শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


শেষ বয়স ও বাবা-মা এবং আমাদের বোধোদয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

Asrom

-মুহাম্মাদ

`ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার

মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার।

নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী

সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।

ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম

আমার ঠিকানা তা ইবৃদ্ধাশ্রম!'

নচিকেতার এই হৃদয়স্পর্শী গানটা যখনই শুনি তখন চোখের ভিতরে ভেসে আসে কোন এক করুণ, বেদনায় ভারাক্রান্ত, হাসির অন্তরালে এক কষ্টের প্রতিচ্ছবি যিনি হয়তো হাঁটছেন, খাওয়া-দাওয়া করছেন, গল্প করছেন, খেলাধুলা করছেন, বই পড়ছেন কিংবা প্রার্থনা করছেন অথবা চুপচাপ বসে আছেন কিন্তু সব কিছুই যেন এক অস্বাভাবিকতার বাস্তবায়ন। রক্তের বন্ধন আর পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন একটি সামাজিক চরিত্রের বিচিত্র মঞ্চায়ন।

আর এই অস্বাভাবিকতার বাস্তবায়ন ও মঞ্চায়ন দেখলেই ধরে নেয়া হয় যে এটি একটি ভিন্নধর্মী প্লাটফর্ম যেখানে কিছুদিন পরপর কোন একজনের একটি স্বাভাবিক সময়ের পর কিংবা একটি স্বাভাবিক অবস্থার পর অবস্থান করতে হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, কে আসে কিংবা কোন সময়ের পর বা কোন অবস্থার পর? খুব সহজেই হয়ত উত্তর দেয়া যাবে কিন্তু একবারেও কি ভেবেছি, যিনি আসেন তিনি হয়ত আমার, আপনার কিংবা আমাদের অতি আপনজন মা আর বাবা। কেউ হয়ত আসেন তার নিজস্ব কাজ থেকে অবসর নেয়ার পর, কেউ আসেন শারীরিকভাবে অক্ষমতার পর। কি নিষ্ঠুর, কি বর্বর আমাদের চেতনা, মানবিক মুল্যবোধ আর শ্রদ্ধাবোধ!

বয়স্ক কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের শেষ সময়ের একমাত্র আশ্রয় বৃদ্ধাশ্রম বর্তমান সময়ের এক সত্য কিন্ত তিক্ত বাস্তবতা। আর এই সত্য কিন্তু তিক্ত বাস্তবতাকে যারা উপলব্ধি করে সেই সকল অসহায় মানুষদের পাশে সন্তানেরমতো এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের এই মানবিক অবদানকে কোন কিছুর সাথে তুলনা করলে এটি চরম লজ্জার হবে। নিজের সন্তানরা যেটি পারেননি সেটি সেই মহান মানুষগুলো করে দেখাচ্ছেন তাদের সর্বস্ব দিয়ে। মমতা, ভালবাসা আর দয়ার যে দৃষ্টান্ত প্রকাশ করছেন তা সত্যিকার অর্থেই সেই সকল হতভাগাদের গালে স্পষ্ট চপটঘাত। কিন্তু যারা পরিবারের আশ্রয় না পেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে না গিয়ে একাকীত্ব জীবন যাপন করছেন তাদের কষ্টগুলো দেখবে কে- এই বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা আজ বড় অসহায়।

ঘৃণা, লজ্জা আর বিরক্তি থেকে যে অসহায় মানুষগুলো আজ তিক্ত বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। আবহমানকাল থেকে চলে আসা পারিবারিক বন্ধনগুলোতে যে দীনতা প্রকাশ পাচ্ছে তার দায়ভার আমাদেরকে নিয়ে একটু ভাবতে হবে। আমাদের দেশে যে পরিমান বৃদ্ধাশ্রম তৈরী হয়েছে তার চেয়ে বেশি তৈরী হয়েছে মা-বাবাকে আলাদা করে দেয়া কিংবা তাদেরকে শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রবনতা। আমাদের ভাবনায় একবারেও আসেনা আমি তো কারো বাবা কিংবা মা। অথচ শেষ বয়সের একাকীত্ব জীবন যাপন কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে সময়ের বাকীটুকু কাটানোর পরও কোনদিন কোন বাবা-মা তার সন্তানের অমঙ্গল কামনা করেননা। কতটুকু ভালবাসা থাকলে বাবা-মা এত নিঃস্বার্থ হতে পারে। এইখানেই একজন বাবা-মার ভালবাসার সাথে সন্তানের ভালবাসার পার্থক্য।

কথায় আছে-মাটিতে রাখে না পিপঁড়ার ভয়ে, মাথায় রাখে না উকুনের ভয়ে। কি নিখুঁত ভালবাসা বাবা-মায়ের! পরম আদরে যত্ন করে বুকে আগলিয়ে রেখে বড় করতে থাকে, সাধ্যমত ভরন পোষণ, থাকার ভালো জায়গা, শিক্ষার ব্যবস্থা করে তাকিয়ে থাকে সন্তানের দিকে, যে একদিন সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, সুন্দর ক্যারিয়ার গড়বে। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করতে তারা এতটকু চিন্তা করেননা। অসুস্থ হলে সারারাত নিজে না ঘুমিয়ে শিয়রের কাছে বসে থাকেন, স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেন, পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য কেউ মানত করেন, কেউ নফল রোযা রাখেন, কেউ বা উপোষ করেন আবার সেই বাবা-মা ভালো খাবার নিজে না খেয়ে সন্তানের জন্য রেখে দেন, নিজেদের সকল চাহিদাকে হাসিমুখে বিসর্জন দিয়ে সন্তানের সকল চাহিদা পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা করেন, সেই বাবা-মার নিঃস্বার্থ ভালবাসা কি এতই তুচ্ছ! নিজের স্বার্থে তাদেরকে আলাদা করে দিচ্ছেন কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছেন কোন বোধদয় থেকে তার উত্তর আপনার কাছেই। তাদের সারাজীবনের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসাকে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করার চেয়ে একটু মন দিয়ে ভেবে দেখুন। দেখবেন তাদের ভালোবাসায় আপনার শ্রদ্ধাবোধ আর মানবিকবোধদয়ের জায়গা থেকে আপনার মস্তক অবনত হবে, মনের অজান্তেই আপনার চোখ থেকে অশ্রু নামবে। শান্তির পরশ ছুঁয়ে যাবে আপনার মনকে। নিজেকে বাবা-মার জায়গায় দাঁড়িয়ে একবার ভাবুন। নিজের শ্রদ্ধাবোধ আর মানবিকবোধদয়ের জায়গাটি পরিস্কার হবে এটি নিশ্চিত।

আমরা যারা ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করি, তারা নিজ নিজ ধর্মচর্চার জায়গা থেকেও আমাদের কর্তব্যবোধকে জাগ্রত করতে পারি। বর্তমান সময়ে এটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত যে, পরিবারের যিনি কর্তা কিংবা কর্ত্রী তারা অনেক সময় এটি ধরেই নেই যে, ৫০ বছরের বেশী বয়স হলে তাদের পুরো দায়িত্ব তাদের সন্তানদের কিংবা সন্তানদের স্ত্রীর। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই প্রবনতা অনেক বেশী। তারা অনেক বেশী পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েন, সব কিছুতেই অনেক বেশী কর্তৃত্ব দেখাতে ভালবাসেন। আর তাদের এই কর্তৃত্বপরায়ণ ভালোবাসায় সন্তান কিংবা সন্তানদের স্ত্রীর সাথে একটি তিক্ততার শুরু হয়ে সেটি যখন ঝগড়ায় উপনীত হয় তখনই একধরনের টানাপোড়ন থেকে পারিবারিক বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠে মা-বাবা থেকে আলাদা কিংবা মা-বাবার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম এর গীত রচনা হয়ে একটি প্রশ্নবিদ্ধ কর্তব্যবোধের যে জন্ম হয় তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের কোন ধর্মেই ধর্মীয় আইন বলতে যা বুঝি তা বরাবরই অনুপস্থিত। আমাদের দেশে মুসলিম শরিয়া আইনে বাবা- মার ভরণপোষণ সম্পর্কে কোন বিধান সরাসরি না আসলেও মহাগ্রন্থ আল- কুরআনের সুরা বনী-ইসরাইল এর ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে পিতা-মাতার ভরণপোষণ সম্পর্কে একটি সুন্দর পথ দেখানো হয়েছে। আল্লাহু সুবহানাহু তায়ালা বলেন-

And your Lord Commanded that worship not any else except Him and does good to parents. If either or both of them reach old age before you, utter not even a faint cry to them and chide them not and speak to them the word of respect. And spread for them the arm of humility with tender heart and say, 'O my Lord; have mercy on these both as they both brought me up in my childhood.'

‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে,তাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করো না,পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো,পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে উফ্ (পর্যন্ত) বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না;বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত কর এবং দুআ কর,হে আমার প্রতিপালক!তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন,তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।’ -সূরা বনী ইসরাঈল,(১৭):২৩-২৪

 

উপরিউক্ত দুইটি আয়াতে ইসলাম পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরন ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশও দিয়েছেন খুব কঠিন ভাষায়। আল্লাহু সুবহানাহু তায়ালা পিতা-মাতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন তখন তাদের সাথে সদাচারন ও উত্তম দুয়ার যে নিদর্শন দিয়েছেন তাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার সাথে উফ শব্দটি যেখানে করতে নিষেধ করেছেন সেখানে তাদের বার্ধক্যে তাদেরকে যদি একাকীত্বে বসবাস করতে হয় কিংবা তাদের ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম হয় সেটি আল্লাহু সুবহানাহু তায়ালার নির্দেশনা অমান্য করার শামিল এবং তা অনেক বেশী গোনাহের কাজ। ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতার সম্মানকে অনেক বড় করে দেখানো হয়েছে। আল্লাহু সুবহানাহু তায়ালার পর পিতা-মাতাকে সম্মান করতে বলা হয়েছে, তাদের অবদানের শুকরিয়া আদায় করতে বলা হয়েছে।পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের সুরা লোকমানের ১৪ নং আয়াতে এ সম্পর্কে আল্লাহু সুবহানাহু তায়ালা বলেন-

And We have enjoined upon man [care] for his parents. His mother carried him, [increasing her] in weakness upon weakness, and his weaning is in two years. Be grateful to Me and to your parents; to Me is the [final] destination.

‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি- (কারণ) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’ বছরে- তুমি শোকর কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে।’ -সূরা লোকমান (৩১) : ১৪

আমাদের দেশে হিন্দু আইনে অবশ্য এই রকম কোন আইন নেই। হিন্দু ধর্মে প্রথাগত আইনের চর্চাই অনেক বেশী। হিন্দু ধর্মে সেটিকে অনেক বেশী স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছে, সন্তান এর সাথে মা-বাবার যতই দন্ধ ও টানাপোড়ন থাকুক তাদেরকে ভরণপোষণ দিতেই হবে। এ সম্পর্কে মানু বলেছেন- The aged parents, a virtuous wife and an infant child must be maintained even by doing hundred misdeeds. অর্থাৎ বৃদ্ধ বাবা-মা, ধর্মচারী স্ত্রী ও নাবালক শিশু যদিও শত প্রকারের খারাপ কাজ করে থাকে তবুও তাদের ভরণপোষণ করতে হবে।

Mitakshara law অনুযায়ী- where there may be no property but what has been self acquired, the only persons whose maintenance out of such property is imperative, are aged parents, wife and minor children.

ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত আইন ছিল যে, উপরে উল্লেখিত বৃদ্ধ বাবা-মা, ধর্মচারী স্ত্রী ও নাবালক শিশু এর ভরণপোষণ প্রত্যেক পুরুষ হিন্দুর ব্যক্তিগত দায়িত্ব ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই আইনে একটু বর্ধিত পরিবর্তন আসে।

বাংলাদশে মা-বাবার ভরণপোষণ নিয়ে খ্রিস্টান আইনেও তেমন কিছু বলা নাই। সেখানেও প্রথাগত আইনের চর্চাই বেশী হয়।

সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কর্ম ব্যস্ততায় চাহিদার প্রতুলতার কারনে পারস্পরিক সম্পর্কে প্রতিনিয়ত যে পরিবর্তনের সুচনা হচ্ছে তা ক্রমশ সবাইকে নিজের মতো করে পৃথকভাবে বাস করতে অনেক বেশি অনুপ্রানিত করার ফলে যৌথ পরিবারের প্রতি একটি সূক্ষ বিতৃষ্ণার জন্ম নেয়ায় অসহায়, বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি সন্তানদের যে দায়িত্ব-কর্তব্য তা অনেক বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। আর এই প্রশ্নবিদ্ধ দায়িত্ব-কর্তব্যকে যখন শ্রদ্ধাবোধ আর মানবিকবোধদয় দিয়ে বিচার করা যায়না তখন স্বভাবতই আইন পাশে এসে একটি সমাধানের পথ খুঁজে দেয়ার প্রচেস্টা চালান। আমাদের দেশে বাবা-মার ভরণপোষণ নিয়ে তেমন কোন শক্তিশালি আইন এতদিন ছিলনা, যার ফলশ্রুতিতে এই বিষয় নিয়ে অনেক প্রশ্নের অবতারনা হলেও সঠিক সমাধান না পাওয়ায় দেরীতে হলেও সরকার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে যার সর্বোত্তম উদাহরণ পিতা-মাতারভরণ-পোষণআইন, ২০১৩।

উক্ত আইনের ৩ নং ধারায় বলা হয়েছে– “প্রত্যেক সন্তানকে তাহার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিতে হইবে। কোন পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকিলে সেই ক্ষেত্রে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করিয়া তাহাদের পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিবে। এই ধারার অধীন পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিবার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করিতে হইবে। কোন সন্তান তাহার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাহার, বা ক্ষেত্র মত, তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদা ভাবে বসবাস করিতে বাধ্য করিবে না। প্রত্যেক সন্তান তাহার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখিবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করিবে। পিতা বা মাতা কিংবা উভয়, সন্তান হইতে পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেই ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিত ভাবে তাহার, বা ক্ষেত্র মত, তাহাদের সহিত সাক্ষাত করিতে হইবে। কোন পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সহিত বসবাস না করিয়া পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেই ক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাহার দৈনন্দিন আয়-রোজগার, বা ক্ষেত্র মত, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হইতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্র মত, উভয়কে নিয়মিত প্রদান করিবে।”
এবং উক্ত আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে– “প্রত্যেক সন্তান তাহার পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ধারা ৩ এ বর্ণিত ভরণ-পোষণ প্রদানে বাধ্য থাকিবে এবং এই ভরণপোষণ পিতা-মাতারভরণ-পোষণ হিসাবে গন্য হইবে।”

কিন্তু কেউ যদি ৩ ও ৪ নং ধারার কেউ লঙ্ঘন করলে তার শাস্তি সম্পর্কে  উক্ত আইনের ৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে– “কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ৩ এর যে কোন উপ-ধারার বিধান কিংবা ধারা ৪ এর বিধান লংঘন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে; বা উক্ত অর্থ দণ্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে।”

বাংলাদেশে এই নিয়ে অনেকগুলো মামলাও হয়েছে এবং বাবা-মা যারা প্রতিনিয়ত চোখের জলে নিজেদেরকে সিক্ত করছেন, তারা একটু হলেও আশার স্বপ্ন বুনছেন একটু ভালো থাকার, একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার। যদিও আইনটি নিয়ে আমার সামান্য আপত্তি আছে।আইনের ৭ (২) ধারাতে বলা হয়েছে- ''কোন আদালত এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আমলে গ্রহণ করিবে না।'' আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোন বাবা-মারহাজার কষ্ট হলেও কখনই সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাননা, সেই দৃষ্টিকোন থেকে অভিযোগ দায়েরের আওতা বাড়ানো উচিত। এতে যে কোন লোকের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকলে সেই অভিযোগ করতে পারে যেটির প্রচলন উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই আছে।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বাবা-মার ভরণপোষণ নিয়ে আইনে অনেকধরনের কার্যকরী ও যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সিদ্ধান্ত এসেছে।Hindu adoption and Maintenance Act-1956 এর section- 20 (1)স্পষ্ট বলা হয়েছে- Subject to the provisions of this section a Hindu is bound, during his or her life time, to maintain his or her legitimate or illegitimate children and his or her aged or infirm parents.

অর্থাৎ, এই ধারার বিধানবলী সাপেক্ষে একজন হিন্দু পুরুষ কিংবা মহিলা তার জীবদ্দশায় তার বৈধ কিংবা অবৈধ সন্তান এবং তার বৃদ্ধ ও অক্ষম (শারীরিক ও মানসিকভাবে) পিতামাতার ভরন পোষণ দিতে বাধ্য।

ধারা- ২০ এর শেষে বলা হয়েছে- Explanation- In this section "parent" includes a childless stepmother

এই ধারাটি পিতা-মাতার সংজ্ঞায় Childless stepmother বা নিঃসন্তান বিমাতাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে।

ভারতের একটি ঐতিহাসিক রায়ের কথা উল্লেখ করছি-  ২০১৬ এর অক্টোবার মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায়ে- ‘বৃদ্ধ এবং ছেলেরও পরনির্ভরশীল বাবা-মায়ের থেকে স্বামীকে নিয়ে আলাদাভাবে বসবাস করতে জোর করলে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করতে পারেন স্বামী’ হিন্দু বিবাহ আইনে এই বিধান জারি করা হয়। ১৪ পাতার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেন, ‘পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং রাজনীতির বিস্তর ফারাক রয়েছে। সেখানকার নিয়ম এখানে চলতে পারে না। বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখা ছেলের কর্তব্য বলেই ধরা হয়। বিয়ের পর স্বামীর পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন স্ত্রী। যদি বিশেষ ক্ষেত্র না হয় তবে স্বামীকে অভিভাবকদের থেকে পৃথক করার জন্য মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন করলে বিচ্ছেদের মামলা করতে পারেন স্বামী। রায়ে আরো বলা হয়, ‘অতীতে দেখা গিয়েছে স্বামীকে চাপ দিতে স্ত্রী আত্মহত্যার হুমকি বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। যদি কোনো ক্ষেত্রে তিনি মারা যান তবে আইনি সমস্যায় জর্জরিত হতে হয় সেই ব্যক্তিকে। তার ক্যারিয়ার, পরিবার, সামাজিক সম্মান সবকিছু ছাড়খার হয়ে যায়। এসব কিছুর কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত চাপের কাছে নতি করে নেন অনেকে। আর যাতে এই রকম ঘটনা না ঘটে তার জন্যই এই রায়ের বিধান করা হয়েছে।

সর্বশেষ একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসছে ভারতে আসামে। গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি, বিবিসির এক সংবাদে বলা হয়- যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ছেলে মেয়েরা অসুস্থ বাবা-মায়ের দিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ইদানীং এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সরকারি কর্মচারীরা তাদের বাবা-মায়ের ঠিক মতো দেখাশোনা না-করলে তাদের বেতন থেকে একটা অংশ কেটে নেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এ সপ্তাহে তাদের রাজ্য আসামের বাজেট পেশ করতে গিয়ে এ কথা ঘোষণা করেছেন এবং জানিয়েছেন, এই নতুন নিয়ম ২০১৭-১৮ অর্থ বছর থেকেই চালু হয়ে যাবে। তিনি বলেছেন, ‘বয়স্ক বাবা-মার যত্ন নেওয়া প্রত্যেক সন্তানের কর্তব্য। যদি কোনও সরকারি কর্মচারী সেটা না-করেন তাহলে সরকারই তার মাইনে কেটে নিয়ে সেই কর্তব্য পালন করবে। কর্মচারীদের মাইনে থেকে যে টাকা কাটা হবে, সেটা তার বাবা-মার ভরণপোষণের কাজেইব্যয় করা  হবে বলে সরকার জানিয়েছে।

আমদের কাছের দেশ সিঙ্গাপুরে ১৯৯৫ সালে ‘মেইনটেইন্যান্স অব প্যারেন্ট এ্যাক্ট’ প্রণীত হয় এবং ১ জুন ১৯৯৬ সালে এ আইন কার্যকর হয়। এ আইনে অসমর্থ পিতা মাতার সুরক্ষা ও ভরণ পোষণ এর জন্য সন্তানদের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে। আইন অমান্যকারীকে আদালতের মাধ্যমে ৫০০০ সিঙ্গাপুরী ডলার জরিমানা ও কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। পাশের দেশ ভারতে মেইনটেইন্যান্স এন্ড ওয়েলফেয়ার অব প্যারেন্ট এন্ড সিনিয়র সিটিজেনস এ্যাক্ট ২০০৭ সালে প্রণীত হয় এবং জম্মু ও কাশ্মীর ব্যাতিত সকল রাজ্যে এ আইন বলবৎ হয়। এ আইনেও পিতামাতার ভরণপোষণ ও সুরক্ষা নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এ আইনেও আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

বাগবান ফিল্মের কথা জানি, যেটি শুধু ফিল্ম নয় একটি বাস্তবতার স্বাক্ষী। শিল্পপতি দম্পতি তাদের সন্তানদের প্রতি তাদের ভালবাসার অগাধ আস্থা নিয়ে জীবনের বাকি সময়টুকু আনন্দে কাটিয়ে দেয়ার জন্য তাদের শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত সন্তানদের সকল সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে ভেবেছিলেন তাদের সন্তানরা নিশ্চয় তাদেরকে কাছে রাখার জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিবেন কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হল- কোন সন্তানই তাদের বাবা-মার দায়িত্ব নিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত যে করুন সিদ্ধান্ত হয় তাতে  বাবা-মার হৃদয়ভেঙেটুকরো টুকরো হয়ে যায়। একজনের কাছে বাবা আর আরেকজনের কাছে মা থাকবেন এমন নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তে তাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখটি মলিন হয়ে গেলেও নিরুপায় হয়ে তারা সন্তানদের বাসায় পৃথকভাবে থাকতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তারা সন্তানদের বাসা থেকে বের হয়ে আসেন। তাদের সেই বাবা একটি বই লিখে বিখ্যাত হয়ে যান। তখন ঠিকই সন্তানরা আবার বাবা-মার কাছে চলে আসে। কিন্তু বাবা তখন আর সন্তানদের গ্রহণ করেন নি। আমাদের চারপাশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই চিত্রটি খুবই স্বাভাবিক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সন্তানরা তাদের বাবা-মাকে সহ্য করতে পারছেনা, তাদের সাথে সময় দিচ্ছেনা এমনকি তাদের পিছনে অর্থব্যয়কে অযথা মনে করছে অথচ সেই কিনা অন্যের পিছনে বা অহেতুক কোন কিছুর পিছনে নেক বেশী সময় ব্যয় করছে, নিজস্ব মনোবৃত্তি পুরনে হিসেবের বাইরে খরচ করছে। যদি এটি চলতে থাকে একটি সময়ের পর আমরা এমন যান্ত্রিক হয়ে যাবো যে, যুগযুগ ধরে চলে আসা আমাদের যৌথ পরিবার এর সংস্কৃতি হারিয়ে আমরা একক পরিবারে আসক্ত হয়ে পরবো, তখন বাবা-মা কেন হয়ত পরিবারের কেউ কাউকে দেখবোনা। কয়েকদিন আগে বিটিভিতে একটি নাটক দেখেছিলাম, যেখানে যান্ত্রিকতার চাপে পরে বাবা-মাকে অস্বীকার করে বেড়ে উঠা পরিবারে একসময় নিজেরাই বুঝতে পারেন যে, স্বামী-স্ত্রী কতদিন তারা একসাথে ঘুমাতে যাননা। এই সকল নাটক আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া গল্পের চিত্রায়ন যা আমি, আপনি আর আমরা এখন আর অস্বীকার করতে পারবোনা।

যে সকল বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের বৃদ্ধ বয়সে বাড়িতে বসে থাকেন, যাদের সময় কাটেনা, যাদের গল্প করার কোন মানুষ নেই, একাকিত্বকে সঙ্গি করে যারা হতাশার চাদরে মুখ লুকান তাদের সেই অসহায়ত্ব ও একাকিত্বকে দূর করতে চট্টগ্রামে 'প্যারেন্টসলাউঞ্জ নামে একটি সংগঠন কাজ করছে বলে জানি, যেখানে সেই সকল ষাটোর্ধ  অসহায়-একাকী মানুষ ঘুমানোর সময় ছাড়া বাকি যে কোন সময় কাটাতে পারেন। তাদের জন্য খেলাধুলা, পত্রিকা পড়া, বই পড়া, গান শোনা, টিভি দেখাসহ সিনেমা দেখা ও আড্ডাবাজির ব্যবস্থা আছে। মাসে একবার মেডিকেল চেকআপের ব্যবস্থাও করা হয়। এমন নজিরবিহীন কাজগুলো যে সকল সাদা মনের মানুষেরা করতে পারেন তাদের জন্য স্বশ্রদ্ধ সালাম এবং প্রার্থনা। কিন্তু এই ভয়াবহ চিত্রটি আমাদেরকে নাড়া দেই এইভেবে যে সেই সকল অসহায় আর একাকী মানুষের শেষ বয়সে যখন সন্তানকে একটু পাশে চান, তাদের কাছ থেকে মা কিংবা বাবা ডাক শুনতে চান, তাদের একটু ভালবাসা আর আদর পেতে চান, নাতি-নাতনির সাথে খেলে সময় কাটাতে চান কিন্তু সেটি আর তাদের বেলায় হয়না। আমরা কতটা নিষ্ঠুর হলে বাবা-মাকে এইভাবে আলাদা করতে পারি।

কর্তব্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, মানবিক মুল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধদয়ের পরিসমাপ্তি হলেই আইনের প্রশ্ন আসে। আমাদের এই সকল মূল্যবোধের জায়গাটি অনেক বেশী সঙ্কুচিত বলেই হয়ত আইনের বিষয়টি আমাদের সামনে চলে আসছে। আমরা খুঁজছি শেষ বয়সে কিংবা বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার ভরণপোষণ নিয়ে আমাদের দেশে কি আইন আছে, যেটি আমাদের জন্য অনেক লজ্জার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ বাস্তবিক অর্থেই অনেক কঠিন। আমি আইনের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি আর সেটি যদি মা-বাবার ভালবাসার মুল্য কিনার জন্য হয় তবে সেই ক্ষেত্রে আমাদের দেশের আবেগপ্রবন মা-বাবার ক্ষেত্রে এটি অনেক বেশী অস্বাভাবিক এবং তাদের সাধারণ আচরণ ও চরিত্রের সাথে অনেক বেশী বেমানান। তাই আমাদের কর্তব্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, মানবিক মুল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধদয়ের জায়গাটি আরো বেশী স্বচ্ছ হয়া উচিত।

আমরা তো পারি আমাদের মা-বাবাকে শেষ বয়সে আমাদের পাশে রেখে একটু ভালবাসা দিতে, তাদেরকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে, নিজ হাতে সেবা করতে কিংবা একটু হাসি মুখে খোঁজখবর নিতে। মা-বাবা শেষ বয়সে বেশী কিছু চাননা, তাদের সাথে একটু ভালো করে কথা বলুন, দেখবেন তাদের চেহারায় কি প্রশান্তির ছোঁয়া। আমরা হয়ত বায়েজিদ বোস্তামীর মতো মা এর সেবা করতে পারবোনা কিংবা ইত্যাদিতে প্রচারিত সেই ছেলের মতো হতে পারবোনা যেই ছেলে তার মাকে টুকরিতে করে মাইলের পর মাইল নিয়ে যেত কিন্তু স্রষ্টার কাছে তাদের জন্য প্রার্থনা করতে পারি। আমাদের প্রার্থনাটি হোক এইভাবে ‘হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আল- কুরআন (সুরা বনী ইসরাইল ও সুরা লোকমান)

২. পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩

৩. Principles of Hindu Law by Noshirvan H, Jhabvala

৪. Hindu Adoption and Maintenance Act- 1956

৫. Maintenace& Welfare of Parent and Senior Cityzens Act-2007

৬. lawyersclubbangladesh.com


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ