শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


ভারতে মুসলিমদের ব্যবসা বন্ধেই কসাইখানায় অভিযান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ভারতের উত্তর প্রদেশে 'অবৈধ কসাইখানার' বিরুদ্ধে যে অভিযান চালানো হচ্ছে, তার ফলে সবচেয়ে বেশী সমস্যায় পড়েছেন সেখানকার মুসলমানরা। এদের অনেকেই কসাইখানা চালাতেন। তবে সরকারি অভিযানের ভয়ে মাংস বিক্রির সব ধরণের দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানা যাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখার জন্য উত্তর প্রদেশে গিয়েছিলেন বিবিসি হিন্দির সংবাদদাতা জুবায়ের আহমেদ।

উত্তর প্রদেশের রামপুরে একটা ল্যান্ডমার্ক রেজা লাইব্রেরি।

তার ঠিক পেছনেই যে বাজার, সেখানে পাওয়া যায় না এমন জিনিস নেই বললেই চলে।

মাংসের দোকানও আছে অনেকগুলো। কিন্তু এখন সবগুলোই বন্ধ।

ওই মাংসের দোকানগুলোরই একটার মালিক মুহাম্মদ কুরেশী।

"মুসলমানদের কাজকর্মের ওপরেই যত নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে। ওরা চাইছে মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে। কাজকর্ম-ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে মুসলমানদের হাতে যখন পয়সা থাকবে না, তখন চাকর-বাকর বানিয়ে রাখতে সুবিধা হবে," বলছিলেন মি. কুরেশী।

রাজ্য সরকার বলছে অবৈধ কসাইখানা বন্ধের অভিযান কোনও বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে টার্গেট করে করা হয়নি। তবে ওই সরকারি বয়ানের প্রতি মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশেষ ভরসা নেই।

মি. কুরেশীর মন্তব্য, "প্রথমে গোস্ত বন্ধ করা হল, তারপর সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দিয়েছে, যেগুলো মুসলমানদেরই ছিল।"

রামপুরে বিজেপি দলের কার্যালয়
রামপুরে বিজেপি দলের কার্যালয়

রামপুরের সব কসাইখানা এখন বন্ধ। তাই যারা মাংস খান, তাঁরা পড়েছেন ঝামেলায়। রেস্তোরাঁ বা কারও বাড়িতেই আর মাংস খাওয়া হচ্ছে না।

একজন রেস্তোরাঁ মালিক বলছিলেন, "রামপুর মুসলমান বহুল শহর। এখানকার হিন্দু-মুসলমান উভয়ই গরুর মাংস পছন্দ করে। কিন্তু এখন সবাইকে বাধ্য হয়ে শাক-সবজি খেতে হচ্ছে।"

পাঁঠা, মুরগী বা মাছের দোকানগুলোর ওপরে কোনও রকম বিধিনিষেধ নেই, কিন্তু দোকানদারেরা সেগুলোও ভয়ে বন্ধ করে রেখেছেন। এরকমও খবর পাওয়া যাচ্ছে যে কিছু পুলিশ কর্মী বাড়তি উৎসাহ নিয়ে সব ধরণের মাংসের দোকানই বন্ধ করে দিচ্ছেন।

রাজ্য সরকার বার বার বলছে শুধুমাত্র অবৈধ, লাইসেন্স-বিহীন কসাইখানাগুলোই বন্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু রামপুরের কুরেশী সমাজের প্রধান জাহিদ কুরেশী বলছেন অবৈধ কসাইখানা বলে কিছু হয়ই না।

তাঁর মতে, কসাইখানার ব্যাপারে বেশীরভাগ মানুষই বিশেষ কিছু জানেন না।

জাহিদ কুরেশীর কথায়, "দুই ধরণের কসাইখানা হয়। পৌরসভা বা পৌর কর্পোরেশন কিছু কসাইখানা চালায় যেগুলো পরম্পরা অনুযায়ী দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আর আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে যে কসাইখানাগুলো চলে, সেখানে শুধুমাত্র রপ্তানির জন্যই মাংস কাটা হয়।"

তিনি আরও বলেন, "উত্তরপ্রদেশে কোনও ব্যক্তি মালিকানায় কোনও কসাইখানাই নেই। সবই চলে পৌরসভা বা কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে।"

আধুনিক কসাইখানাগুলোর জন্য লাইসেন্স নিতে হয়। আর এই ব্যবসায় হিন্দু - মুসলমান দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষই যুক্ত।

বিগত সমাজবাদী পার্টির সরকার বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন লাইসেন্স দেয়নি আর লাইসেন্সের নবায়নও করায় নি। তাই বর্তমান বিজেপি সরকার এই সঙ্কটের জন্য সমাজবাদী পার্টি সরকারকেই দায়ী করছে।

মাংসের ব্যবসার সঙ্গে চিরাচরিতভাবে যুক্ত কুরেশী সমাজের এক যুব নেতা তারিক হুসেইন কুরেশী বলছিলেন, "এই অবস্থার জন্য সমাজবাদী পার্টিই দায়ী। ২০১৪ সালে পৌরসভা পরিচালিত কসাইখানাগুলোর লাইসেন্স আটকে দিয়েছিল সরকার। মুসলমান সম্প্রদায়, বিশেষ করে কুরেশী সমাজকে টার্গেট করেছিল সমাজবাদী পার্টির সরকার।"

মুসলমান বৃদ্ধ
মুসলমানদের অভিযোগ, হাজার হাজার মানুষ মাংস ব্যবসায় জড়িত ছিলেন, তবে তাঁদের অনেকের কাছে এখন খাওয়ার পয়সাও নেই

ওই বছরই সুপ্রিম কোর্ট মাংসের দোকান আর কসাইখানাগুলোর জন্য নির্দেশাবলী জারী করেছিল। আর সেটা কুরেশী সমাজ জানতই না।

জাহিদ কুরেশী বলছিলেন, "বিগত সরকার ওই নির্দেশাবলীটা সম্পূর্ণ চেপে গিয়েছিল।"

আদালতের নির্দেশগুলো মূলতঃ ছিল কসাইখানাগুলোকে উন্নত করার জন্য। সেইসব নির্দেশ এখনও কার্যকর করা হয়নি। এখন যোগী আদিত্যনাথের সরকার সেই নির্দেশগুলোই পালন করতে শুরু করেছে। রাজ্য সরকার কুরেশী সমাজের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও শুরু করেছে।

কুরেশী সমাজের অভিযোগ লাইসেন্স প্রাপ্ত আধুনিক কসাইখানাগুলোও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন: 'এক দশকে বাংলাদেশে বেশি ইসলামীকরণ হয়েছে'

তবে কুরেশী সমাজের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে যে বেআইনিভাবে দোকানের পিছনে লুকিয়ে-চুরিয়ে 'হালাল মাংস'ও বিক্রি করত অনেকে।

বিজেপি-র একজন সিনিয়র নেতা শিববাহাদুর সাক্সেনা বলছিলেন, "এখানে তো প্রায় প্রতিটা গলিতেই কসাইখানা গড়ে উঠেছিল। রাস্তার ওপরেই পশু কাটা হত। বকরী ঈদের সময়ে গরুর গলায় মালা পড়িয়ে রাস্তায় ঘুরিয়ে জানিয়ে দেওয়া হত যে এটাকে জবাই করা হবে। তারপর এক সময়ে রাস্তাতেই বলি দেওয়া হত।"

মি. সাক্সেনা এটাও মানতে চাইলেন না যে সরকার মুসলমানদের নিঃস্ব করে দিতে চায়। তাঁর কথায়, সরকার যখন আইন করে, সেটা হিন্দু - মুসলমান উভয়ের জন্যই করে।

ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ছবির কপিরাইটAFP
ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়

কিছু মুসলমান নেতা যেমন বলছেন মাংস নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে, আবার কোনও কোনও নেতা বলছেন মুসলমানদের কিছুদিনের জন্য হলেও মাংস খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

প্রাক্তন সংসদ সদস্য শফিকুর রহমানের কথায়, "আমি তো মুসলমানদের উদ্দেশে এটাই বলি যে তোমরা গোস্ত কেনা-বেচা, জবাই করা বা খাওয়া বন্ধ রাখ। যতদিন তোমাদের সমস্যার সমাধান না হচ্ছে ততদিন সম্মান নিয়ে অন্য কোনও কাজ কর। এই সমস্যা সরকারকেই সমাধান করতে হবে।"

জাহিদ কুরেশী অবশ্য বলছিলেন এ ধরনের উপদেশ দেওয়াটা সোজা। তবে তাঁদের সমাজের যে হাজার হাজার মানুষ মাংস ব্যবসায় জড়িত, তাঁদের কাছে খাওয়ার পয়সাও নেই।

মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অবশ্য সম্প্রতি কুরেশী সমাজ আর কসাইখানার মালিকদের সঙ্গে দেখা করে আশ্বাস দিয়েছেন যে গোটা বিষয়টা নিয়ে বিচার-বিবেচনা করা হবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ