শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


দাবি আদায়ের জন্য হেফাজত ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে চাইলে আমি সেটাকে রাজনীতি বলবো না: মাওলানা মামুনুল হক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মামুনুল হক। দেশের অন্যতম চিন্তাশীল আলেম ও নন্দিত ইসলামি আলোচক। তিনি বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের আমির আবার অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। মাদরাসা পেড়িয়ে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বিস্তৃত তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা। কর্মজীবনেও সম্পৃক্ত আছেন উভয়দিকে।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকার এ আলেম সম্প্রতি মুখোমুখি হন অাওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুবের। কথা বলেন, কওমি সনদের স্বীকৃতি, সরকারের অভিপ্রায় ও স্বীকৃতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, ভোটের রাজনীতিতে তার আসু প্রভাব, হেফাজতের রাজনীতিকরণসহ সমকালীন নানা ইস্যু নিয়ে।

আওয়ার ইসলাম : কওমি সনদের স্বীকৃতি ঘোষণার পর থেকে সরকার বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলেম উলামাদের সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা বলা হচ্ছে। আপনার কী মনে হয়?

মাওলানা মামুনুল হক : আমি বলবো, রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে নয়, বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে। কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির দাবি আলেমগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত বিষয় ছিলো। সরকার সে দাবি পূরণে অগ্রসর হয়েছে এবং যেভাবে আলেম উলামাগণ চেয়েছিলো সেভাবেই তার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। সুতরাং আলেমদের সাথে সরকারের সম্পর্ক ভালো হওয়া বা তাদের প্রতি নমনীয় মনোভব তৈরি হওয়া স্বাভাবিক বিষয়।

আওয়ার ইসলাম : বিএনপিও কওমি সনদের স্বীকৃতি দিয়েছিলো। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ভোটের রাজনীতির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। বিএনপি কী একই উদ্দেশ্যে করেছিলো? দুই ঘোষণার পার্থক্য কী?

মাওলানা মামুনুল হক : আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই ভোটের রাজনীতি করে। সুতরাং ঘোষণা দেয়ার ক্ষেত্রে উভয়ের রাজনৈতিক বা ভোটের হিসেব থাকতে পারে। সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। আমাদের বিবেচ্য হলো আমাদের সাথে কোনো প্রতারণা করা হলো কিনা? আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হলো কী না? বিএনপি যে ঘোষণা দিয়েছিলো আমি মনে করি না সেখানে প্রতারণা ছিলো। ‍কিন্তু তারা প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলো তাতে দেশের বৃহত্তর আলেম উলামার প্রত্যাশা পূরণ হতো না।

হেফাজত রাজনৈতিক সংগঠন নয়, নির্বাচন করার প্রশ্নই আসে না: মুফতি ফয়জুল্লাহ

হেফাজতের আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার চেষ্টা চলছে: আল্লামা আহমদ শফী

আওয়ার ইসলাম : বিএনপি কেনো প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলো না?

মাওলানা মামুনুল হক : প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারা একটি কারণ ছিলো, বিষয়টির সূচনা তখনি হয়। এরপর পূর্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর কোনো ঘোষণা ছিলো না। তবে বিএনপির কাছে আলেম উলামাদের প্রত্যাশা আরও বেশি ছিলো। কারণ, জোট সরকার গঠনে উলামাদের জোরালো ভূমিকা ছিলো। সে জায়গা পূরণ হয় নি।

তবে নিঃসন্দেহে বিএনপির ঘোষণা একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিলো। তাদের ঘোষণার কারণেই আওয়ামী লীগের ঘোষণা দেয়া সহজ হয়েছে।

আওয়ার ইসলাম : একজন কওমি মাদরাসার ছাত্র বা শিক্ষক  এবং দায়িত্বশীল হিসেবে আওয়ামী সরকারের কাছে আপনি আর কী কী প্রত্যাশা করেন? যেখানে গেলে, আপনাদের প্রত্যাশা আলোর মুখ দেখলো বলে মনে করবেন?

মাওলানা মামুনুল হক : যে ঘোষণা হলো এবং যে প্রজ্ঞাপন জারি হলো তা শুধু সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। সরকার যদি আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী এ সিদ্ধান্তকে আইনে রূপ দেয়, তবে তখনই মনে করতে পারবো আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।

তবে এটুকু ইতিবাচক দিক রয়েছে সরকার এখনো আমাদের দাবী ও প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার অগ্রসর হচ্ছে।

আওয়ার ইসলাম : আপনারা আইনে পরিণত করার কথা বলছেন এবং আপনাদের প্রত্যাশা মোতাবেক। আপনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আইনি প্রক্রিয়ার রূপরেখা কী হবে? বা হওয়া উচিৎ?

মাওলানা মামুনুল হক :  সরকার যে কমিটি করে দিয়েছে তারা যে সনদ ইস্যু করবেন তাকে মাস্টার্সের মান প্রদানের জন্য যে আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে তা সরকার সম্পন্ন করবেন। সরকারের সঙ্গে দাপ্তরিক সম্পর্ক ব্যতীত কমিটি যেভাবে বলছে, সেভাবেই।

আল হাইয়াতুল উলয়া নামে যে কমিটি বা কমিশন হয়েছে সরকার তাকে এফিলিয়েট ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। অথবা সরকারের অধীন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে এ সনদ ইস্যু করার ক্ষমতা প্রদান সরকার করতে পারে। আমাদের উপর কোনো হস্তক্ষেপ না হলে আমি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ ইস্যুতে কোনো দোষ দেখি না।

আওয়ার ইসলাম : বার বার একটি কথা বলা হচ্ছে, সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। দাপ্তরিক সম্পর্ক রাখবো না। এ বিষয়গুলো কী ব্যাখ্যা করবেন?

মাওলানা মামুনুল হক : হস্তক্ষেপ বলতে কওমি মাদরাসার ব্যবস্থায়, তার সিলেবাসে ও কারিকুলামে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে এমন কোনো প্রক্রিয়া এখানে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

আলেম উলামাদের সর্বোচ্চ কমিটি ও নীতিনির্ধারকগণ যতোটুকু সংশোধন ও পরিবর্তন প্রয়োজন মনে করবেন ঠিক কতোটুকু হবে এর বাইরে কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না। অর্থাৎ পাঠ্যসূচি ও কারিকুলাম অক্ষুণ্ন থাকবে।

আওয়ার ইসলাম : আপনারা সরকারের হস্তক্ষেপ মানবেন না, কারিকুলাম অনুসরণ করবেন না, সরকারের সাথে দাপ্তরিক সম্পর্ক রাখবেন না। অথচ সরকার শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর এমএ-এর মান দিবে। দাবীটা কতোটা যৌক্তিক?

মাওলানা মামুনুল হক : দাবিটা এজন্য যৌক্তিক যে, আমি যদি বিশ্বমানের কারিকুলামের শিক্ষা মান নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে সরকার হস্তক্ষেপ ছাড়াও সনদ প্রদান করতে পারে। আমরা চেয়েছি, ইসলামিক স্টাডিজ ও অ্যারাবিকে এমএ-এর মান। সরকার দেখবে আমি এমএ মানের ইসলামিক স্টাডিজ ও অ্যারাবিকের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি কী না?

সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এবং তার স্বীকৃতি সবাই দিয়েছে। কারণ, সবাই মনে করছে ব্রিটিশ কাউন্সিল শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারছে। আমাদের বিষয়টি ঠিক তেমনি।

আওয়ার ইসলাম : এ সময়ের আরেকটি আলোচিত ইস্যুর দিকে যেতে চাচ্ছি। কওমি সনদের স্বীকৃতির সঙ্গে ভোটের রাজনীতির একটি হিসেব সমান্তরালে চলছে। আপনার কী মনে হয় সরকার কতোটা উপকৃত হবে ভোটের রাজনীতিতে?

মাওলানা মামুনুল হক : সরকার যদি কওমি নীতি নির্ধারকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এ ব্যাপারে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারে, তাহলে ভোটের রাজনীতিতে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেই মনে হয়।

সরকার আইনি পদক্ষেপসহ সত্যই আলেম উলামার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলে তাদের ব্যাপারে বিদ্যমান নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন হতে পারে। অসম্ভব কিছু নয়।

আওয়ার ইসলাম : মিডিয়ায় হেফাজত ও কওমি মাদরাসাকে এক ও অভিন্ন প্রমাণের চেষ্টা করছে। হেফাজত ও কওমি মাদরাসা কতোটা এক এবং কতোটা ভিন্ন?

মাওলানা মামুনুল হক : হেফাজত ও কওমি মাদরাসা সম্পূর্ণ দুটি বিষয়। দুটি মিলিয়ে ও গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। হেফাজত কওমি মাদরাসা কেন্দ্রিক ময়দানে ভূমিকা পালনের একটি প্লাটফর্ম। এর নিজস্ব অবকাঠামো রয়েছে। নিজস্ব পলিসি আছে। সেই কাঠামোই হেফাজতের নীতি নির্ধারণ করেন।

অন্যদিকে কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংক্রান্ত একটি ব্যবস্থাপনা। এরও পৃথক নেতৃত্ব রয়েছে। যদিও হেফাজত কওমি আলেমদের নেতৃত্বাধীন হওয়ায় উভয় নেতৃত্বে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। কওমি শিক্ষার নেতৃত্ব হেফাজত থেকে অনেক বিস্তৃত ও সুসংহত। হেফাজতের আদর্শ ও রাজনৈতিক চিন্তার বাইরেও বহু সংখ্যক লোক কওমি মাদরাসায় রয়েছে গেছে।

একই ব্যক্তি যখন হেফাজতে থাকেন তিনি হেফাজতের এবং কওমি শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয় তখন কওমি মাদরাসার প্রতিনিধি।

আওয়ার ইসলাম : তারপরও উভয় ক্ষেত্রে প্রায় সম পর্যায়ে একই ব্যক্তি অবস্থান করছেন। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখবেন?

মাওলানা মামুনুল হক : এ ক্ষেত্রে সরকার ও মিডিয়া এক দৃষ্টিকোণ রাখে। সরকার চাইছে রাজনৈতিক উপকার নিতে এবং মিডিয়া চাইছে রাজনৈতিক রঙ লাগাবে।

আওয়ার ইসলাম : হেফাজতের রাজনীতি বা রাজনীতির হেফাজত এ সময়ের আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন নির্বাচনে হেফাজতের একটি ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতের অনুপ্রবেশের বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

মাওলানা মামুনুল হক : ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতের আগমণ আমরা কামনা করি না। কিন্তু হেফাজত যেহেতু কিছু দাবী নিয়ে আন্দোলন করছে, সে দাবি পূরণের জন্য রাজনীতির উপর হেফাজতের প্রভাব থাকা দরকার। দাবি আদায়ের স্বার্থে ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতের সেন্টিমেন্ট যে কোনো দিকে যেতে পারে। সেটাকে আমি রাজনীতি বলবো না। বরং আমি বলবো, দাবী পূরণ সাপেক্ষে হেফাজতের ভোট ব্যাংক যে কোনো দিকে যেতে পারে। সেটা প্রত্যক্ষ রাজনীতি বলা চলে না।

আওয়ার ইসলাম : ভোটের রাজনীতির ব্যাপারে জনগণ দ্বিধাগ্রস্থ। একদিকে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের ঘণিষ্ঠতার সংবাদ প্রচার হচ্ছে, অন্যদিকে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কেউ কেউ বিএনপির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। দু নৌকায় পা দিয়ে হেফাজত কতো দূর এগুতে পারবে?

মাওলানা মামুনুল হক : এটাকে আমি দুই নৌকায় পা দেয়া বলবো না। হেফাজতের কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নেই। এবং স্পষ্ট কোনো অবস্থান থাকার সুযোগও নেই। হেফাজতের কিছু দীনি এজেন্টা আছে। সরকার ও বিরোধী দল যারাই সে এজেন্টার প্রতি যতোটা উদার, সহনশীল ও ইতিবাচক মনোভব পোষণ করবে তারাই হেফাজতের ততো বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।

আওয়ার ইসলাম : মিডিয়া সূত্রে জানতে পারলাম, হেফাজত আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ইসির নিবন্ধন পাওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে!

মাওলানা মামুনুল হক : আমাদের জানা মতে এমন কোনো উদ্যোগ হেফাজতে নেই। সে সুযোগও নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দল হিসেবে ইসির নিবন্ধন নেয়া এবং নির্বাচন করার সুযোগ বর্তমানে হেফাজতের আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না। দেশের আলেম উলামাদের কাছেও বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হবে না।

আওয়ার ইসলাম : হেফাজতের নীতি নির্ধারকগণ যদি মনে করেন, হেফাজত রাজনীতি করবে, নির্বাচন করবে তাহলে কী বড় কোনো সমস্যা হবে?

মাওলানা মামুনুল হক : আমার মনে হয়, অবশ্যই বড় সমস্যা হবে। হেফাজতের নীতি নির্ধারকগণ যদি রাজনীতির অভিপ্রায় রাখেন তবে সারা দেশে হেফাজতের যে অরাজনৈতিক সেন্টিমেন্ট রয়েছে তার সাথে বোঝাপড়া করতে হবে। তারা যদি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষিতে হেফাজতের রাজনীতি করার সুযোগ বা অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না।

আওয়ার ইসলাম : আপনি বলছেন, সবাই একমত হলে হেফাজত রাজনীতিও করতে পারে?

মাওলানা মামুনুল হক : হ্যা, সেটা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সারা দেশের আলেমগণ একমত হলে হেফাজত রাজনীতি করবে। কিন্তু শুধু সম্ভাবনা; বরং বলবো সুদূর সম্ভাবনা।

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ