শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


দেওবন্দে উৎসবমুখর বিতর্ক অনুষ্ঠান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

deubond11

হাওলাদার জহিরুল ইসলাম
দেওবন্দ থেকে

মসজিদে রশিদে এশার নামাজ শেষ হয়েছে কোবল৷ তড়িঘড়ি সবাই ছুটছে ঐতিহাসিক ভবন 'দারুত তাফসিরে'র দিকে৷ কৌতূহলি চোখে সবার সাথে এগোলাম আমিও৷ মাদানি গেটে আসতেই একটি ডিজিটাল ব্যানারে চোখ আটকে গেলো৷ বড় করে উর্দু হরফে লেখা 'শুবায়ে মুনাজারা৷ আজিমুশ শান এখতেতামি মজলিসে আম৷'

বুঝতে বাকি রইলো না আর৷ আজ তাহলে 'তর্ক বিভাগে'র সমাপনি অনুষ্ঠান! আরেকটু এগোতেই একটি সফেদ বোর্ডে আজকের আলোচ্য বিষয় ও অতিথিদের তালিকা নজরে পড়লো৷ অনুষ্ঠানের মধ্যমণি থাকবেন সম্মানিত মুহতামিম সাহেব আল্লামা আবুল কাসেম নোমানি দামাত বারাকাতুহুম৷ আগ্রহটা যেনো বেড়ে গেলো দ্বিগুন৷ বিভিন্ন আঞ্জুমান বা শিক্ষা বিভাগ আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে মুহতামিম সাহেবের অতিথি হওয়া বছরে এটাই হয়তো প্রথম৷

ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যান্য শিক্ষা বিভাগের মতো 'শুবায়ে মুনাজারা' বা বিতর্ক বিভাগও একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ বিভাগ৷ দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস ও তাখাস্ সুস ফারেগ শিক্ষার্থীগণ (নির্দিষ্ট কোটায়) এ বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়৷ সারা বছর পৃথিবীর বিভন্ন ধর্ম, মতবাদের ওপর চলে গবেষণা৷

ওম্মা! অনুষ্ঠান শুরু হতে না হতেই দেখি কদিম দারুল হাদিসের বিশাল হল রুমটি কাণায় কাণায় পূর্ণ! জায়গা না পেয়ে তিন দিকের দরোজার সামনেও দাঁড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীরা৷ ভীড় ঠেলে একটু সামনে যেতেই চোখ কপালে ওঠলো৷ মঞ্চ সামনে এত্তোগুলো পুরস্কার! এ কি পুরস্কার না পুরস্কারের পাহাড়!!

ওহহো! আজকের আলোচ্য বিষয়টি তো বলাই হয়নি৷ বিষয়টি সমসাময়িক না হলেও সমধিক গুরত্ত্বের দাবি রাখে৷ বিশেষত ইলমি ও আকিদার দৃষ্টিকোণ থেকে৷ আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে 'মিয়ারে হক কারা৷' অর্থাৎ শরিয়তে ইসলামিয়াতে সত্যের মাপকাঠি কারা এবং কেনো এ বিষয়টি নিয়েই আজকের বিতর্ক সভা৷

পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, হামদ না'তের মাধ্যমে শুরু হলো অনুষ্ঠান৷ প্রথমেই সঞ্চালক সাহেব 'মুুনাজারা'র নিয়মাবলী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করলেন৷ পরক্ষণেই আজকের প্রধান অতিথি আল্লামা মুফতি আবুল কাসেম নোমানি সাহেব হাফিজাহুল্লাহ(মুহতামিম সাহেব) উদ্বোধনি বক্তব্য পেশ করলেন৷ মওদূদী মতবাদ, আকিদার ক্ষেত্রে ঠিক কী কী কারণে আহলুস সুন্নত ওয়াল জামা'ত দ্বিমত পোষণ করে থাকেন তার মোটা মোটা বিষয়গুলো তুলে ধরে সারগর্ভপূর্ণ আলোচনা রাখলেন৷

এবার  মুনাজারা বিভাগের তরজুমান(ক্লাস ক্যাপ্টেন) বক্ততৃতা মঞ্চে আসলেন৷ মুজারা কী, কীভাবে, মুনাজারায় কী কী শর্ত মেনে চলতে হয় আলোচনা করলেন তার সবই৷

Image may contain: one or more people, crowd and basketball court

এরপর মূল ভূমিকা হিসেবে চমৎকার বক্তব্য রাখলেন মুনাজারা বিভাগের অন্যতম যিম্মাদার, বিভিন্ন ধর্ম, মতবাদ নিয়ে গবেষণাকারী মুফতি রাশেদ সাহেব আজমি৷ অসাধারণ ভাষাশৈলী, দালিলিক ও বাস্তব ভিত্তিক যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তুলে ধরলেন মওদূদী মতবাদের অসারতাগুলো একটা একটা করে৷ আলোচনায় আসলো সমকালিন নানা ফেরকা-মতবাদও৷ আহলে হাদিস, লা-মাযহাবি ফেরকারও মুখোশ খুলে দিলেন খুব সহজেই৷ আরো বললেন, আজকের মুনাজারা কেবলই শিক্ষার জন্য৷ এখানে হার জিতের বিষয়টি সামনে না আনাই ভালো৷ পুরো আধা ঘণ্টা ছাত্ররা অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলো এই বিজ্ঞ আলেমের দিকে৷ নিজেদের জ্ঞানভাণ্ডারে জমা করে নিলো আরো কিছু মুক্তদানা৷

নিয়মনুসারে বিতার্কিকগণ দু'পক্ষে  অবস্থান নিলেন৷ মঞ্চের ডানে দেওবন্দী বা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অনুসারী৷ আর বাঁপাশে মাওলানা মওদূদী সাহেবের মতবাদের অনুসারীগণ৷ প্রতি গ্রুপে ৫জন করে পরিচালকসহ মোট ১১জন৷ আবার প্রতি গ্রুপে একজন ছিলেন প্রধান হিসেবে৷

মওদূদীপন্থীদের সুযোগ দেয়া হলো প্রথমে৷ গ্রুপপ্রধান মওদূদী মতবাদের পক্ষে (মওদূদী সাহেবের কিতাব থেকে) দালিলিক ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন৷ তিনি সাব্যস্ত করে দিলেন সাহাবায়ে কেরামগণ মিয়ারে হক নন! একমাত্র রাসূল সা.-ই মিয়ারে হক বা সত্যের মাপকাঠি৷ তার দেয়া দলিল খণ্ডনের জন্য দেওবন্দীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মাইক্রোফোন ছেড়ে নিজ আসনে ফিরলেন৷

দেওবন্দী গ্রুপপ্রধান জবাব দিতে শুরু করলেন অপর পক্ষের প্রতিটি দলিলের৷ কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস বাদ পড়লো না কোনোটাই৷ কিন্তু উপস্থাপনে তেমন পারঙ্গমতা দেখাতে পারলেন না৷

একটু পর ঠিক এই সুযোগটিই কাজে লাগালো মওদূদীপন্থীরা৷ সাথে কিছুটা চাতুরতারও আশ্রয় নিয়ে বললো, 'আমারাও সাহাবায়ে কেরামকে মিয়ারে হক মানি৷ তবে এনফেরাদিভাবে নয়৷ বরং এজতেমায়ীভাবে৷' দেওবন্দীদের মূল বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে শ্রোতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন৷ উপস্থাপন করলেন আজিব গরিব কিছু ইতিহাসকথা৷ বোধহয় অনেকটা সফলও হলেন৷ একটি মৌন শ্লোগানও তাদের পক্ষে দেখা গেলো৷

আমি ততোক্ষণে ভিড় ঢেলে হল রুমে প্রবেশ করেছি৷ যাদের সারা বছর এসব অনুষ্ঠানে আসতে দেখা যায়নি আজ তাদের অনেকেই নজরে পড়লো৷ মুগ্ধকর, শিক্ষণীয় অনুষ্ঠানের একটি আর্কাইভ রাখতে ইচ্ছে হলো বেশ৷ অমনি মোবাইলটা বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েকটি ক্লিক করে নিলাম৷ আশপাশের কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে৷

কেমন যেনো একটা নিরবতা ছেয়ে গেলো পুরো মজমায়৷ চিন্তার ভাজ দেখা গেলো কারো কারো ললাটে৷ ফের আসলেন দেওবন্দীরা৷ এবারও সুন্দর দালিলিক আলোচনা করলেন৷ কিন্তু প্রতিপক্ষের চাতুরতা সম্পর্কে শ্রোতাদেরকে সতর্ক করতে ভুলে গেলেন৷ মানে, মওদূদীপন্থীগণ যে দাবি করলেন, 'আমরা সাহাবায়ে কেরামকে এজতেমায়ীভাবে মিয়ারে হক মানি' কথাটি মওদূদী মতবাদের স্পষ্ট খেলাফ৷ কেনোনা, মাওলানা মওদূদী সাহেবের একাধিক বইয়ে লেখা আছে যে তিনি বা তার জামায়াত সাহাবায়ে কেরামকে হুজ্জত বা মিয়ারে হক মানেন না৷ সেখানে ইজতেমায়ী-ইনফেরাদির কোনো আলোচনা নেই৷

এ পক্ষ আসে, দলিল পেশ করে৷ ও পক্ষ এসে তার জবাব দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়৷ হলরুমের সবাই চরম উদ্দীপনার সাথেই উপভোগ করছিলো৷ এক পক্ষ যখন দলিল পেশ করতে শুরু  করে তখন মনে হয় অপর পক্ষ বুঝি কুপোকাত হয়ে গেলো৷ আবার অপর পক্ষ যখন জবাব দেয়া শুরু করে তখন মনে হয় প্রতিপক্ষ বুঝি একদম হেরেই গেলো৷ মাত্র ৩মিনিটেই একেক জন এতোটা সারগর্ভপূর্ণ আলচোনা করতে পারেন তা নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাস হওয়া মুশকিল৷ মুহূর্তেই যেনো পুরো ইসলামি ইতিহাসের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছিলেন শ্রোতাদেরকে৷ প্রস্তুতিটা যে পূর্ণভাবেই নেয়া হয়েছে তা সহজেই বুঝা গেলো৷

সময় গড়ালো অনেক৷ রাত সোয়া ১২টার দিকে এসে মুনাজারার দৃশ্যপট ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করলো৷ দেওবন্দীগণ এগিয়ে যেতে লাগলেন৷ যুদ্ধের ময়দানটা যেনো তাদের মুঠোয় চলে আসছিলো৷ উপস্থিতদের সবাই ঠিক এ মুহূর্তটির জন্যই দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছিলো৷ শেষ পর্যায়ে দেওবন্দীদের পক্ষে মাশাআল্লাহ, সহিহ কাহা-সহিহ কাহা, ঠিক হ্যায় ঠিক হ্যায় শ্লোগানে মুখরিত হলে পুরো হলরুমটি৷

একেক পক্ষের আলোচনার জন্য সময় দেয়া ছিলো ৬মিনিটি করে৷ ৩মিনিট গ্রুপপ্রধানের জন্য আর ৩মিনিট তার সহযোগির জন্য৷ সময় শেষ হতেই কলিং বেল চেপে ধরা হচ্ছিলো৷ সময়ের চমৎকার বণ্টন এবং বিতার্কিকগণ তার অনুসরণ করা অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিলো বহুগুণে৷

অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন দেওবন্দে সম্মানিত নায়েবে মুহতামিম ও সিনিয়র মুহাদ্দিস হজরত আল্লামা আবদুল খালেক সাম্ভলী সাহেব দামাতা বারাকাতুহুম৷ অতিথি হিসেবে পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে ছিলেন মুফতি মুজ্জাম্মিল হক বাদায়ূনী সাহেবসহ কয়েকজন উস্তাদ৷ সবাই যেনো আজকের বিতার্কিকদের প্রতি মুগ্ধই হচ্ছিলেন৷

সর্বশেষ এলো পুরস্কারের পালা৷ তরজুমান সাহেব সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন আজকের মুনাজারায় মোট ৬০রূপির কিতাব পুরস্কার হিসেবে দেয়া হচ্ছে৷ বিতর্কে অংশগ্রহণকারীদের জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার৷ অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের জন্যও থাকবে  সম্মাননা৷ পুরো মাদরাসার তরজুমান(ক্লাস ক্যাপ্টেন)দেরকেও সম্মানন পুরস্কৃত করা হবে৷

পুরস্কার তুলে দিলেন সভাপতি সাহেব৷ পরে দোয়ার মাধ্যমে সমাপ্ত হলো জমকালো ও শিক্ষণীয় আজকের বিতর্ক অনুষ্ঠানটি৷ তখন দেয়াল ঘড়ির কাটা বলছিলো 'এখন রাত ১টা৷'

আরআর

বুদ্ধিমানের নির্বুদ্ধিতা

লেখক প্রকাশক ও সম্পাদকদের মিলনমেলা

বিশ্বের কোথাও হাইকোর্টের সামনে মূর্তি দেখিনি: এরশাদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ