রোকন রাইয়ান: পুরো সপ্তাহ ক্লান্তির পর শুক্রবার আসে দুদণ্ড শান্তি দিতে। সবাই অপেক্ষায় থাকেন দিনটির। একটু জিরিয়ে নেয়া কিংবা পরিবারকে সময় দেয়া মূখ্য হয়ে উঠে এই দিনে। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়াটা সেরে নেন অনেকে। আগামী সপ্তায় কী করবেন তার একটা প্রস্তুতি মনের ভেতর গুছিয়ে তোলেন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে বিপরীতও হয়। অনেক চাকরিজীবি আছেন শুক্রবারও অফিস করতে হয়। তাদের ছুটি সপ্তাহের অন্য দিন। তাই শুক্রবার তাদের জন্য আলাদা কোনো ফেসিলিটি আনে না বললেই চলে। তবে এসব দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় সবাই শুক্রবারটাকে স্পেশালি ডেট হিসেবে রাখেন। অনেকে দেখা যায় শুক্রবারটা ইবাদতের জন্যও রাখছেন। কারণ ইসলামে একটি মহা মূল্যবান দিবস এই শুক্রবার। আছে জুমার নামাজ যাকে গরিবের হজও বলা হয়েছে হাদিসে। সুতরাং শুক্রবার অনেকে আড্ডানন্দে ভাসিয়ে দিলেও অনেকেই নিজের জন্য গম্ভীর করে তোলেন দিনটিকে। আমরা কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বলেছি এই নিয়ে। চলুন দেখা যাক এই তরুণদের শুক্রবারের রুটিন কী?
ঢাকার ধানমণ্ডির তাকওয়া মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল হাফিজ মারুফ। জুমার নামাজে দায়িত্ব থাকায় ব্যস্ততা থাকে সেটি নিয়ে। তবু সারাদিনে একটু আলাদা ভাব থাকে এই দিয়ে। জানালেন, জুমবার সাপ্তাহিক ঈদ। একটি মহিমান্বিত দিন যা আল্লাহর সন্তুষ্টি, সান্নিধ্য, ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভের অন্যতম সময়। বৃহস্পতিবার সূর্যাস্তের পর থেকে শুক্রবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত জুমআ বিস্তৃত। জুমআ মূলত উদযাপনের বিষয়। মসজিদের মিম্বারই ছিল রাসুল সা. এর সিংহাসন। কাজেই তার উত্তরসূরি ও একজন ইমাম বা খতিব হিসেবে আমার দায়িত্বও অনেক বেশি। সে দায়িত্ববোধ থেকে ফজরের পর দীনি বিষয়ে লেখাপড়া ও সমকালীন বিষয়গুলো জেনে নিই। তাকওয়া মসজিদে জুমায় প্রায় লক্ষাধিক টাকা ওঠে। জুমার পর মসজিদের বক্স কালেকশনের তদারকি করি। এরপর জুমার দিনের বিশেষ আমল সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করি। প্রায় প্রতি শুক্রবারই আসরের পরে বিভিন্ন দোয়া অনুষ্ঠান থাকে, যাতে প্রায় গ্রাম এলাকার বড় মাহফিলের মত শ্রোতাদর্শক থাকে। সেখানে দোয়ার পূর্বে পরিস্থিতিনির্ভর দীনি বিষয়ে নসিহত করে থাকি। মাগরিবের পূর্বমুহূর্তটি বরাদ্দ করি আল্লাহর কাছে একান্ত প্রার্থনায়। আনন্দের ব্যাপার হল আমার অনেক মুসল্লিও ওই সময় দুয়া করে। অপেক্ষায় থাকে আমার আসার। মূলত দোয়ার মাধ্যমে শুক্রবারকে বিদায় দিয়ে অপেক্ষায় থাকি পরের শুক্রবারের।
জিসান মেহবুব একজন ছড়াকার। লেখালেখির মধ্যেই আনন্দ খোঁজেন সারাদিন। শুক্রবারও সেটা তালিকা থেকে বাদ যায় না। আছেন শিক্ষকতা নিয়ে। তিনি জানালেন, ছুটির দিন হলেও বাসায় থাকা হয় না। কোথাও হয়তো ঘুরতে বের হই। লেখালেখির মতো ঘোরাঘুরির নেশা আছে আমার।
লেখক এহসানুল হক জানালেন শুক্রবার নিয়ে পরিকল্পনার কথা। সাধারণত চেষ্টা করেন কোনো কাজ না রাখার। জানালেন, সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাসের কারণে সকালে প্রিয় ঘুমটাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। শুক্রবার সেই সুযোগটা কাজে লাগাই। উঠতে উঠতে ১০/১১টা বেজে যায়। নাস্তা গোসল সেরে মসজিদের দিকে যাই জুমা পড়তে। দুপুরের খাবার সেরে বের হই একটু ঘুরতে। বেশির ভাগ সময় বোনদের বাসায় যাওয়া হয়। বোন ভাগিনাদের সঙ্গে একটা নিরেট আনন্দের সময় কেটে যায়। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ বা প্রোগ্রাম না থাকলে দিনটা এভাবেই কেটে যায়।
ঢাকার আফতাবগরের ইদারাতুল উলূম মাদরসার মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল আলিম। লেখালেখিও করেন তিনি। একটি মসজিদের খতীবও। তাই জুমার প্রস্তুতি ও জুমা পড়ানোতে ব্যস্ত সময় পার হয়ে যায় অর্ধেক দিন। এমনটাই জানালেন। তবে তিনি বলেন, একটু তো আলাদাই শুক্রবার। ছুটি ছুটি একটা ভাব মনের মধ্যে থেকেই যায়। পরিবারকে সময় দেই। বাদ জুমা আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া ও বিশ্রামও হয় ভালো।
আবদুল আলিম বলেন, জুমার ব্যস্ততা সেরে বিকালে পরিবারকে নিয়ে কোথায় যাওয়ার চেষ্টা করি। আর সন্ধ্যায় নিয়মিত কাজ ও লেখাপড়াটারও খোঁজ রাখতে হয়। নিজের একটা প্রতিষ্ঠান আছে শব্দালয়। সেটার একটু খোঁজ খবর নেই সকালের দিকে। এইতো এভাবেই কেটে যায়।
রাজধানীর একটি কর্পোরেট হাউজে চাকরি করেন আলআমিন আলম। শুক্রবার বা ছুটির দিনগুলোতে একটু অপেক্ষায় থাকার কথা জানালেন তিনি। দিনটা কবে আসতে তার জন্য একটা তাড়াও অনুভব করেন সারা সপ্তাহ। বলেন, কবে আসবে শুক্রবার। কত শত কাজই না করব এই দিনে। কিন্ত বাস্তবে দেখা যায় উল্টো। পারিবারিক বেশ কিছু জমে থাকা কাজেই দিন শেষ হয়। আর এরপর যে সময়টুকু থাকে তা পরিবার কেই দিতে হয় চাইলেও নিজের বেপারে আলাদা করে সময় দেওয়া হয় না বা উপায়ও থাকে না।
এসবের ফাঁকেও শুক্রবারে বইপড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকে আলআমিন আলমের। জানালেন, ইচ্ছা থাকে একটা বই শেষ করার আক্ষেপ থাকে এই দিনে, বা খুব আরাম করে ঘুমানোর অথবা বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডাবাজি করারও ইচ্ছে থাকে কিন্তু তা কখনই হয়ে উঠে না। সাধারনত পরিবারকে সময় দেই। ছুটির দিনগুল এর পেছনেই কেটে যায়।
আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় শিক্ষক। নরসিংদীর সাহেপ্রতাব মাদরাসায় আছেন। সাদামাটা হাস্যরসের মানুষ হিসেবে তাকে পাওয়া যায় ফেসবুকে। শুক্রবার যে নিছক আরামে কাটানোর নয় এমনটাই পাওয়া গেল তার থেকে। তিনি জানালেন, শুক্রবার দিনটা এলেই আমার মনে এমনিতেই একটা খুশি খুশি ভাব চলে আসে। কারণ পড়ানো বা প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোন কাজের চিন্তা থাকে না। সারাদিন নিজের মতো করে কাটাতে পারি।
তিনি বলেন, সাপ্তাহের অন্য দিনের তুলনায় এ দিনে আমল একটু বেশি করতে পারি। বিশেষ করে শুক্রবারে, হাদিসে বর্ণিত এদিনের আমলের প্রতি গুরুত্ব থাকে বেশি যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সুরা কাহাফ তিলাওয়াত, দুরুদ শরিফের আমল, দোআ ইত্যাদি।
ফজরের পর সুরা ইয়াছিন তিলাওয়াত করে সামন্য সময় হাঁটাচালা করি। ৮টা পর্যন্ত ছাত্রদের গাইড দেই। তারপর নাস্তা করি। নাস্তার পর এক ঘন্টা বই পড়ি। ১১.৩০ মিনিট পর্যন্ত ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠে শরীরের পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা ও গোসল করি। তারপর সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করে মসজিদে চলে যাই। জুমার নামাজ আদায়ের পর দুপুরের খানা থেকে ফারেগ হয়ে নির্বাচিত কিছু বই পড়ি বিশেষ করে ফিকহি মাসায়েল ও প্রিয় লেখকদের বই। আছরের পর দুরুদ শরিফের আমল করে শারীরিক সুস্থতার নিয়তে ৩০মিনিট ব্যাডমিন্টন খেলি এবং বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেই। মাগরিবের ১৫মিনিট আগে মসজিদে চলে যাই যেহেতু এই সময়টা দোআ কবুলের সময়। মাগরিবের পর সুরা ওয়াকিয়া তিলাওয়াত করে অন্যদিনের রুটিন মুতাবেক কাজ শুরু করি যথা শনিবারে ক্লাসের প্রস্তুতি।
সুস্থতার জন্য জায়েজের মধ্যে টুকটাক খেলাধুলাও যে জরুরি পাওয়া গেল আবদুল্লাহ আল মামুনের রুটিনে।
কাশফিয়া হক একজন চাকরিজীবি নারী। সপ্তাহের সারাদিন অফিস করে ক্লান্তি চলে আসে শরীরে। তাই বলে শুক্রবার খুব আয়েশে কাটাতে পারেন না। ঘরণিদের ছুটি বলতে আসলেই যে তেমন কিছু নেই এমনটা বোঝা যায় তার রুটিনে।
কাশফিয়া হক জানালেন, খুব সকাল মানে ফজরের সময় উঠে নামাজ আদায় করি। তারপর ৭টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা হয়। পাশাপাশি হাদিসের বইও পড়া হয়। ৮টায় নাস্তা সেরে একটু ঘুম দেই। ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ঘরোয়া নানা কাজে কেটে যায়। এরপর গোসল-সালাত সেরে আরেকটু রেস্ট। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত ফ্যামিলির সাথে ঘুরে বেড়ানো।
রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত অনলাইন টিচিংও দেন বলে জানালেন হক। আর সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু ফেসবুকেও ঘুরাঘুরি করেন। এভাবেই কেটে যায় শুক্রবার।
এআর
পাঠক আপনার মতামতটিও লিখুন মন্তব্যের ঘরে...