ঘনিয়ে আসছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। প্রস্তুতি শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোতে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তৈরি হচ্ছে আওয়ামী লীগের ইশতিহার। খালেদা জিয়া দলকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রচার, প্রচারণা ও গণসংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে। কিন্তু আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে ইসলামি দলগুলো? তাদের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা কী? এ নিয়েই আওয়ার ইসলাম-এর ধারাবাহিক আয়োজন ‘ ইসলামি দলের নির্বাচন প্রস্তুতি’।
ইসলামী ঐক্যজোট : ২২ ডিসেম্বর ১৯৯০। স্বৈরচারি শাসক এরশাদের পতনের পর ইসলামি দলগুলোর অভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে গঠিত ইসলামী ঐক্যজোট। প্রতিষ্ঠাকালে অংশিদার ছিলো ৬টি ইসলামি দল। কয়েক বার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে জোটটি এখন পরিণত হয়েছে একটি রাজনৈতিক দলে। শরিকদের অনেকেই এখন খুঁজে নিয়েছে ভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। ২০০৮ সালে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবেই নির্বাচন কমিশনের কাছে নিবন্ধিত হয় এটি।
গঠনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচন ছাড়া ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৫ সাল পযন্ত প্রতিটি নির্বাচনের পূর্বে ভাঙ্গনের মুখে পড়ে দলটি। বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির ইতিহাসে জাতীয় নির্বাচনে যে সামান্য সাফল্য রয়েছে, তার পুরোটাই বলতে গেলে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রাপ্য। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলটি জাতীয় সংসদের ১টি এবং ২০০১ সালের জাতীয় ও পরবর্তী উপনির্বাচনে মোট ৪টি আসন লাভ করে। এছাড়া দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
২০১৬ সালে বিএনপির সঙ্গত্যাগের প্রশ্নে দেখা দেয় সর্বশেষ বিরোধের পর তবে ইসলামী ঐক্যজোট বর্তমান দলীয় স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সফলভাবে অংশ গ্রহণ করতে চায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে। জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে খোঁজ নিতে দলটির মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আতাউর রহমান খসরু।
প্রথমেই কথা হয় নব গঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে। প্রধান নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে দলীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকলেও এ কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে ইসলামী ঐক্যজোট। এ ব্যাপারে দলের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রথমত মনে করি, একটি নিরপেক্ষ, সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করার জন্য তাদের মেধা, সাহস এবং মেরুদণ্ড সোজা রেখে কাজ করবেন। এটা আমাদের প্রত্যাশা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রত্যাশা করি, এ নির্বাচন কমিশনের কাছে -যেহেতু নির্বাচন কমিশন হয়ে গেছে; মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজ ক্ষমতা বলে কমিশন গঠন করেছেন- তাই তাদের কাছে আশা হলো, জাতির প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবেন। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন এবং শপথ রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।’
কিন্তু দলীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে যাদের ব্যাপারে তাদের দ্বারা কী নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব? এমন ব্যক্তিদের কী পরিহার করার পথ ছিলো না? ইসলামী ঐক্যজোট মনে করে, বাংলাদেশে যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং দেশের সর্বস্তরে যেভাবে রাজনৈতিক রূপায়ণ চলছে তাতে দলনিরপেক্ষ লোক দ্বারা ইসি গঠন করা সম্ভব নয়। মুফতি ফয়জুল্লাহর ভাষ্য মতে, ‘যাকে বলেন, যেভাবে বলেন দলীয় সম্পৃক্ততার বাইরে যাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশে এখন আর রাখা হয় নি। সর্বত্র দল, সর্রত্র রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’
তবে তিনি মনে করেন রাজনৈতিক ব্যক্তির পক্ষেও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। যদি সে তার দায়িত্বের প্রতি সচেতন হয় এবং নিজের শপথের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে। তিনি বলেন, ‘মূলকথা হলো, আমি যখন কোনো সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত হবো, তখন মেরুদণ্ড সোজা রেখে সে দায়িত্ব পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি থাকবে, কিন্তু সাংবিধানিক পদে বসবো এমনভাবে দায়িত্ব পালন করবো যেনো চেয়ারের অবমূল্যায়ন না করি এবং চেয়ারের মযাদা রক্ষার জন্য মেরুদণ্ড সোজা রেখে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবো। এটাই বিবেচ্য বিষয়।’
এরপরও দলীয় সরকারের অধীনে নয়, বরং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দাবি করে ইসলামী ঐক্যজোট। দলটি মনে করে, নির্বাচনকালীন অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হলে নির্বাচনকালীন প্রয়োজন। কারণ, স্বাভাবিকভাবেই দলীয় সরকার তার দলকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে ক্ষমতার অপব্যবহার করার সম্ভাবণা রয়েছে।
‘যে কোনো সরকার প্রভাব বিস্তার করে হলেও পুনরায় ক্ষমতায় আসতে চায়। বর্তমান সরকারও সেটা চাইবে। আমাদের প্রত্যাশা, নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠিত হবে। যেহেতু দলীয় সম্ভাবনার অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, সেহেতু নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে সেটা বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা এবং আমারও প্রত্যাশা।’ বলেন মুফতি ফয়জুল্লাহ।
রাজনৈতিক দল হিসেবেই আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে ইসলামী ঐক্যজোটে। দলীয় প্রার্থী তাদের নির্বাচনী এলাকার তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছে দলটি। প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজগুলো একক কৌশল ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন করলেও ইসলামী দলগুলোর একটি নির্বাচনী জোট গঠনের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা শুরু করেছে। যোগাযোগ হচ্ছে সমমনা দলগুলোর সাথে।
তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে অপারগতা পেশ করে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব তিনি বলেন, ‘ইসলামী ঐক্যজোট ইসলামী শক্তিগুলোর সমন্বয় সাধনের জন্য ঐক্যের প্রয়াস চালাচ্ছে।…… আমার মনে হয়, আগামীর দিনগুলো বলে দিবে আমাদের করণীয় কী হবে। আমরা কীভাবে নির্বাচন করতে পারি এবং কীভাবে করতে নির্বাচন না করতে পারি।’
১৯৯১ সাল থেকে ২০১৭ মাঝে কেটে গেছে ২৭ বছর। দীর্ঘ এ সময়ে ইসলামী দলগুলো বার বার নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরও আশানুরূপ ফল না করতে পারছে? জানতে চাইলে মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘আশানুরূপ ফলাফল লাভ করতে না পারার অনেক কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের মাঝে কাঙ্ক্ষিত ঐক্য নেই। আমাদের শীশাঢালা ঐক্য প্রয়োজন, ঐক্যের উপর অটল অবিচল থাকা প্রয়োজন। সে ঐক্যকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করতে বার বার ব্যর্থ হয়েছি। ফলে আমরা আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারি নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর ইসলামবিদ্বেষী শক্তিগুলো ইসলামবিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু এটা তাদের ইবাদত নয়; তাদের রবের হুকুমও নয়। আমাদের প্রতি রবের হুকুম হলো, ঐক্যবদ্ধ থাকা। দীনের উপর অটল অবিচল থাকো এবং দীন প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা কর। আমরা রবের হুকুম আমরা পালন করতে পারি নি। তাই আশানুরূপ ফল পাই নি।’
শত ঘাত-প্রতিঘাতের পরও ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী ইসলামী ঐক্যজোট। তিনি বলেন, ‘ইসলামী দলগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্য পূরণের জন্য বিভিন্ন জন বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। আমরা মনে করি, গণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে; গণইনকিলাব তৈরি মাধ্যমে বাংলাদেশে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সেটি আলেম উলামা এবং দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের সমন্বয়ে খুব অসম্ভব কিছু নয়।’
-এআরকে