শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মাওলানা ওজিউল্লাহ; তিনি এ যুগেরই মানুষ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হানিফ আল হাদী
প্রবন্ধকার, অনুবাদক, ভাষা প্রশিক্ষক

wajiullahসদা হাসিমুখে আগে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসাকারী যে লোকটি গত ১১ জুলাই ২০১৬ সোমবার শাওয়ালের রোজা অবস্থায় কাকরাইলের গেইটে মাওলার ডাকে সাড়া দিলেন তিনি হজরতজী মাওলানা এন‘আমুল হাসান রহ.-এর পক্ষ থেকে হজরত মাওলানা সাঈদ খান সাহেব রহ.কে হাদিয়া দেওয়া “খাস চিজ”, উভয় হজরতের দীর্ঘ দিনের খাদেম, শাইখুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়্যা রহ.কে কবরে রাখনেওয়ালা, কারী তৈয়ব সাহেব রহ.-এর “সফিরে খাস”, ১০বছর মদিনা মুনাওয়ারায় মসজিদে নূর-এর মুকিম (যা মদিনার তাবলিগের মারকাজ হিসেবে ব্যবহৃত), অতঃপর আমৃত্যু মুকিম কাকরাইল মসজিদ, ২৮০০ ফুট উপর থেকে নিক্ষেপিত বেঁচে যাওয়া সাদাসিদা মানুষ মাওলানা ওজিউল্লাহ বিন আমজাদ আলী।

লেখা-পড়া শুরু হয় ফেনী, শর্শদী মাদরাসায়।মিজান ও নাহবেমীর পড়েন কুমিল্লা নূর মসজিদ মারকাজ মাদরাসায়। হেদায়েতুন্নাহু থেকে দাওরা (৭ বছর) সমাপ্ত করেন দিল্লি নিজামুদ্দীন মারকাজ মাদরাসায়। পরের বছর এক সালের তাশকিল হয়ে যান। সালের তিন মাস বাকি থাকতে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালীর আমির হাজী সেকান্দার সাহেবের ছোট কন্যারসাথে ৩৫০০ (তিন হাজার পাঁচশত) টাকা মোহরে টংগী ইজতেমায় হজরতজী মাওলানা এন‘আমুল হাসান রহ.-এর হাতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।৬৪ বছর বয়সে উক্ত স্ত্রী, ৪ ছেলে, ৩ মেয়ে ১৪ জন নাতী-নাতনী রেখে ইন্তেকাল করেন।

১৯৭১ সাল। পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। ওজিউল্লাহ কুমিল্লা নূর মসজিদ মারকাজ মাদরাসার ছাত্র। মসজিদের মুয়াজ্জিনও সে। শীতের রাত। ইশার আজান দিতে বের হলেন। আজানের মাঝেই শুরু হল হানাদার বাহিনীর বোম্বিং আর গুলি। মানুষ দিগি¦দিক জ্ঞান শূন্য। কুমিল্লা শহরের সকল দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হল মাদরাসার দরজাও। আজ ইশার জামাতে ওজিউল্লাহ একাই ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মুকতাদি। নামাজের অনেক পর বারুদের গন্ধ বাড়লেও গোলার আওয়াজ কমে এল। ধীরে ধীরে পা-টিপে মাদরাসা ঘরে এলেন। ওজিউল্লাহ শহিদ হয়ে গেছে ধারণায় সকলেই আফসোস করতে করতে ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকলে কষ্ট হবে ভেবে সারা রাত মুহতামিম সাহেবের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন কিন্তু আওয়াজ করলেন না। ফজরের সময় হয়ে গেলে “ফজরের সময় হয়েছে; ঘুম থেকে উঠুন” আওয়াজ দিলেন।

ওজিউল্লাহর গলা শুনে মুহতামিম সাহেব হতবাক! বিহ্বলতা কাটিয়ে দরজা খুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ছাত্রকে। লাশ পাওয়া গেলে সকালে যার জানাজা পড়ার দহনে সারা রাত দাহিত হয়েছেন, আদর করে দরবেশ নাম দেওয়া সেই ওজিউল্লাহ বুকে! “এতো গোলাগুলি হল; আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন?!তুমি তো দরবেশ! তুমি বাঁচবে না কেন?! দরবেশকে আল্লাহ বাঁচিয়েই রাখবেন।”

নূর মসজিদ জেলা মারকাজ হওয়ায় প্রায়ই একজন মহান ব্যক্তির আলোচনা শুনেন। সবাই তাকে বলে “হজরতজী”। তিনি দিল্লি নিজামুদ্দীনে থাকেন। মিজান পড়ুয়া ওজিউল্লাহর মনে হজরতজীকে দেখার সাধের বীজ বপিত হয়। আস্তে আস্তে চারা গজিয়ে নাহবেমীরের শেষ দিকে তা ডালপালাসহ পূর্ণ গাছ। ফুলও ফুটেছে। আর তো সয় না।

সন্তানের সকল আশা-আকাক্সক্ষার আশ্রয়স্থল মায়ের আঁচল। ওজিউল্লাহর সাধও সেখানেই আশ্রয় খুঁজে পেল। ছেলে হিন্দুস্থান যেতে চায় শুনে গ্রাম বাংলার অন্য দশটা সহজ-সরল মায়ের মতোই জিজ্ঞাসা করলেন- যেখানে হিন্দুরা থাকে সেখানে যাবা কেন? আমি যাব। হজরতজীকে দেখতে যাব। অর্থাভাবের কথা চিন্তা করে বাবা রাজি হচ্ছিলেন না। ছেলের পীড়াপীড়িতে আট আনা (পঞ্চাশ পয়সা) হাতে তুলে দিলেন। ভগ্নিপতি স্বচ্ছল ছিলেন। ফুফু, মা সব মিলে ৫০-৬০ টাকা জোগাড় হল। নিজামুদ্দীনগামী একটি জামাতের সাথে হজরতজীকে দেখার অদম্যস্পৃহা-বিজয়ী কিশোর ওজিউল্লাহও রওনা করল। তিনদিন সফরের পর ইফতারির পূর্ব মুহূর্তে কাফেলা পৌঁছল নিজামুদ্দীন। মসজিদের এক কোণে কাপড় দিয়ে পর্দা টানানো। ইফতারি ছুঁই ছুঁই, দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত, এই বুঝি স্বপ্ন পূরণ হয় হয় কল্পনায় বিভোর কিশোরের অত কিছু ভাবনার সময় কই? সোজা পর্দার ভিতরে ঢুকে খুব সাদাসিদা তবে পরিপাটি বিছানাটির মাথার দিকে নিজের ব্যাগ নামিয়ে অজুতে চলে গেলেন। সেরে আসার পর বিছানায় বসা শুভ্র সুন্দর গাম্ভীর্যপূর্ণ শান্ত মানুষটি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? কেন এসেছ? ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দু যা জানতেন তাতেই উত্তর দিলেন, আমি ওজিউল্লাহ। বাঙ্গাল থেকে এসেছি। হজরতজীকে দেখতে এসেছি। আচ্ছা...! হজরতজীকে দেখতে এসেছ?! হজরতজীকে দেখতে এসেছ?!! হজরতজীকে দেখতে এসেছ?!!! জ্বি, হজরতজীকে দেখতে এসেছি। যতটা সহজ-সরল হলেএখনো বুঝে না যে, যার সাথে কথা হচ্ছে তিনিই তার স্বপ্নপুরুষ মাওলানা এন‘আমুল হাসান হজরতজী। কিশোর ওজিউল্লাহ ততটাই সহজ-সরল ছিলেন। ঠিক আছে। তোমার বিছানা এখানেই রাখ। আমাদের সাথেই তুমি খানা খাবে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা শত ইতিকাফকারী উতরে হজরতজীর পাশেই জায়াগা পেল ওজিউল্লাহ। অন্তরের মুহাব্বতের প্রতিদানমুহাব্বত দানকারী প্রভু বুঝি এভাবেই দান করেন। অন্যদের দেখাদেখি তিনিও হাতে-পায়ে-মাথায় তেল লাগাতে শুরু করলেন।

ইঞ্জিনিয়ার হাজী আব্দুল মুকিত সাহেব, মাওলানা মুনির সাহেব, মাওলানা লুৎফুর রহমান সাহেবসহ বড়রা অনেকেই তখন ইতিকাফের উদ্দেশ্যে নিজামুদ্দীন। হাজী সাহেব মুনির সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন ছেলেটা কে? এত ছোট ছেলে এখানে ঢুকল কিভাবে? মুনির সাহেব কুমিল্লা নাঙ্গলকোটের আমজাদ ভাইয়ের ছেলে “হজরতজীকে দেখতে এত দূর” জেনে বিস্ময়ে হতবাক ও আনন্দে শোকরগুজার হলেন। আমজাদ আলী সাহেব পুরান মেহনতের সাথী হওয়ায় মুরব্বীরা প্রায় সবাই তাকে চিনতেন। মুনির সাহেব খেদমতের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করলেন। উৎসাহ দিলেন। হাজী সাহেবের পরামর্শে বিশ দিনের জন্য তাশকিলও হলেন। রোখ পড়ল সাহারানপুর। সময় শেষ করে আসতে আসতে ঈদ পেরিয়ে মাদরাসায় ভর্তির সময় চলছে। মুনির সাহেবরা তখনও নিজামুদ্দীন। এখানেই ভর্তি হয়ে যেতে খুব উৎসাহ দিলেন। মায়ের কান্না ও টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার অজুহাত দিলে মুনির সাহেব ত্রিশ ও লুৎফুর রহমান সাহেব বিশ টাকা দিয়ে জোড় তাকিদ দিলেন এখানেই পড়। শিখিয়ে দিলেন রাতে তেল লাগানোর সময় হজরতজীকে বলবে। মায়ের জন্য মন কাঁদলেও, অন্তর থেকে সায় না পেলেও দুইজন মুরুব্বির আদেশ ফেলে দিতে পারলেন না। রাতে তেল লাগানোর সুযোগে হজরতজীকে কথাটা বললেন। আচ্ছা...! তুমি এখানে পড়বে!! এখানে পড়বে!!! সকালে সাক্ষাতের আদেশ দিয়ে বিদায় দিলেন।

মাদরাসার দফতরে গিয়ে নিজের কথা বলে প্যাডের জন্য পাঠালেন মুন্সি বশির সাহেবের নিকট। প্যাডে লিখলেন, “বাঙ্গালের বাসিন্দা ওজিউল্লাহ বিন আমজাদ আলী; তার থাকা-খাওয়া ও আনুষঙ্গিক সব কিছুর জিম্মাদার এন‘আমুল হাসান, মাদরাসা কাশিফুল উলুম নিজমুদ্দীন, বাংলাওয়ালী মসজিদ, দিল্লি।” সহির উপর নিজের একটা সিলও দিয়ে দিলেন। মাদরাসার আসাতিজায়ে কেরামের মধ্যে একটাই প্রশ্ন “ছেলেটা কে?” যার জিম্মাদার হলেন হজরতজী নিজে। যেমনটি তারা কখনো দেখেনি। ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় উসতায মাওলানা ইউসুফ সিলোনী হজরতজীর চিঠিসহ পাসপোর্ট দিয়ে পাঠালেন ভিসা অফিসে। কর্মকর্তা ভগওয়াত শিং হজরতজীর চিঠি দেখে বারবার বলতে লাগল, তুমি বড়ই ভাগ্যবান মানুষ। আদর-আপ্যায়ন করে অতিরিক্ত নিয়ম না থাকায় ছয় মাসের ভিসা দিয়ে হজরতজীর চিঠির একটি কপি রেখে দিল। যখনই আপনার পাসপোর্ট পাঠাবেন ৬ মাসের ভিসা হয়ে যাবে। ছাত্র জীবনের সাত বছর ভিসার এ ধারাবাহিকতা চালু ছিল। ভিসা অফিসে বাড়তি কদর হিসেবে পেতেন মারকাজ থেকে যে কোন বাঙ্গালী সাথীর পাসপোর্ট নিয়ে গেলে খুব সহজেই ঝামেলা চুকানোর সুযোগ। তবে সকল সুযোগের বড় সুযোগ হজরতজীর খেদমতের এই ধারাবাহিকতাও চালু রাখলেন নিজামুদ্দীনের (ছাত্র জীবনের) শেষ পর্যন্ত।

দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম হজরত মাওলানা কারী তৈয়ব সাহেব রহ. একবার কোন উদ্দেশ্যে হজরতজী মাওলানা এন‘আমুল হাসান রহ.-এর সাথে সাক্ষাত করতে নিজামুদ্দীন এলেন। সাক্ষাতকালে শুধু হজরতজীকে দেখতে বাঙ্গাল থেকে ছুটে আসা সেই আশেক তার প্রিয় মানুষটির খেদমতে ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর কারী তৈয়ব সাহেব রহ. বললেন, তুমি দেশে যাওয়ার সময় আমার সাথে সাক্ষাত করে যাবা। রমজানের ছুটিতে দেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার সময় হজরতজী নিজেই স্মরণ করিয়ে দিলেন, ওজিউল্লাহ কারী তৈয়ব সাহেবের সাথে সাক্ষাতের কথা মনে আছে তো?
কারী তৈয়ব সাহেব রহ. খুব মেহমানদারী করলেন এবং বললেন, বাংলাদেশে আমার একজন খাস দোস্ত আছে। মাওলানা আতাহার আলী সাহেব।

একটি প্যাকেট দিয়ে বললেন, এটা আমার খাস দোস্তের জন্য হাদিয়া। সাথে একটি চিঠিও দিলেন। অন্য একটি প্যাকেট দিয়ে বললেন, এটা তোমার হাদিয়া। তিনি দেশে ফিরে বাড়ি না গিয়ে প্রথমেই গেলেন কিশোরগঞ্জ। মাওলানা আতাহার আলী রহ.কে হাদিয়া ও চিঠি পৌঁছানোর পর চিঠি পড়তে পড়তে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন ও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘক্ষণ জড়িয়ে রেখে বললেন, আপনি আমার দোস্তের নিকট থেকে এসেছেন। আমার দোস্ত লিখেছে, “আমি আমার এক ‘খাস সফির’ (বিশেষ দূত) মারফত আপনাকে এই হাদিয়া পাঠালাম।” আপনি আমার দোস্তের খাস সফির। আপনার মেহমানদারিআমার জিম্মাদারী। তখনকার সেই ওজিউল্লাহএকজন তালিবুল ইলম। হজরত মাওলানা আতহার আলী রহ. পূর্ণ তিনদিন নিজ হাতে তার সর্বোচ্চ মেহমানদারী করলেন। এরপর ঐ হাদিয়ারই কিছু অংশ হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর নিকট হাদিয়া হিসেবে পাঠালেন। সব শুনে হাফেজ্জী হুজুরও সেইভাবে মোআনাকা করলেন। তিনদিন মেহমানদারী করলেন। তৈয়ব সাহেব রহ.-এর জন্য হাদিয়ার একটি প্যাকেট দিয়ে বিদায় দিলেন। হজরত মাওলানা প্রায়ই বলতেন, কারী তৈয়ব সাহেব আমাকে ‘খাস সফির’ লিখেছেন; এটা হজরতজীর খেদমতের বরকত। এটা আমার একটা পরম সৌভাগ্য। আরো একটি সৌভাগ্যের কথা বলতেন, শাইখুল হাদিস হজরত মাওলানা যাকারিয়্যা রহ. মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তখন আমি খান সাহেবের খেদমতে মদিনায় ছিলাম। আমিই একমাত্র বাঙ্গালী যে শাইখুল হাদিস সাহেবের কাফন-দাফনে পূর্ণ শরিফ ছিলাম এবং জান্নাতুল বাকির মাটিতে তাঁর মাথাটা আমি নিজ হাতে রেখেছি। শাইখুল হাদিস রহ. নিজমুদ্দীন আসলে কাশিফুল উলুম-এ হাদিসের দরস দিতেন। এ সুবাদে হজরত মাওলানা তাঁর ছাত্রও ছিলেন।

নিজামুদ্দীনে পড়াকালে তালিবুল ইলমদের ওপর থাকা মারকাজের রুটি বানানোর মধ্যে পারদর্শিতা ও সব সময় জিম্মাদারির সাথে অংশগ্রহণেওজিউল্লাহর জুড়ি মেলা ভার। মুফতি ওবায়দুল্লাহ সাহেব, মাওলানা হারুন সাহেব (মাওলানা সা‘দ সাহেবের আব্বা), মাওলানা এজহারুল হাসান সাহেব প্রমুখের খেদমতেও সবার আগে ওজিউল্লাহর লাব্বাইক শোনা যেত। প্রতিরাতে হজরতজীর মাথায় তেল লাগানোসহ অন্যান্য খেদমত- সে পুরানো রুটিন তো আছেই। আবার দরসের উপস্থিতিও ঠিকঠাক। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে সবাই বলত “ওজিউল্লাহ তো জিন”।
মেশকাত পর্যন্ত জামা ছিল একটাই। দাওরার বছর একাধিক তালি, পুরান হয়ে পাতলা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করে মাওলানা হারুন সাহেব রহ. জিজ্ঞেস করলেন, ওজিউল্লাহ তোমার কাপড় নেই? ঝটপট উত্তর হজরত, এটা তো আছে। ২০ রুপি দিয়ে বললেন, জামা কিনে নিও। মারকাজের বাইরে পুরান কাপড়ের দোকান থেকে ৮ রুপির বিনিময় এক তালি লাগান একটি জামা কিনলেন। দরসে বসার পর, ওজিউল্লাহ তুমি কাপড় কিন নাই?হজরত এটা (গায়ে দেখিয়ে) কিনেছি। এটা তো পুরান?হজরত এটা দিয়েও জীবনের সময় কেটে যাবে।কত দিয়ে কিনেছ? ৮ রুপি।বাকি রুপি দিয়ে কী করলে?বাকি ১২ রুপি তো আপনার কিতাবের নিচে রেখে এসেছি, হজরত। পাঁচ-সাত রুপির অভাবে যে জামা কিনতে পারে না। ছয় বৎসর কেটে যায় এক জামায়। সে কি-না আবার হাদিয়া পাওয়া ১২ রুপি ফেরত দিয়ে আসে। তখনকার নিজামুদ্দীনে কি বিশ রুপি তে ভাল জামার ব্যবস্থা ছিল না? সৃষ্টিগতভাবে তো তার ভেতরও দুনিয়ার মুহাব্বত দেওয়া হয়েছিল? নূর মসজিদ মাদরাসার মুহতামিম সাহেবের আদরের দরবেশ, আসলেই একজন বড় দরবেশ ছিলেন।

একবার মদিনার তাবলিগের আমির, হজরত মাওলানা ইলিয়াছ রহ.-এর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মাওলানা সাঈদ খান সাহেব রহ. নিজামুদ্দীন এলে পায়ে ব্যথা থাকায় এই খাদেমকে সাথে নিয়েই হজরতজী তাঁর সাথে মোলাকাত করতে গেলেন। ভাই সাঈদ! আমি আপনাকে একটা বিশেষ জিনিস হাদিয়া দিতে চাই। অবশ্যই, আপনার হাদিয়ার স্থান তো হল আমার মাথার উপর। নিচের হাতটি সাঈদ খান সাহেবের, উপরে হজরতজীর হাত। মাঝে ঐ বিশেষ জিনিস হল ওজিউল্লাহর হাত। আমি আমার এই ‘খাস খাদেম’ ওজিউল্লাহকে হাদিয়া দিলাম। আমি আনন্দ চিত্তে আপনার হাদিয়া কবুল করলাম। মাওলানা ওজিউল্লাহ রহ. সেই যে খান সাহেবের হাত ধরলেন এই হাত আর কোন দিন ছাড়েননি। ‘সাল’ পুরা করে অল্প কিছু দিন কাকরাইল মাদরাসায়ে দ্বীনিয়্যাহ-এ খেদমতের পর খান সাহেবের খেদমতে মদিনা মুনাওয়ারায় গিয়েছেন আর লাগাতার ১০ বছর শাইখের খেদমতে কাটিয়ে ১৯৮৫ সালে দেশে ফিরেছেন। বাকি জীবনও খান সাহেবের প্রতিচ্ছবি ছিলেন। মারকাজের মশোয়ারা তথা যে কোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বলতেন, “একবার এ ধরনের হালতে খান সাহেব রহ.কে এই বলতে শুনেছি/ এরূপ করতে দেখেছি।” এর বাইরে নিজের কোন রায় পেশ করেছেন এমন স্মৃতি কারো কাছে নেই।

কাকরাইল থেকে ২২ জনের একটি কাফেলা রওনা করল মদিনায়। মসজিদে নূর-এ। উদ্দেশ্য দাওয়াতের মেহনত। কিন্তু কিছু হালতের কারণে একে একে সবাই কোন না কোন পেশা বেছে নিলেন। কী অসুবিধা? উপার্জনও করবেন, ফাঁকে ফাঁকে মেহনতও করবেন। বাকি রইলেন শুধু মাওলানা ওজিউল্লাহ। জিম্মাদার মাওলানা সাঈদ খান সাহেব রহ. ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন ওজিউল্লাহ তুমি যাবে না? সবাই তো চলে গেল। হজরত আমি আপনার খেদমতে রয়ে গেছি। আমি কোথাও যাব না। খান সাহেব রহ. বললেন, দরজা বন্ধ করে দাও। কাছে আস। ঘরের এক কোণে ইশারা করে বললেন, এটা হল তাদের স্থান আর তোমার স্থান হল আমার অন্তরে। আমি খেলে তুমি খাবে। আমি উপোস থাকলে তুমিও উপোস থাকবে রাজি আছ?অবশ্যই। ইন্শা‘আল্লাহ তাই হবে।

খান সাহেব রহ. বাংলাদেশ সফরকালে দুইবার তাঁর গ্রামের বাড়ি বালিয়াপুর(হাজী বাড়ী), মকরবপুর, নাঙ্গলকোট গিয়েছেন। হাজী ইঞ্জিনিয়ার আ. মুকিত রহ. আলমী ফিকিরের স্বার্থে না যাওয়ার পরামর্শ দিলে বলেছিলেন, যে পিতা এ সন্তান জন্ম দিয়েছে তাকে দেখতে যাব। ওনার স্ত্রীকে খান সাহেব সব সময় নিজের মেয়ে বলে উল্লেখ করতেন। বলতেন, আমার দুই মেয়ে একজন মদিনায় অপরজন বাংলাদেশে। হজরত মাওলানা দেশে আসার সময় মেয়ের জন্য আলাদা হাদিয়া পাঠাতেন।

খান সাহেবের তাশকিলে দ্বিতীয় বার যখন তুরস্ক সফরে যাবেন, হেদায়েতের বয়ানে খান সাহেব রহ. বলে দিলেন, হয়ত আপনাদের ইন্তেকাল হয়ে যাবে অথবা যে কোনভাবেই হোক ওয়াক্ত পুরা করে মদিনায় ফিরবেন। ৩ সাথীর কাফেলা ছিল। এবারও তিনি পূর্বের মতোপুলিশের হাতে বন্দি হলেন। তবে এবার জেল না দিয়ে একটি পুলিশ ভ্যানে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হল পাহাড়ে। ২৮০০ ফুট উপর থেকে একটি জনমানবহীন নিচু প্রান্তরেলরির ধাক্কায় ভ্যানটি নিচে ফেলে দিল। ওরা নিশ্চিত তিনজনই যমের সাক্ষাত লাভ করেছে। ভ্যানটিও নিশ্চয়ই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। এই ছিন্ন-ভিন্ন তিন ভিনদেশীর মরদেহ আর খণ্ডবিখণ্ড ভ্যানটির খোঁজ নেওয়ার যৌক্তিকতা ছিল না; তাদের নিকট। কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামিনের ইশারা যে সকল যৌক্তিকতার চেয়ে ২৮০০ ফুটেরও অনেক অনেক ঊর্ধ্বে সে খবর রাখে কে?

হজরত মাওলানা বলেন, “আমরা তিনজনই পরিপূর্ণ অক্ষত ছিলাম। এমনকি আমাদের সামানাপত্রেরও কোন ক্ষতি হয়নি। নিঃসন্দেহে এটা খান সাহেবের শিখিয়ে দেওয়া আমলের বরকত। হেদায়েতী কথায় তিনি আমাদের বলেছিলেন, যে কোন যানবাহনে চড়ার সময় অবশ্যই সুরা জুমারের ৬৭ নং আয়াতটিপাঠ করবে।এরপর আমরা বহু কষ্টে পাহাড়ে ওঠলাম। ফোনে তুরস্ক মারকাজের সাথে যোগাযোগ করলাম। মারকাজ থেকে বলা হল, দয়া করে আমাদের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবেন না। আপনারা ফিরে যান। আর যদি ওয়াক্ত পুরা করতেই চান- অন্য কোনভাবে পুরা করুন। তখন আমরা মশোয়ারা করলাম। সিদ্ধান্ত হল, হায়াত থাকতে ওয়াক্ত পুরা না করে ফিরব না। মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তাঁর রহমতের আশা করে আমরা চলে গেলাম সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলেএবং সেখানেই দাওয়াতের আমল শুরু করলাম। ওয়াক্ত পুরা হলে যখন মদিনার উদ্দেশে তুরস্ক বিমানবন্দরে পৌঁছি, সকল কর্মকর্তা বিস্ময়ে হতবাক!” তখন হয়ত তাদের বিশ্বাস হয়েছে আমাদের যৌক্তিকতার ঊর্ধ্বেও কিছু একটা আছে! এই কিছু একটাই হলো- কুদরতে এলাহী। এ সফরে হজরত মাওলানা ওজিউল্লাহ সাহেবের অপর দুই সাথী ছিলেন ভাই মারজান পাকিস্তানী, অপর সাথী ছিলেন হিন্দুস্তানী।হজরত মাওলানার জীবনে তুরস্কে সফর ছিল মোট ১১ বার। এটা ছিল দ্বিতীয় বারের ঘটনা। আর প্রথমবার জেলে ছিলেন সাত দিন। এছাড়া এই দাওয়াত ও তাবলিগের সুবাদে তিনি মদিনায়ও একবার জেলে ছিলেন।

খান সাহেব রহ.-এর ইন্তেকালের পর হজরত মাওলানার সাথে স্বপ্নযোগে একদিন মোলাকাত হয়। তিনি জামার উপর ধবধবে সাদা একটি ছদরিয়্যাহ (কটি) পরা ছিলেন। ছদরিয়্যার দুই পকেটে দুই হাত দিয়ে এক পকেট থেকে দুটি নোট বুক যাতে সারা আলমের সাথীদের নাম লেখা ছিল, অন্য পকেট থেকে কিছু ডলার বের করলেন। হজরত মাওলানাকে দিয়ে বললেন, এই নাও, সারা দুনিয়ার সাথীদের নাম দিয়ে দিলাম। দাওয়াত নিয়ে তুমি সফর করতে থাক। আর এগুলোও (ডলার) রাখ সফরে কাজে লাগবে। এই স্বপ্নের পর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হজরত মাওলানা অধিকাংশ সময় সফরেই ছিলেন।
হজরত মাওলানা জীবনে দীর্ঘ সময় বিদেশ সফরে কাটিয়েছেন। প্রায় শতবার বিদেশ সফরের সৌভাগ্য আল্লাহ তাকে দান করেছেন। ২১ বার হজ্জে বাইতুল্লাহ ও জিয়ারতে মদিনার সুযোগও লাভ করেছেন। ওমরাহ করেছেন ২০০ বারের অধিক।

প্রিয় পাঠক! আপনার মনে হয়ত প্রশ্ন জেগে থাকবে, সব তো বুঝলাম কিন্তু তিনি তার কর্ম জীবনে কী করতেন? এই মানুষটিকে আমি কখনো দেখিনি। ইন্তেকালের পূর্বে তাকে জানতামও না। জীবনী নিয়ে কাজ শুরুর পর যার সাথেই কথা বলি অনেক কিছুই বলে; কিন্তু কর্ম জীবন/ আয়-উপার্জনের নিমিত্তে কোন পেশা বা কাজ বলে আলাদা কিছু পাই না। তাই আমার মনেও বার বার এ প্রশ্নটা ঘুরছিল। মুরুব্বিদের খেদমত আর দাওয়াত ছাড়া তার কর্মজীবন বলতে কিছু নাই। সাল শেষ হওয়ার পর অল্প কিছুদিন কাকরাইল মারকাজে শিক্ষকতা করেছেন। তবে মারকাজের অন্য মুকিমদের মতোই মাদরাসার খাদেম বা শিক্ষকদেরও কোন বেতন-ভাতার ইনতিজাম মারকাজে নাই। এরপর চলে গেলেন মদিনায় খান সাহেবের খেদমতে। ১০ বছর পর মদিনা থেকে ফিরে কাকরাইলের মুকিম হিসেবে ছিলেন আমৃত্যু। তাছাড়া এ সময়টাতে ছিলেন সফরে। টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে কাজ বলতে আমরা যা বুঝি; মদিনায় মসজিদে নূর-এ থাকাকালে এক মাকতাবা থেকে প্রস্তাব এসেছিল আরবি প্রুফ দেখে দেওয়ার। ভাবলেন যখন অবসর থাকি করলাম। আড়াই ঘণ্টা কাজ করেছিলেন যার বিনিময় পেয়েছিলেন কিছু রিয়াল। হজরত মাওলানা সাঈদ খান সাহেব জানতে পেরে বললেন, “মানুষ মদিনায় আসে ফয়েজ-বরকত হাসিলের জন্য আর তুমি মদিনায় এসে টাকার পিছনে পড়েছ?”খান সাহেবের কথা মত ঐ টাকা সদকাহ করে দেন।যদি আয় রোজগারের কথা বলতে হয় তো এই আড়াই ঘণ্টার বাইরে আর কিছু বলা সম্ভব নয়। তিনি প্রায় সময় বলতেন,“বান্দার দানে কুলায় না/ আল্লাহর দান ফুরায় না।”মুসতাজাবুদ্ দাওয়াহ এই বুজুর্গ নিজ এলাকায় রাস্তাঘাট পাকা, কালভার্ট তৈরি, বিদ্যুৎ আনার ব্যবস্থা, একাধিক মাদরাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা করাসহ বিভিন্ন প্রকার খেদমতে খালকের সাথেও জড়িত ছিলেন।

রোববার দিবাগত রাত। রাত দুইটায় বিছানা ত্যাগ করেন। তাহাজ্জুদ, জিকির ও সাহরিতে ফজর হয়ে যায়। ফজরের পর কাকরাইলের মশোয়ারা কামরায় ইশরাক পর্যন্ত তাসবিহাত আদায় করে ইশরাকের পর কোন জরুরতে বাইরে বের হন। নিচ তলায় ইস্তেকবালের সাথীদের সাথে ইন্তেকালের পাঁচ-সাত মিনিট পূর্বে তিনটি কথা বলেন। ক) যার দিলে যাররাহ বরাবর রিয়া/ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে যাবে না। খ) যার দিলে যাররাহ বরাবর শিরক থাকবে সে জান্নাতে যাবে না। গ) যার দিলে যাররাহ বরাবর হাসাদ (হিংসা) থাকবে সে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত থাকবে। আলহামদুলিল্লাহ আমার দিল এ তিনটা থেকে মুক্ত আছে। এরপর দক্ষিণ পাশের মাস্তুরাতের গেইটে কাকরাইলের গাড়িচালক ভাই আলাউদ্দিনের সাথে সন্ধ্যারাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া বিষয়ে কথা বলছিলেন। এমন সময় পুলিশ রিকোজিশনের একটি বাস ব্রেক ফেল করে ফুটপথে উঠে ধাক্কা মারলে হজরত মাওলানা পড়ে যান। মাথার পিছন দিকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। উপস্থিত সবাই তিনবার সশব্দে “আল্লাহ” বলতে শুনেন। যার কাছে রওনা করলেন তিনবার তাঁর নামের পর আর কেউ কোন শব্দ শুনেনি। দ্রুত খিদমাহ হাসপাতালে নিয়ে গেলে অবস্থার গুরুতরতা বিবেচনায় কর্তব্যরত ডাক্তার ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন। মেডিকেলের জরুরি বিভাগ থেকে বলা হয় রোগী ইতিমধ্যেই অন্য জগতে চলে গিয়েছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

কাকরাইল মসজিদে জানাজা শেষে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে। দাফন কার্জ সমাধা হতে হতে ১১ জুলাই ২০১৬ সোমবারের সূর্য অস্ত যাই যাই করছে। কোন প্রকারের উপায়-উপকরণহীন পূর্ণাঙ্গ আল্লাহ তা‘আলার জাতের ওপর ভরসার এক আলোকজ্জ্বলসূর্য ও পৃথিবীর সূর্য যেন সেদিন একত্রে অস্তমিত হল। তিনদিন পর মাওলানা মুনির বিন ইউসুফ সাহেবের সাথে মু‘আনাকা হয় ঐ মশোয়ারা কামরায়। অবস্থা জিজ্ঞাসা করলে সেই একই রকম প্রাণখোলা মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, আল্লাহ আমাকে ইফতার করিয়েছেন।

নোট : হজরত মাওলানার পূর্ণাঙ্গ জীবনীর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। আপনার কাছে তার কোন স্মৃতি থাকলে, কখনো কোন সফর বা অন্যভাবে তার সাথে সময় কাটিয়ে থাকলে অনুগ্রহপূর্বক আমাদের জানালে কৃতজ্ঞ থাকব। ০১৮১৯৪৭৭৮৮৬/০১৫৫৩৩৪৪৬৬০/ hanifalhadi@gmail.com

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ