শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


হোলি উৎসব: বখাটেদের অবাধ নোংরামির কৌশল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাহনূর ইসলাম শাহীন
কবি ও প্রাবন্ধিক

holiif you want to distroy a nation preassurise another culture on is own culture. যদি কোন জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উপর ভিন্ন একটা সংস্কৃতি চাপিয়ে দাও।

সুস্থ সবল বলিষ্ঠ একটা জাতিকে অস্ত্রের জোড়ে কুপোকাত করা বেজায় মুশকিল। অন্তত আজকের জামানায় সেটা সম্ভব নয়। এখনকার যুগে বুদ্ধিতেও কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। প্রয়োজনে বুদ্ধি বা পরামর্শ দাতা লোকেরও অভাব নেই। আধুনিকায়নের এই যুগে কোন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন জাতি রাষ্ট্রকে যদি ধ্বংস করতে হয় তবে তার জন্য মোক্ষম অস্ত্র হল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এখানে প্রায় সবাই বলে থাকেন অপ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আমি বলবো দুটোই হতে পারে। হোক সেটা শ্লীল বা অশ্লীল। যেমন একটা লোকের প্রতিনিয়ত অভ্যাস হল সকালবেলা ফলের শরবত পান করা। এখন কেউ যদি তার অনিচ্ছা সত্তেও দুধ কিংবা মদ খেতে বাধ্য করে অবশ্যই তাতে পেটে গন্ডগোল হবে। ঠিক তেমনি আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। কিন্তু ধর্মমত নির্বিশেষে বিভিন্ন জাতির মানুষের সাথে এদেশের মানুষের সহাবস্থান দীর্ঘদিনের। কয়েকশত বছর ধরে এদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান এবং মুসলিমগণ পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। সেই সুত্রে এদেশের মুসলমানদের মধ্যেও বর্তমানে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির জয়জয়কার অবস্থা। হিন্দুয়ানা সংস্কৃতির সবটাই যে অশ্লীল এমন কিন্তু নয় কিন্তু তবুও এই সংস্কৃতি নিয়ে একটা সময় উভয় জাতি পরস্পর এবং নিজেরা নিজেরাই বিবাদে জড়াতে বাধ্য। আর সর্বোপরি বাস্তবতা হল বর্তমান যুগে অশ্লীল সংস্কৃতি আমাদের যেভাবে ঘিরে ধরেছে তাতে করে এদেশের যুব সমাজ ধ্বংসের অতলে হারিয়ে যাওয়ার পথ আর বেশিদূর বাকি নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যেকটি মানুষেরই ধর্মীয় অধিকার রয়েছে। স্বীয় ধর্ম পালনে ব্যঘাত ঘটানোর অধিকার কারো নেই। কিন্তু অন্যের অধিকার খর্ব হয় সম্মানহানি হয় এমন কাজ অবশ্যই নিন্দনীয়। বিশেষত নিজ ধর্মীয় উৎসব অনুশাসন অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়াটা মারাত্মক অন্যায়।

সম্প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব হোলি খেলায় বখাটেদের বখাটেপানা বর্ষবরণে টিএসসিতে ঘটে যাওয়া নোংরামিকেও হার মানিয়েছে যা চরম দুঃখজনক। টিএসসির ঘটনা পুরোটাই ছিল অদ্যন্ত অবৈধ নোংরামি। অপরদিকে হোলি উৎসব ছিল বৈধ নোংরামি। বৈধ নোংরামি এজন্য বলা, হোলি উৎসবের নোংরামি একটি ধর্মীয় উৎসবের মোড়কে বৈধতার লেবেল লাগানো ছিল। এর পেছনে যে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই ছিল তা নয় বরং কিছু মুসলিম মা বাবার নামধারী কিছু মুসলিম সন্তানও ছিল। সার্বজনীনতার নামে বর্তমান প্রজন্মের বিরাট একটা অংশ পর ধর্ম চর্চায় বেশ সুখানুভব করছে। এটা চরম বোকামি এবং ভন্ডামী এ কথা তাদের বুঝানোর সহজ কোনো উপায় নেই। তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক সুশিল সমাজ এবং হিন্দুয়ানি নাস্তিকতার ছোঁয়ায় কলঙ্কিত মিডিয়ার অতি উৎসাহী প্রচারণাতেই মুসলিম যুব সমাজ ব্যপকভাবে বিভ্রান্ত এবং বিপদগামী হচ্ছে। বলা হয় ধর্ম যার যার উৎসব সবার। কই আমরা তো দেখি না কোনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে শামীল হতে! নামায, রোযা, ঈদ, কুরবানিতে তো তাদের অংশ নিতে দেখি না কখনো! ইসলামে এর পূর্ণ অনুমোদনও নেই। তবে কেউ নামায রোযা করলে বাধা নেই কিন্তু ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না তবে হ্যাঁ জাগতিক উপকার সে পেতে পারে। আমার ধর্ম আমার কাছে যেমন শ্রেষ্ঠ একেকজন হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধের কাছেও তার ধর্ম শ্রেষ্ঠ। নিজ নিজ ধর্ম শ্রেষ্ট মনে করা কখনোই সাম্প্রদায়িকতা নয় বরং নিজের ধর্ম অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া হলো সাম্প্রদায়িকতা। অপরদিকে পর ধর্ম চর্চাও অসাম্প্রদায়িকতা নয় বরং সেটা হলো ধর্মহীনতা এবং অধপতন।

সেদিনকার হোলি উৎসবে আমি নিজে যে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছি তাতে কিছুতেই সেটাকে ধর্মীয় উৎসব বলে মেনে নিতে পারছি না। সেদিন এক বন্ধুর সাথে জর্জ কোর্টের কাছে এক এডভোকেট বন্ধুর চেম্বারে গিয়েছিলাম সৌজন্য সাক্ষাতে। সেখান থেকে কোর্টকাচারি সামনে দিয়ে গিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তায় বের হওয়ার সময় দুটি ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী হিসেবে হোলি উৎসবকে কিছুতেই ধর্মীয় উৎসব বলে স্বীকার করতে পারছি না। বরং সেটা ছিল প্রকাশ্য বেলেল্লাপনার মহোৎসব। আমরা যখন বের হচ্ছিলাম অসংখ্য মানুষের ভীড়ে ঠিক ঐ সময় একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ঐ রাস্তাতেই ঢুকেছিল। হঠাৎ করে অন্য একটি ছেলে দৌড়ে এসে মেয়েটির গালে রঙমাখা হাত বসিয়ে দেয়। সাথে সাথে আরো কয়েকটি ছেলে মেয়েটির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। অসহায় মেয়েটি নিজেকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে সঙ্গী ছেলেটির বুকে ঝাপিয়ে পড়ে নিজের মুখটি আড়াল করে। ওরা ছেলেটির মুখেও রঙ মাখিয়ে দেয়। অসহায়ত্বের বোঝা নিয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ছেলেটি।

এটা কেমন উৎসব যার জন্য পথচারী নারী পুরুষকে অসহায় হতে হয়? পথচারীর সম্মানহানি করার মধ্যে কিসের আনন্দ? এটা কোনো উৎসব হতে পারে না বরং এটা বখাটেদের অবাধ নোংরামি বৈধ করার একটা কৌশল মাত্র

ঠিক আরেকটু সামনে এগোতেই দেখি একসাথে তিনটি মেয়ে ঢুকছিল ঐ রাস্তায়। মেয়েগুলো আমার বাম পাশ দিয়ে কাছাকাছি আসতেই আমার ডান পাশ থেকে একটি ছেলে কিছুটা এগিয়ে প্রথম মেয়েটির দিকে হাত বাড়ায়। দেখাদেখি একইসঙ্গে আরো কয়কটি ছেলে মেয়েগুলোর উপর হামলে পড়ার চেষ্টা করে। মেয়েগুলোকে দেখেছি আগে থেকেই অনেকটা নিজেকে লুকানোর মতো করে মাথা নিচু করে আসছিলো। বাম পাশে তিনটি মেয়ে ডান পাশে ৪/৫ জন বখাটে মাঝখানে আমার নিজেকে রুটি তৈরির গোলানো আটাই মনে হচ্ছিল। ওরা ডান দিক দিয়ে সামনে থেকে আসায় কিছুটা পিছু হটতে হয় আমাকে। ভাগ্যিস ওরা আমাকে সম্ভবত লক্ষ্য করছিল যে কারণে আমাকে ডিঙিয়ে ওরা মেয়েগুলোর নাগাল পাচ্ছিল না। কেননা মেয়েগুলোকে কাছে পেতে হলে আমাকে নিয়েই তাদের ঝাপিয়ে পড়তে হতো। এ যাত্রায় হয়তো মেয়েগুলো আমার উছিলায় রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু যে ভয়টা পেয়েছিলাম তাতে কিছুটা থমকে গিয়েছিলাম। ওদের ক্ষিপ্রতা আরেকটু লাগামহীন হলে মান ইজ্জত সব ধুলোয় লুটাত। এটা কেমন উৎসব যার জন্য পথচারী নারী পুরুষকে অসহায় হতে হয়? পথচারীর সম্মানহানি করার মধ্যে কিসের আনন্দ? এটা কোনো উৎসব হতে পারে না বরং এটা বখাটেদের অবাধ নোংরামি বৈধ করার একটা কৌশল মাত্র। ধিক্কার জানাই এই সমস্ত লাগামহীন বখাটেপনার উৎসবকে। এটা কোনো ভদ্রলোকের সংস্কৃতি নয়। এখনই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে নতুবা এটাও এক সময় সার্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠবে।

অপসংস্কৃতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সয়লাব হয়ে গেছে। নগ্ন সংস্কৃতির ছোঁয়ায় যুবসমাজ দিনদিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। খাবলে খামচে ধ্বংস করছে আমাদের পরিবার আমাদের সমাজ। পশ্চিমা উড়াল সংস্কৃতি বিশেষ করে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আগত অশ্লীল অপসাংস্কৃতি এখন বাবা এবং সন্তানের মাঝে মৃত্যুদূত হয় দাড়িয়ে আছে। স্বামী স্ত্রীর স্বর্গীয় সম্পর্কের মাঝে দেয়াল হয়ে দাড়িয়েছে। ভাই বোনের মধুর সম্পর্কের মাঝে অশ্লীলতার দেয়াল হয়ে দাড়িয়ে আছে। ঠিক সেই সময়ে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক সুশিল সমাজ ও সুশিল মিডিয়ার সহযোগিতায় ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ধর্মীয় দাঙ্গা সৃষ্টিরই অশনি সংকেত। এদের কল্যাণই অতি সম্প্রতি মোঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে হোলি উৎসবও যে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হবে না তা হলফ করে বলা যায় না। আগামী প্রজন্মকে এই অপসংস্কৃতির হেঁয়ালিপনা এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বের করে আনতে না পারলে এ জাতির ধ্বংস অনিবার্য। এজন্য মুসলিম চিন্তাবিদ এবং সংস্কৃতি কর্মীদেরকে আরো সোচ্চার এবং সচেতন হতে হবে।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ