যাতিত হচ্ছে। বিশেষ করে গৃহকর্মীদের নানা অত্যাচারের কাহিনী প্রতিনিয়তই আমরা শুনতে পাই। এ ছাড়া দেশের গার্মেন্ট শিল্পসহ নানা প্রতিষ্ঠানে বেতন ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে রয়েছে বিরাট বৈষম্য। পূঁজিপতি শ্রেণির মুখে বৈষম্য দূরিকরণের বুলি আওড়ালেও কার্যত তা জিইয়ে রাখা হচ্ছে কৌশলে।

পাঁচ. ইসলাম সর্বপ্রকার বৈষম্য অস্বীকার করে ঘোষণা করেÑ “মানুষ কেউ কারো দাসও নয় আবার প্রভুও নয়। সব মানুষ সমানÑ এক আল্লাহর দাস এবং আদমের সন্তান। আর আদম মাটির তৈরী।” শ্রম-ইতিহাসে ইসলামই প্রথম শ্রমিকের প্রতি যথার্থ দৃষ্টিপাত করেছে, দিয়েছে সম্মান, মর্যাদা এবং শ্রমের যথাযথ স্বীকৃতি। ইসলাম সমাজের আর দশজন সদস্যের মতো নাগরিক হিসেবে তাদের প্রাকৃতিক অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিয়েছে। তেমনি শ্রমিক হিসেবে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে অনেক মূলনীতি ও বিধিও প্রবর্তন করেছে। যেন সামাজিক সাম্য বজায় থকে এবং উভয় জীবনে মৌলিক সফলতা নিশ্চিত হয় ।

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম হলো উপর্জনের পবিত্রতম মাধ্যম। হালাল পন্থায় শ্রমদান ইসলামের দৃষ্টিতে মর্যদাপূর্ণ একটি বিষয়। এপ্রসঙ্গে রাসুল সা. ইরশাদ করেন, ‘মানুষের স্বহস্তে উপার্জিত খাবারের চেয়ে উত্তম খাবার কিছুই হতে পারে না। নিশ্চয় আল্লাহর নবী দাঊদ আ. স্বহস্তে উপার্জন দিয়ে আহার করতেন।’ (বুখারী) হালাল যে কোনো শ্রম সাপেক্ষে উপর্জিত আয়কে সর্বোত্তম উপার্জন আখ্যায়িত করে ইসলাম শ্রম এবং শ্রমজীবী মানুষকে যথাযত মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবম-লী নবীগণ কর্তৃক সমাজের দৃষ্টিতে নি¤œমানের শ্রমগুলো সম্পাদন করিয়েছেন। যেন তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, কোনো শ্রমই ঘৃণার চোখে দেখার নয়। শ্রমকে তুচ্ছ করার প্রবণতা নিছক সমাজের ভুল ধারণা। এই ধারণা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
শুধু শ্রমিক নয়, একজন কৃতদাসের প্রতিও যেন ঘৃণাবোধ সৃষ্টি না হয় এজন্য রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তির অধীনে তার কোনো ভাই রয়েছে সে যেন নিজের আহার্য থেকে তাকে আহার করায় এবং নিজের পরিধেয় থেকে তাকে পরিধান করায়।’ (বুখারী: কিতাবুল ঈমান) হাদীসে বুঝানো হয়েছে, দুই ভাইয়ের মাঝে যেমন বর্ণ-বৈষম্যের কোনো প্রশ্নই উঠে না, ঠিক তেমনি শ্রমিক-মালিকের মাঝেও তেমনি কোনোরূপ বৈষম্যের প্রশ্ন উঠতে পারে না। খাদ্য-বস্ত্রের দিক দিয়েও যেন ভৃত্য বা শ্রমিককে সম পর্যায়ের রাখা হয় সে হেদায়েতও প্রদান করা হয়েছে এ হাদীসে।

হাদীসের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, হযরত যাকারিয়্যাহ আ. কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। হযরত দাঊদ আ. নিয়োজিত ছিলেন কামারের পেশায় । আর প্রিয় নবী মুহম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. নিজেও মেষ চরিয়ে শ্রমের মর্যাদাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। এমনকি মানুষের কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট যে কাজ জুতা সেলাই করা, তিনি নিজ হাতে তা করে এহেন শ্রমের প্রতি সমাজের অহেতুক ঘৃণাবোধকে সমূলে উৎপাটন করতে চেষ্টা করেছেন।
শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। কাজে নিয়োগ করার পূর্বেই শ্রমের ধরণ ও পারিশ্রমিকের পরিমাণ নির্ধারণ করার বিষয়টি সেগুলোর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযি. বর্ণনা করেন- ‘রাসূলুল্লাহ সা. পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে শ্রমিককে শ্রমে নিয়োগ করতে নিষেধ করেছেন।’ আরো ইরশাদ হচ্ছে- ‘শ্রমে নিয়োগ কারার সময় শ্রমিককে পারিশ্রমিকের পরিমাণ জানিয়ে দাও।’ (নাসাঈ)
শ্রমিক যেন যথার্থ মুজুরী পায় সে জন্য রাসূল সা. ইরশাদ করেন- শ্রমিক যখন তার কাজ শেষ করবে তখন তার পারিশ্রমিক পরিপূর্ণ করে দিতে হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ) শ্রমিক যেন নিজের পারিশ্রমিক হাতে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ তালবাহানা ও অহেতুক বিলম্বের শিকার না হয় সে বিষয়ের প্রতি মালিকপক্ষকে সতর্ক করে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন-‘পাওনা পরিশোধে সামর্থবান ব্যক্তিদের তালবাহানা জুলুমের নামান্তর। শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ (বায়হাকী, ইবনে মাজাহ)

শ্রমিককে যেন তার সাধ্যাতীত কোনো কাজে নিয়োগ না দেয়া হয় সে প্রসঙ্গেও রয়েছে নবীজীর মূল্যবান নির্দেশনা। ইরশাদ হচ্ছে- ‘আর যে কাজ শ্রমিকের সাধ্যাতীত তা করতে তাকে বাধ্য করা যাবে না। যদি সাধ্যাতীত কোনো কাজে তাকে নিয়োগ করা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।’ (বুখারী: কিতাবুল ঈমান) এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা নিজেও শ্রমিককে সহযোগিতা করতে পারে। এতে শ্রম যত কষ্টকরই হোক না কেন তা করতে গিয়ে শ্রমিক মানুষিকভাবে আহত হয় না।

শ্রম নির্বাচনের স্বাধীনতা শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক। তাই ইসলাম শ্রমিককে এই স্বাধীনতাও প্রদান করেছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন নামাজ শেষ হয় তখন ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণ করে কর্মে আত্মনিয়োগ কর।’ (সূরা জুমু‘আ) শ্রমিক যেন সারা জীবন শ্রমিকই না থাকে ; তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটে, সে উদ্দেশে ইসলাম শ্রমিককে মালিকের সাথে যৌথ কারবারেরও সুযোগ করে দিয়েছে। মুজারাবা জাতীয় পন্থায় শ্রমিক-মালিকের যৌথ কারবারের মাধ্যমে উল্লিখিত সুযোগটি ফলপ্রসূ হতে পারে।
ইসলাম শ্রমিক ও মালিকের মাঝে প্রভু ও দাসের সম্পর্কের পরিবর্তে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে। এজন্য মালিককে বলা হয়েছে, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং খাওয়া-পরায় যেন তোমাদের মাঝে সাম্য রক্ষা পায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ কর।’ এ ব্যাপার হযরত আবু মাসুদ আনসারী রাযি. নিজের জীবনের একটি ঘটনা বর্ণনা করে বলেন- 'একদিন আমি নিজের কৃতদাসকে মারধর করছিলাম। এমন সময় পেছনের দিক থেকে আওয়াজ এলো হে আবু মাসুদ! জেনে রাখো, আল্লাহ তোমার চেয়ে অধিক শক্তিশালী। আমি মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি স্বয়ং রাসূল সা. আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল ! আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমি এ কৃতদাসকে আজাদ করে দিলাম।' রাসুল সা. বললেন, 'তুমি এমনটি না করলে দোজখের আগুন তোমাকে ঝলসে দিত।'

বর্তমান বিশ্বে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের মাধ্যম হিসেবে আন্দোলনকে বেঁছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে সাময়িকভাবে অধিকার আদায় করা সম্ভব হলেও তা স্থায়ী হয় না। শ্রমিক-মালিকের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা একমাত্র ইসলামের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব। শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষ যদি ইসলামের প্রদর্শিত নীতিমালা অনুসরণ করে, তাহলে শ্রমিকরা দাবি আদায়ের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করবে না, মালিকদেরও শোষণ করার মানসিকতা থাকবে না। উভয়ের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং একে অপরের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। আর এর মাধ্যমেই সমাজে বা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। শ্রমিকের প্রতি ইসলামের অনুপম ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে রূপায়িত হলে অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।

লেখক : মুহাদ্দিস, ইমাম, প্রবন্ধকার
ইমেইল: m.rhaque@yahoo.com


সম্পর্কিত খবর