শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


বিজ্ঞানের জনক হয়ে আমরা আজ জ্ঞানের ফকির বলে প্রতীয়মান হচ্ছি: খতিব তাজুল ইসলাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

খতিব তাজুল ইসলাম। কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যিনি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। আলোচনা সমালোচনাও কম হয়নি তাকে নিয়ে। কিন্তু তিনি নিজের অবস্থানে অটল রয়েছেন। থাকেন লন্ডনে। সেখান থেকে ভাবেন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে।

খতিব তাজুল ইসলাম ইউকে ইক্বরা বাংলা টিভি ভাষ্যকার, জামেয়া মাদানিয়া ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ইউকের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান, আন নূর ইসলামিক স্কুল ইউকের প্রধান পরিচালক, পেকহাম জামে মসজিদ লন্ডনের অনারারি খতিব, জামেয়া নূরানিয়া ইসলামিয়া, বোয়ালজোড়, বালাগঞ্জ, সিলেটের প্রধান পরিচালক, জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার, সিলেটের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল এবং কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন (কমাশিসা) ’র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি তিনি।

মাদরাসা নিয়ে তার কাজের নানাবিধ সমালোচনা জমা রয়েছে নানামনে। আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাক্ষাৎকারে তিনি বিস্তারিত বললেন সেসব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের নির্বাহী সম্পাদক রোকন রাইয়ান

আওয়ার ইসলাম: আপনার বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন?
খতিব তাজুল ইসলাম: দু-দুজন বোনের পর প্রথম ছেলে সন্তান হিসাবে সকলের আদুরে ছিলাম। মরহুম আব্বাজান ফখরে বাংগাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রাহিমাল্লাহ’র নামানুসারে আমার নাম তাজুল ইসলাম রাখেন। আর এই নামটি আমার নানাজান মরহুম শহীদ শেরে শেরপুরী আল্লামা শামছুল ইসলামেরও পরামর্শ ছিলো। তৎকালীন আদর্শের পতাকাবাহী যুগের শ্রেষ্ট উলামাদের সান্নিধ্য পেয়ে আমার আব্বাজান নিজের প্রথম সন্তানকে আলেমে দীন বানানোর প্রত্যয় থেকেই গ্রামের পাঠশালার পাঠ চুকানোর পর মফস্বলের একটি টাইটেল মাদরাসায় আমাকে ভর্তি করান।

আমার মনে আছে, আব্বা তখন বিদেশে চাকরি করতেন। আম্মা খুব কষ্ট করে সম্পর্কে চাচা এবং ওই মাদরাসায় চাকরিরত হাফিজ আব্দুল আজিজ (গরীপুরী হুজুর) সাহেবের হাত ধরিয়ে সেখানে পাঠান। মায়ের কোলে বড় হওয়া ১২ বছরের কিশোর আমি। লজিংএ থাকতে হবে। তাদের বাচ্চাদের পড়াতে হবে। তাদের বাজার করতে হবে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাশের সাঁকোতে যেতে হবে। এমনি নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়াটা বোধ হয় আমার জীবনে প্রথম সবচেয়ে বড় ধাক্কা। কারণ বাড়িতে গিয়ে মাকে বুঝাতে পারি না আমার কষ্টের কথা। কয়েক মাস কেটেছে নিয়মিত চোখের পানি ফেলে। মা ভাবতেন আলেম হতে হলে এভাবেই কষ্ট করা লাগে!

স্কুলে সবসময় সেকেন্ড বয় হিসাবে আমার পজিশন থাকতো। কিন্তু ওখানে গিয়ে প্রথম পড়লাম ফারসির পাল্লায়। তারপর উর্দু। মনে হলো দুটো বছর অগোছালো কেটেছে। বিশেষ গাইড লাইন ও তাদারকির অভাব। একাডেমিক রাহনুমায়ী তখন থেকেই আমার মনে দাগ কাটতে শুরু করে যে, আসলে আমরা করছি কি আর করার কি ছিল?!

মাধ্যমিক লেখাপড়া জামেয়া হুসাইনিয়া গহরপুর সিলেটে। উচ্চমাধ্যমিক ও টাইটেল (দাওরা) জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার সিলেট থেকে। সিলেট গুটাটিকর থেকে দাখিল ও সিলেট আলিয়া থেকে আলিম পরীক্ষা দিয়েছি।

আওয়ার ইসলাম: আপনি তো কওমি শিক্ষা সিলেবাসে সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করছেন, এর প্রয়োজন প্রথম কবে অনুভব করেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: ছাত্রজীবন থেকেই। দাখিল আলিম দেয়ার পেছনে সেই অপূর্ণতাই কাজ করেছে। শুধু আমি নয় আমার মত হাজার হাজার ছাত্র আছে। সমালোচনার ভয়ে মুখ খোলে না। আমি সাহস করে বলছি এই যা।

আওয়ার ইসলাম: আপনার কেন মনে হলো সংস্কার প্রয়োজন?
খতিব তাজুল ইসলাম: আমি যদি পাল্টা বলি আপনাদের কেন মনে হচ্ছে না সংস্কারের প্রয়োজনীয়াতার কথা? এই আপনি আজ যেখানে বসে আছেন, সাংবাদিকতা করছেন, ক‘বছর আগে কি তা কল্পনা করা যেত? শিক্ষা পদ্ধতি বা সিলেবাস হলো বহতা নদীর মত। যে নদী বহমান স্রোতস্বিনী সে নদী জীবন্ত। যেখানে স্রোত নেই সে নদী মরা। তাই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যদি সিলেবাসে সংস্কার নিয়ে আসা না হয় তাহলে তা মরা নদীর মতই থমকে দাঁড়াবে। সৃষ্টিশীল মনন আর গঠিত হবে না। যুগের চাহিদানুযায়ী উলামা বনার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। আর হয়েছেও তাই।

ইসলামের সার্বজনীন একটা চেতনা আছে। আমার মনে হয় আমরা তার সঠিক চর্চা থেকে দূরে সরে গেছি। একটি উদাহরণ দিই। যেমন কোন কোম্পানি একটি পূর্ণাঙ্গ গাড়ির পার্টস তৈরি করে। কেউ একটা গাড়ির পার্টসগুলো কিনে এনে সংযোগ করে গাড়ি তৈরি করতে চাইলো। কিন্তু গাড়ি হলো বটে তবে কিছুটা বাঁকা, কিছু অসংলগ্ন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কিছু পার্টস এখনো বাকি রয়ে গেছে। তবে চাকা ঘুরছে শব্দ হচ্ছে গটর গটর! ৫টার গাড়ি ১০টায় যায়। কখনো এক্সিডেন্টে ছাল-বাকল নেই। আতুর লেংড়া হচ্ছে মানুষ। গাড়ির মালিক বলছে- আরে বাবা গাড়ি তো চলছে ...। এটা কোন চলা হলো? সুস্থ মানসিকতার পরিচয় আছে তাতে?

মুসলমানদের দেশ ধ্বংস হচ্ছে। আদর্শ আখলাক বিলীন হচ্ছে। অপসংস্কৃতিতে সমাজ ডুবছে, নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা হু হু করে বাড়ছে; অথচ আমরা বিক্ষিপ্ত। বোর্ড বিভক্ত, দল বিভক্ত, মাদরাসা খানকা সবই বিভক্ত। এর একমাত্র কারণ অপর্যাপ্ত শিক্ষা। একদিকে খণ্ডিত দীন শিক্ষা (মাদরাসায়) অপরদিকে খণ্ডিত জীবনের শিক্ষা (স্কুল কলেজে)।

ছাত্রজীবন থেকেই। দাখিল আলিম দেয়ার পেছনে সেই অপূর্ণতাই কাজ করেছে। শুধু আমি নয় আমার মত হাজার হাজার ছাত্র আছে। সমালোচনার ভয়ে মুখ খোলে না। আমি সাহস করে বলছি এই যা।

আওয়ার ইসলাম: কওমির শিক্ষাকে কেন খণ্ডিত শিক্ষা মনে হলো আপনার? আর আকাবিরগণ তো বলেন, কওমি মাদরাসা শুধু আলেম তৈরি করবে আর কিছু নয়, আপনি এতে একমত নন কেন?

খতিব তাজুল ইসলাম: আমাদের আকাবির ও আসলাফের উজ্জ্বল তারকা সদর সাহেব হুজুর, আল্লামা শামছুল হক্ব ফরিদপুরী রাহিমাল্লাহ কি আমাদের আকাবির ও আসলাফের কেউ নন? ঢাকার বড় বড় পুরাতন সকল মাদরাসাই তো তাদের হাতে গড়া। তিনি কি বলেছেন? ‘কর্মহীন ধর্মশিক্ষা এবং ধর্মহীন কর্মশিক্ষা জাতির জন্য অভিশাপ।’ কুরআনি ব্যাখ্যায় বলা হলো ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা ওয়াফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াকিনা আজাবান-নার’। হে দয়ময় প্রভু! আমাদের দুনিয়ার কল্যাণ দাও, দাও আখেরাতেরও মঙ্গলসমূহ। মুক্তি দাও জাহান্নামের কঠিন আগুন থেকে। এই আয়াত কি দিক নির্দেশ করে আমাদের? জাগতিক শিক্ষা ছাড়া শুধুমাত্র ধর্মীয় জ্ঞান মানুষকে বৈরাগ্যবাদীতার দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।

পবিত্র কুরআনে মজীদ ও হাদীসের ভাণ্ডারে ২ তৃতীয়াংশ জুড়ে মুয়ামালাত মুয়াশারাতের বক্তব্য। শুধুমাত্র ধর্মীয় জ্ঞান হাসিল করে নিজেকে মসজিদ মাদরাসার ভেতর আবদ্ধ করে রাখলে বা্ইরের বিস্তৃত জায়গা যা তাগুতের দখলে তার সংশোধন ও ইসলামাইজেশন কে করবে? কার দ্বারা হবে? কিভাবে সম্ভব?

আমি যখন দারুল উলুম দেওবন্দ ভিজিটে ছিলাম। তখন নায়েবে মুহতামিম আল্লামা আব্দুল খালিক মাদরাজি সাহেবের সান্নিধ্য অর্জন করি। হজরত নিজ কামরায় আমাদের স্বাগত জানান। বসে বসে হুক্কা টানছিলেন। অনেক আলোচনা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, বিলেতের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি দাবি করে যে, তারা দুনিয়ার রোলার শাসক রাজা বাদশাহ প্রভাব বিস্তারকারী নেতৃত্বদানকারী লোক তৈরি করে। সেক্ষেত্রে আজকের দারুল উলুম দেওবন্দ ইসলামী দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তত্ব প্রতিষ্ঠার মতো মনীষা তৈরি করার দাবি করে কিনা? বা করতে পারে? তিনি কয়েক মিনিট কোন কথাই বললেন না। গুড় গুড় করে হুক্কা টানছিলেন। অবশেষে বললেন, ‘আমাদের আর্থিক দৈন্যতাই দায়ী’।

আবার বললাম, দারুল উলুমের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সীনার অমূল্য গ্রন্থসহ অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞান বিষয়ক আকর গ্রন্থ সংরক্ষিত আকারে দেখলাম। এসবের সাথে দারুল উলুমে যে সিলেবাস পড়ানো হয় তার কোন সম্পর্ক আছে? তিনি আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমাদের সাধ্যের ভেতর যা পারছি তাই করছি।’ অথচ ইতিহাস সাক্ষী। শতবছর আগে কোন এক ইংরেজ যখন দারুল উলুম দেওবন্দ ভিজিটে গিয়েছিলো তখন সে দেখতে পেলো যে ছাত্ররা চাটাইর উপর বসে ত্রিভোজ স্টাডি করছিলো। জ্যামিতির জটিল সমাধান মহান শিক্ষক অতি সহজে তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। সে আরো লিখে ‘আমরা হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করে ছাত্রদের যে বিষয়ে জ্ঞান দেই; দারুল উলুমে দেখলাম মাটিতে বসে একজন সাধারণ শিক্ষক তা বিলিয়ে দিচ্ছেন।’ প্রশ্ন হলো সেই সিলেবাস আজ কেন এবং কোথায় হারিয়ে গেল?

আমাদের একটা ভুল ধারনা হলো, স্কুলে লেখাপড়ার মানেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বনা। আসলে প্রবেশিকার আগপর্যন্ত কে কি হবে না হবে তা কেউ জানে না। মেট্রিক পর্যন্ত একটা টার্নিং পয়েন্ট থাকে শিক্ষার্থীর জন্য। জ্ঞানের দরজা মাত্র খোলা হলো। সেজন্য আমরা বলি মুসলমানদের সন্তান যারা স্কুলে পড়ে তাদের জন্য পর্যাপ্ত দ্বীনী জ্ঞানের যেমন প্রয়োজন তেমনি যারা কওমি মাদরাসায় পড়ে তাদের জন্য ১০ম পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় শিক্ষার সংযোগের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞানের জরুরত আছে। শুধু কওমি শিক্ষা সিলেবাস খণ্ডিত নয় বরং স্কুলের সিলেবাসটাও খণ্ডিত ও অপুর্ণাঙ্গ।
মেট্টিকের পর কওমির উচ্চতর ক্লাসগুলো কওমির মতো চলতে তো কোন অসুবিধা দেখছি না।

আওয়ার ইসলাম: অতীতে যারা কওমি শিক্ষা সিলেবাসে সংস্কারের ব্যাপারে সরব হয়েছিলেন, তাদের কাউকে আপনি অনুসরণ করেন কি?
খতিব তাজুল ইসলাম: অবশ্যই। উপমহাদেশের ইলমে ওহীর আইকন শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, কাসেম নানুতভী মাহমুদ হাসান শায়খুল হিন্দ, শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী, বিংশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী, আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক্ব, আল্লামা সিদ্দিকুল্লাহ, আল্লামা মহিউদ্দীন খান মরহুমগণ হলেন স্মরণীয় ও বরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ। অধুনা শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানি, আল্লামা খলিলুর রাহমান সাজ্জাদ নোমানী, আল্লামা গোলাম মোহাম্মাদ দাস্তানভী, আল্লামা সালমান নদভী, আল্লামা সুলতান যওক নদভী মুহতারাম প্রিন্সিপ্যাল হাবীবুর রাহমানসহ যুগের আদর্শ মহাপুরুষগণ হলেন আমার পাথেয় ও অনুপ্রেরণার উৎস।

আমরা বলি মুসলমানদের সন্তান যারা স্কুলে পড়ে তাদের জন্য পর্যাপ্ত দ্বীনী জ্ঞানের যেমন প্রয়োজন তেমনি যারা কওমি মাদরাসায় পড়ে তাদের জন্য ১০ম পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় শিক্ষার সংযোগের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞানের জরুরত আছে। শুধু কওমি শিক্ষা সিলেবাস খণ্ডিত নয় বরং স্কুলের সিলেবাসটাও খণ্ডিত ও অপুর্ণাঙ্গ।

আওয়ার ইসলাম: পূর্বে যারা সংস্কারের কথা বলেছেন তাদের ও আপনার কর্মপন্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী?
খতিব তাজুল ইসলাম: আদর্শ ও চিন্তাগত কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য হলো, তারা এভাবে সিলেবাসকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আলোচানা ও সমালোচানার মুখে পড়েননি। পূর্বে তেমন সুযোগও ছিলো না। বর্তমানে সুযোগ আছে বিধায় যার তার মত করে কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। সমালোচানা ও ইজ্জতের ভয় অনেকের। গদি কুরসি মসনদ আছে। পুরনো অভ্যাস আছে। বহুদিন যাবত গড়ে উঠা একপেশে মানসিকতাসহ বহুবিদ কারণ জড়িত।

শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানি তো সুযোগ পেলেই সিলেবাস সংস্কারের কথা বলেন। তাঁর ঐতিহাসিক দুটো ভাষণ আমরা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে ছাপিয়েছি।

আওয়ার ইসলাম: আপনি কওমি মাদরাসা নিয়ে আন্দোলন করছেন, শুরুটা কবে কিভাবে?
খতিব তাজুল ইসলাম: আন্দোলন শুনলেই আমরা ভাবি হরতাল ভাংচুর কাটাকাটি মারামারি দাঙ্গা হাঙ্গামার মত কিছু! আসলে আমাদের এই সংস্কার আন্দোলন কার্যত চিন্তার জগতে পরিবর্তন নিয়ে আসার একটা ক্যাম্পেইন মাত্র। চিন্তাকে প্রসারিত করা। এজন্য আমাদের কোন মিছিল নেই হরতাল নেই। কমিটি বা চেয়ার কিছুই নেই। এখানে কুরসির লড়াই নাই।

শুধু আমি না, হাজার হাজার ছাত্র শিক্ষক আছেন যারা মুখ খুলে কথা বলতে পারছেন না। দাখিল মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার কারণে কত ছাত্র বহিষ্কার হয়েছেন। জামাত শিবিরের তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে পাশে। এমন ঘটনা আমার সাথেও হয়েছে।

মাদরাসা শিক্ষাকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য তখন গোটা ভারত চষে বেড়িয়েছি। হায়দ্রাবাদের নলগোন্ডা জেলায় দীনী একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করতে গিয়েছিলাম। হায়দ্রাবাদ আগ্রা দিল্লি দেওবন্দ থানাবন শ্যামলী সাহারানপুরের উলামাদের সাথে মতবিনিময় হয়েছে। বাংলাদেশের মত ভারতে অধিকাংশ মাদারিসে কওমিয়ার অবস্থা খুব করুন। হিন্দু সংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে মুসলমানদের সন্তানদের রক্ষার জন্য তেমন ভাবনা দেখিনি। আছে পুরানা চলে আসা সিস্টেমের জারিজুরি। অমুসলিম দেশের পরিবেশে হয়তো তাদের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আমাদের সমস্যাটা কোথায়?

২০১০ সালে কমাশিসা সিরিজের প্রথম কপি ছাপানো থেকেই আমাদের প্রকাশ্যে পথ চলা। কথা সাহিত্যিক রশীদ জামীলসহ আরো অনেকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আছে শুরুতে।

[caption id="attachment_26007" align="alignnone" width="821"]khatib_tajul জামিয়া মাদানিয়া ইসলামিয়ার সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন খতিব তাজুল ইসলাম[/caption]

আওয়ার ইসলাম: কমাশিসা মূলত কী কী বিষয় সংস্কার আশা করে?
খতিব তাজুল ইসলাম: পৃথিবী নামক এই গ্রহে মুসলমানরাই প্রথম ৮৫৯ সালে মরোক্কর ফেজ নগরীতে জামেয়া আল-কারউইয়িন নামে সর্বাধুনিক ইউনিভার্সিটি কায়েম করেছিলো। পরববর্তীতে ৯৭০ সালে তিউনিসিয়ায় কায়েম হয় জামেয়া আজ-যায়তুনা। বিজ্ঞানের জনক হয়ে আজ জ্ঞানের ফকির বলে প্রতীয়মান হচ্ছি আমরা। পশ্চিমারা আমাদের নিয়ে উপহাস করে। আমরা যখন ফেইসুকে প্রতিবাদ জানাই তখন তারা উপহাস করে বলে যে ‘হে মুসলমানরা! ফেইসবুক তো ইহুদিদের আবিষ্কার, অতএব তা থেকে আগে বেরিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে প্রতিবাদ করো।’

আমরা চিন্তার জগতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাই। বলতে চাই যে আমাদের তরুণদের মেধা আছে যোগ্যতা আছে। তাকে কাজে লাগানোর পথনির্দেশ করতে হবে। তাই এখানে তিনটি স্তর আমরা কামনা করি- (ক) যে করে হোক এইচএসসি বা ১০ম পর্যন্ত মাদারিসে কওমিয়ার শিক্ষা সিলেবাস সংস্কারের মাধ্যমে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রীয় শিক্ষার সাথে সংযোগ স্থাপন। (খ) কওমি মাদরাসার উচ্চতর লেখাপড়া হবে বাংলা ও আরবি মাধ্যমে। নিজস্ব স্বকীয়তার ভেতর দিয়ে। (গ) কিছু কিছু টেলেন্টদের পরিকল্পনামাফিক পাঠাতে হবে আধুনিক কলেজ ভার্সিটিতে। যাতে তারা উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করে সেখানে চলমান ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাবের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। ফিরে এসে মাদারিসে কওমিয়ার জন্যও খুলে দিতে পারে সম্ভাব্য সকল সম্ভাবনার দোয়ার।

আওয়ার ইসলাম: আপনি লন্ডনে থাকেন, ওখানে থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বোঝা কতোটা সম্ভব? আন্দোলনও কীভাবে সফল করবেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: বিশ্বকে এখন গ্লোবাল ভিলেজ বা গোলাকার গ্রাম বলা হয়। হাতের মুঠোয় গোটা দুনিয়ার দৃশ্য। আমরা এখানে বসে বাংলাদেশকে যেভাবে দেখছি আপনারা হয়তো কোন সময় সেভাবে দেখতে অক্ষম। আমি দেশে গোটা তিনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি জড়িত। নিয়মিত আসা যাওয়া উঠা বসা তো আছেই।

আর আন্দোলনের সফলতা বলতে যা বুঝায় সে অনুযায়ী আমরা সফল। কারণ সংস্কার ও পরিবর্তনের আওয়াজ এখন সর্বত্র। যেহেতু এখানে মুসলিম উম্মাহর কনসেপ্ট। তাই দল পদ কুরসির লড়াইর সুযোগ নেই। চিন্তার বিপ্লবের জন্য দল কুরসির কোন প্রয়োজন নেই।

আওয়ার ইসলাম: কমাশিসার কাজে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: আমরা অভিভূত! অসামান্য সাড়া পড়েছে চারিদিকে। আমাদের কমাশিসা ওয়েব সাইট পৃথিবীর ৫০টি দেশে পঠিত হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ও মদীনা ও আল-আজহার থেকে আমাদের বারবার অভিনন্দন জানানো হয়েছে।

আওয়ার ইসলাম: অধিকাংশ মানুষই দেখা যায় আপনার কাজের নেগেটিভ আলোচনা করে থাকে এটার কারণ কী বলে মনে করেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: সমালোচানাকে নেগেটিভ হিসাবে দেখি না। কারণ আমাদের বাংলাদেশের প্রায় সবকটি মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক উলামা মাশায়েখ কোন না কোনো দল ও মতের সাথে সম্পৃক্ত। যেভাবে আমাদের শিক্ষাবোর্ড বিক্ষিপ্ত। রাজনৈতিক দলগুলোও বিক্ষিপ্ত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও আমরা বিক্ষিপ্ত। আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে লেগেই আছি। সেখানে কমাশিসা নিয়ে সমালোচনা স্বাভাবিক। এখানে তো ব্যক্তিগত জমাজমি লেনদেন পাওনা টাওনা নিয়ে বিবাদ নয়। চলে আসা নীতি ও রীতির একটা রুটিন কাজ চলছে কেবল। তাতে কায়েমি স্বার্থবাদীদের আঁতে আঘাত লাগা স্বাভাবিক। আমাদের নামে মিথ্যা জাল বানোয়াট আইডি বানিয়ে খুব গালমন্দ করতে তারা পিছপা হয়নি। কমাশিসা এফেক্ট করছে বিধায় কিছু লোক না বোঝ চেঁচামেঁচি করছে।

আওয়ার ইসলাম: শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম আপনাদের গ্রহণ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। সেটার কারণ কী বলে মনে করেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: শীর্ষস্থানীয় উলামা বলতে কারা? আল্লামা আহমদ শফী দামাত বারাকাতুহুম খোদ বলেছেন ‘ওলামায়ে কেরামকে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দক্ষভাবে অবদান রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে’। আমাদের বক্তব্য এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না, আমাদের কিছু উলামা আছেন বুজুর্গ আছেন যারা সংঘবন্ধ একটি চক্রের বলয়ের ভেতর আবদ্ধ। সংঘবদ্ধ এই চক্র হজরতদের প্রতিনিয়ত ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল ম্যাসেজ দিচ্ছে। কারণ তারা এসব মিডিয়া থেকে অনেক দূরে। এটাও একটা সমস্যা। এই চক্রের কান আছে কিন্তু তারা শুনতে পায় না, চোখ আছে কিন্তু দেখে না, হৃদয় আছে কিন্তু অনুধাবন করতে অক্ষম। অদক্ষ একপেশে সংকীর্ণ মনের অধিকারী এই মুসাহেবগুলো কিছু হজরতদের প্রভাবিত করছে। আর তার ভুরি ভুরি প্রমাণ আমাদের শিক্ষাবোর্ড ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিস্ফুট।

বড় বড় অনেক শায়খুল হাদিস, শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, বুজুর্গ ও বোর্ড কর্তৃপক্ষের প্রেরণা আমরা পাচ্ছি। দু‘জন বুজুর্গ’র ছোট দুটি ঘটনা তাহলে বলি- শায়খুল হাদীস শিক্ষাবিদ রাজনীতিবীদ আল্লামা নেজাম উদ্দীন রাহিমাল্লাহ একসময় দাখিল দেয়ার অপরাধে ছাত্রদের তিরস্কার করতেন।

বেত্রাঘাত দিয়ে বহিস্কারের উদাহরণও আছে। সেই তিনি জীবনের শেষ ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আমাকে বললেন যে, ‘ধর্মীয় শিক্ষা যদি আমার একচোখ হয় তাহলে জাগতিক শিক্ষা হলো আমার অপর চোখ।’ তিনি আরো বলেন- ‘আমি একটি প্রতিষ্ঠানের জিম্মাদার হিসাবে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যে প্রকারের সমালোচনা আর বিরোধিতার সম্মুখীন হলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল’। এই হলো একজন শায়খুল হাদীস ও একটি রাজনৈতিক দলের নায়েবে আমীরের অনুভুতি।

আল্লামা আব্দুল বাসিত বরকতপুরী হুজুরকে সকলে চিনেন জানেন। সিলেট আজাদ দীনী এদারার সেক্রেটারী জেনারেল। তিনি একসময় বলতেন, কমাশিসা হলো কওমি মাদরাসা ধ্বংসের কর্মসূচি! আর এখন তিনি শুধু সমর্থক নয় বরং আগবাড়িয়ে বলেন- মাদরাসা নয় ইসলামিক স্কুল কায়েম করা ঈমানি ফরিজা! তিনি কওমি সনদের স্বীকৃতির এক অগ্রসৈনিক।

শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক্ব রাহিমাল্লাহ কওমি সনদের স্বীকৃতির জন্য জীবনের শেষ প্রহরে রাস্তায় অবস্থান ধর্মঘটসহ কত সংগ্রাম করে গেলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়বাজি কি কম হয়েছে?

আপনি শুনলে অবাক হবেন! উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মুফতি, মুফতি মাহমুদ ও আল্লামা গোলাম গওছ হাজারওয়ী রাহিমাল্লাহ‘দ্বয়কে মুফতি শফি পাকিস্তান ও আল্লামা এহতেশামুল হক্ব থানভীগণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন! মুফতি মাহমুদ ছিলেন মাওলানা ফজলুর রাহমানের পিতা! যিনি ভুট্টোর মাধ্যমে পাকিস্তানের সংসদে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করাতে সক্ষম হন। তাঁর সুদূর প্রসারী চিন্তা তাৎক্ষণিক অনেকে বুঝতে অক্ষম ছিলেন।

ঐতিহাসিক আরো অনেক ঘটনা আছে যা এখানে বলার সুযোগ নেই। আগে যেখানে ভিডিও হারাম ছবি হারাম পত্রিকা হারাম টিভি হারাম বলে ফতোয়া ছোড়া হতো এখনতো এসবের পক্ষে প্রচুর ফতোয়া এসেছে, তাই না? আমরা সবি বুঝি তবে পানি অনেক ঘোলা করার পর।

ভিন্নভাবে একটি জিজ্ঞাসা, শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম বলতে যাদের কথা বলছেন তারা একে অপরকে কেন গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত নন? কেন এক ও অভিন্ন কওমি শিক্ষাবোর্ড হচ্ছে না? কিসের অন্তরায়? কারা দেয়াল খাড়া করে রেখেছেন? আমি মনে করি আমাদের একাডেমিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব রাজনৈতিক অঙ্গনে গিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। গোষ্ঠীতন্ত্র আর বলয়ের বেড়াজালে যারা আবদ্ধ তারাই অনর্থক মিথ্যার ফানুস উড়াতে ব্যস্ত।

আওয়ার ইসলাম: কওমি শিক্ষা সংস্কার না হওয়ায় কী কী ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: কওমি শিক্ষা সংস্কার না হওয়ায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে। যেমন :
(ক) আরবি ভাষা অপাংতেয় হয়ে পড়ে আছে।
(খ) যোগ্য ও যুগোপযোগী আলেম পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হচ্ছে না।
(গ) রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষার স্বীকৃতি না থাকায় মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থীরা সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করতে পারছে না।।
(ঘ) আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
(ঙ) দেশে চলমান স্যাকুলার শিক্ষার প্রভাব কাটিয়ে উঠার মত যথেষ্ট উপযুগী নয় বর্তমান কওমি সিলেবাস।

আওয়ার ইসলাম: -বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বারের দিকে আপনাদের অভিযোগের আঙুল ছিল। তার অবর্তমানে বেফাককে কি এখন উপযুক্ত মনে করছেন?

খতিব তাজুল ইসলাম: যিনি পদে থাকবেন তাকেই জবাবদিহি করতে হবে। ব্যক্তি আব্দুল জব্বার সাহেবের সাথে আমাদের কোন বিরোধ ছিলো না বা নেই। শুনেছি, বর্তমান বেফাক কর্তৃপক্ষ পূর্বের ভুল শোধরানোর কাজ শুরু করেছে। স্বীকৃতি নিয়েও চলছে একটা বোঝাপড়া। আমরা আখের ফলাফলের অপেক্ষায় আছি। সময়ই বলে দেবে আগামীর করণীয়। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।

আওয়ার ইসলাম: আপনি যা কামনা করেন সেরকম আখের ফলাফল কি খুব কাছাকাছি? 

খতিব তাজুল ইসলাম: ‘আস-সা‘ইয়ূ মিন্না ওয়াল ইতমামু মিনাল্লাহ’ আমরা আমাদের সাধ্যের ভেতর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। ফলাফলতো আল্লাহর হাতে। তবে দিকে দিকে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। কওমিতে সাধারণ জ্ঞানের পাঠদান ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে শুরু করেছেন। আমাদের রাহবারগণ যত তাড়াতাড়ি বিষয়টির নাজুকতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন তত ভাল। বিশেষ করে ঐক্যবদ্ধ কওমি বোর্ডের বিকল্প নেই। আমরা রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মত শিক্ষাবোর্ডকেও এক করে ফেলেছি যা কখনো কাম্য ছিলো না। আশাকরি সংশ্লিষ্ট সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।

khatib_tajul2

আওয়ার ইসলাম: ইসলামের প্রসারে আপনার আর কী কী কার্যক্রম রয়েছে?
খতিব তাজুল ইসলাম: বাংলাদেশের মত বিলেতেও আমার একটি দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। টিভিতে নিয়মিত ইসলামিক বিষয়ে ডিসকাশন করি। পাশে লেখালেখিতো আছেই। তাছাড়া www.komashisha.com এই ওয়েব সাইট পুরোটাই দ্বীনী খেদমতের জন্য নিবেদিত। বিশেষ করে কওমি অঙ্গনের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার এক অদ্বিতীয় ভাণ্ডার বলা যায়। আকাবির আসলাফের ধারাবাহিক জীবনী প্রকাশ হচ্ছে। দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি তুলে ধরা হচ্ছে। মেধাবীদের সাক্ষাৎকার আসছে। লন্ডন পেকাম জামে মসজিদের অনারারি খতিব হিসাবে আছি।

আওয়ার ইসলাম: সাধারণ মানুষের সেবায় আলেমগণ পিছিয়ে বলে মনে করা হয় এটাতে আপনি একমত?
খতীব তাজুল ইসলাম: সাধারণ মানুষদের জন্য ওলামায়ে কেরামের খেদমত খতম মিলাদ দোয়া তাবিজ জিয়ারত বিয়ে পড়ানো জানাজা ইত্যাদি তো আছে। দ্বীনী মাসআলা মাসাইল শিখানো ওয়াজ নসীহত ইমামতিতেও তারা আছেন। তবে সমাজের বৃহত্তর পরিমণ্ডল তাগুতের হাতে ছেড়ে দিয়ে এভাবে নির্দিষ্ট এই সেবাগুলো দিয়ে যাওয়া মোটেই যথেষ্ট নয়। বিপর্যয় যখন শুরু হবে ভূমিকম্পের মত তখন সকলকে গ্রাস করে নিবে। তাই যোগ্যতা দক্ষতা অর্জন করে বৃহত্তর পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ার বিকল্প নেই।

আওয়ার ইসলাম: আপনি সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে কোন কাজ করছেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসা। মানুষের এই মৌলিক পাঁচটি অধিকার আদায়ে কলমের পাশাপাশি বাস্তব জীবনেও তার প্রতিফলনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। হুইল চেয়ার বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, ফ্রি চক্ষু শিবির, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজে জড়িত আছি। অসহায়দের জন্য হাসপাতাল নির্মণের পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন।

আওয়ার ইসলাম: আজকের তরুণরা আরো বেশি ছন্নছাড়া এবং উদাসীন হয়ে পড়ছে, কারণ কী?
খতিব তাজুল ইসলাম: অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। না রাষ্ট্র না জাতি না দেশ না জাতীয় নেতৃবৃন্দ না উলামাগণ তরুণদের সঠিক রাহনুমায়ী করতে পারছেন। যে নিজেই স্বপ্ন জানে না সে অন্যকে স্বপ্ন দেখাবে কিভাবে? তরুণরা স্বপ্নাহত। তাদের সুপরিকল্পিত উজ্জল ভবিষ্যৎ না দেখাতে পারলে বিপদ আরো বাড়বে।

আওয়ার ইসলাম: তাদের জন্য আপনার কোন পরামর্শ?
খতিব তাজুল ইসলাম: বেকার মানে অসুস্থতা। অসুস্থতা মানেই সমস্যা। তাই তরুণদের এই সময়টাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সে কথা আমাদের ভাবতে হবে ব্যাপকভাবে। এইযে একটা স্লোগান ‘শিক্ষা শেষে চাকরি দে নইলে বেকার ভাতা দে’ এসব বুর্জোয়াদের কথা। আমাদের তরুণদের এমন শিক্ষা দিতে হবে যাতে সে নিজে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। অন্যের হাতের দিকে না চেয়ে নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। যে কোন বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। আজকাল উন্নত বিশ্বে অভিজ্ঞ দক্ষ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রচুর প্রয়োজন। তাই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি যে কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা খুব জরুরি।

আওয়ার ইসলাম: নামের শুরুতে ‘খতিব’ বিশেষণটি বেছে নিলেন কেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: আপনি প্রথম নয় আরো অনেকে এ প্রশ্নটি করেছেন। মাঝে মধ্যে হাসি পায়। আমি যদি মাওলানা লিখতাম হয়তো অনেকে স্বাভাবিক হিসেবে নিতো। কিন্তু তা পছন্দ করি না। খতিব তো কোন মুহাদ্দিস মুফাসসির এমন কোন ডিগ্রি না। যিনি বয়ান দেন বক্তৃতা করেন তাকে খতিব বলা হয়। বিশেষ করে জুমার খুতবা পাঠককেও খতিব বলে ডাকা হয়। যিনি দেওবন্দ পড়তে গেলেন নামের আগে পিছে কাসেমী। মদীনায় গেলে মাদানী। আল-আজহারে গেলে আজহারী। ফতোয়ার কামরায় ক‘দিন বসলে মুফতি। হজ্জ করলে আলহাজ্জ। তবে কেন জানি না যারা নিয়মিত নামাজ পড়েন রোজা রাখেন তাদের নামাজি রোজাদার বলে ডাকা হয় না। যাক আমার খতিব লকবের একটা ইতিহাস আছে। জুমার খেতাবত তো পুরোনা বিষয়। বিলেতের পত্রিকায় আগে নিয়মিত কলাম লিখতাম ‘খতিব তাজুল ইসলাম নামে। ইতিহাস হলো -শায়খুল হাদীস, আমার মুসলিম শরিফের উস্তাজুনাল মুকাররাম, আল্লামা নেজাম উদ্দীন হুজুর মরহুম একদিন লন্ডনে জুমার নামাজ পড়ানোর পর বললেন ‘আজ থেকে তোমাকে আমি খতিব উপাধি দিলাম।’ আমার উস্তাজের দেয়া লকব বলবো এখন আমার গায়ে। এছাড়া আর বিশেষ কিছু না।

khatib_tajul3

আওয়ার ইসলাম: বাংলাদেশ তো সুন্দর দেশ এইদেশ ছেড়ে লন্ডন গেলেন কেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: সারা পৃথিবীর মধ্যে সেরা মাটি হলো বাংলাদেশের মাটি। যাকে বলা হয় গোল্ডেন ল্যান্ড। কিন্তু এই গোল্ডেন ল্যান্ড এর এখন বিভিষীকাময় পরিস্থিতি। সবখানে নৈরাজ্যবাদীতাই যেন নিয়তি। আসলে শুধু বাংলাদেশ না গোটা মুসলিম বিশ্বের এ অবস্থা। মুসলমানদের দেশসমূহকে অশান্তিময় করে রাখা হয়েছে। তারা আজ নিজেদের জান নিয়ে আপন ভিটে মাটি ছেড়ে পালাচেছ। এরই ধারাবাহিক একটি অংশ হল আমার এখানে আসা।

আওয়ার ইসলাম: বসবাসের জন্য লন্ডন এবং বাংলাদেশ ফারাক কতটুকু?
খতিব তাজুল ইসলাম: বসবাসের জন্য দুনিয়ার জান্নাত বলা যায় লন্ডনকে। সামাজিক ন্যায় বিচার। মানবতা ও মানবিকতা উন্নত। বৃটেনের সামাজিক সিস্টেম অফিসিয়াল নিয়ম কানুন অসম্ভব সুন্দর ও মজবুত। বাস্তবিক অর্থে তারা তাদের দেশকে শান্তির দেশ হিসাবে গড়ে তুলেছে। সে অর্থে বৃটেনের সাথে বাংলাদেশের তুলনা হয় না।

তবে আদর্শিক দেউলিয়াপনাতো আছেই। ইসলামের ছোঁয়া যে অন্তরে নেই সেটা যতই চাক্যচিক্যময় হোক আসলে তা ধুসর।

আওয়ার ইসলাম: আমাদের ধর্ম পালন এবং তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখেন?
খতিব তাজুল ইসলাম: বিস্তর ফারাক। একলক্ষ ছাগলের মাঝে একটা বড় হরিণকে চিনতে যেমন কোন অসুবিধা হয় না তেমনি মুসলমানদের চাল চলন আলাদা। নামাজের ওয়াক্ত হলেই তো পরিচয় বেরিয়ে পড়ে কে কোন মতের ও পথের পথিক?

ইংরেজরা ধর্ম কর্মে নেই। শুধু বড়দিন আসলে গির্জায় যায় । তারা তাদের জীবনকে মেশিনের মত বানিয়ে নিয়েছে। তাদের কাছে ব্যক্তির চেয়ে জাতি বড়। দলের চেয়ে দেশ বড়। তারা খুব বেশি দেশপ্রেমিক।

 


সম্পর্কিত খবর