মাওলানা মামুনুল হক
সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি কথা সংশ্লিষ্ট সকলের খেদমতে পেশ করছি-
এক.
তা'লীম, ইমামত, আযানসহ যে কোনো নেক কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহন করা জায়েয কিনা বিষয়টি নিয়ে ইসলামের মহামাণ্য ইমামদের মাঝে মতপার্থক্য আছে ৷ হানাফী ইমামদের মতে কোনো ধরনের পারিশ্রমিক গ্রহন করা না জায়েয ৷ অবশ্য পরবর্তি যুগের হানাফী ইমামগণ যুগের পরিবর্তন ও মানুষের হালাতের অধঃপতনের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেক কাজের বিনিময় গ্রহন করাকে জায়েয বলেছেন ৷ সেটাও কেবল এমন কাজের জন্য, যা ছাড়া ঈমান-ইসলাম টিকে থাকা কঠিন এবং পারিশ্রমিক দিয়ে লোক নিয়োগ না দিলে সে কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম পাবে না ৷ পরিণামে দ্বীনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ার আশংকা দেখা দিবে ৷ যেমন, মসজিদের ইমাম, মুআজ্জিন প্রভৃতি দায়িত্ব ৷ দ্বীনের তা'লীমও এমনই এক জরূরী কাজ, যার জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লোক নিয়োগ করা যেতে পারে ৷ এই মাসআলার আলোকেই মাদরাসায় বেতনভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে ৷
দুই.
ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে সমাজের দ্বীনী প্রয়োজন পুরন করাও দ্বীনের জরূরী একটি শাখা ৷ আমাদের অঞ্চলে আবহমান কাল থেকে এই খেদমতের মাধ্যমে ইসলামের বহুবিধ তাকাযা পুরা হচ্ছে ৷ বর্তমান এই অধঃপতনের সময়েও এই খেদমতের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য ৷ তা ছাড়া নিয়মিত শিক্ষকতার মত এটিও এক ভিন্ন খেদমতের ময়দান, যার জন্য উপযুক্ত ও যোগ্য লোক নিয়োজিত হওয়া চাই ৷ এই খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের প্রচূর সময়ও ব্যয় হয়, যে সময়ে ইচ্ছা করলে তারা জীবন-জীবিকা উপার্জন করতে পারতেন ৷ এই সময়দানের বিনিময়ে তাদেরকে পারিশ্রমিক দেয়া যেতেই পারে এবং দেয়াও উচিৎ ৷ নইলে এই ময়দানে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়ে সমূহ সমস্যা দেখা দিতে পারে ৷
তিন.
আমাদের অনেক আকাবির ওলামায়ে কেরামকে ওয়াজের হাদিয়া দেয়া হলে তা গ্রহণ করতেন ৷ আবার অনেকে গ্রহন করতেন না ৷ এখনও অনেকে আছেন যারা ওয়াজের হাদিয়া নেন না ৷ তবে অনেককে আবার এমনও দেখা যায় যে, হাদিয়া নেন না ঠিক, কিন্তু তার যাতায়াতসহ অন্যান্য ব্যবস্থা করতে হয় ৷ আর এমন ব্যবস্থাই করতে হয় যে, সেই তুলনায় হাদিয়া নিলেই বরং আয়োজকদের সাশ্রয় হত ৷
সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় ওয়াজের জন্য হাদিয়ার নামে পারিশ্রমিক আদান-প্রদান করাকে খারাপ নজরে দেখার সুযোগ নেই ৷ এই পারিশ্রমিকটা সময়দানের বিনিময় হবে ৷ আর যাতায়াতের ব্যয়ভার তো বহন করতেই হবে ৷
চার.
দ্বীনী কাজে দায়িত্ব পালনের জন্য যে পারিশ্রমিক দেয়া হয় সেটা এক দিকে কাজের বিনিময়, অন্য দিকে দ্বীনী কাজে আবদ্ধ থাকায় জীবিকা উপার্জন করতে না পারার কারণে তার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের আয়োজন ৷ সুতরাং ওয়াজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক আদান-প্রদান বৈধ হলেও এটা নিছক কোনো পণ্য বিক্রির মূল্যের মত হতে পারে না ৷ আমাদের আকাবির-আসলাফগণ এভাবে কখনই বিবেচনা করেন নি ৷ বরং এটাকে মাদরাসার শিক্ষকতা বা মসজিদের ইমামতের মত সন্মানজনক ও ভদ্রতাসুলভ দায়িত্ব হিসাবে গ্রহন করতে হবে ৷
মাদরাসা থেকে শিক্ষকদেরকে বেতন দেয়া হয় ৷ শিক্ষকগণ বেতন গ্রহনও করেন এবং বেতন দেয়া-নেয়ার পদ্ধতিকে মাদরাসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য জরূরীও সাব্যস্থ করেছেন হযরত থানবী রাহিমাহুল্লাহসহ অনেক আকাবির ওলামায়ে কেরাম ৷ কিন্তু তাই বলে মাদরাসার বেতন নিয়ে দর কষাকষি বা বেশি চাহিদা পেশ করাকে কখনও ভালো নজরে দেখা হয় নি এবং আজও দেখা হয় না ৷ বরং মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যে পরিমান বেতন-ভাতা ধার্য করেন তার উপরই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ৷ এভাবেই তো চলছে দ্বীনের কাজ ৷ মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে নসীহত করা হয়, উস্তাদদের হাজত পুরা করার চেষ্টা করতে, সেটা ভিন্ন কথা ৷
ওয়াজের হাদিয়াও কি এমনই হওয়া উচিৎ না? পণ্য কেনা বেচার মত দরদাম করে, বায়না বা অগ্রিম বুকিং মানি নিয়ে তারপর পেমেন্টের জন্য সিসটেম ধরিয়ে দেয়ার পদ্ধতি কখনই ওলামায়ে কেরামের শান-ইজ্জতের সাথে মানানসই নয় ৷ এই জাতীয় আচরণ পরিহার করা জরূরী ৷
পাঁচ.
ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থার আদর্শ ৷ ব্যবসার মধ্যেও তো অতিমাত্রার মুনাফাখোরীকে ইসলাম সমর্থন করে না ৷ ওয়াজের জন্য পারিশ্রমিক বৈধ হলেও ইচ্ছা মত দাম হাঁকানোটা ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি পরিপন্থী ৷ কোনো পণ্যের বাজার চাহিদা বেশি হয়ে গেলেই স্বেচ্ছাচারি মূল্যে তা বিক্রি করা ইসলামের দৃষ্টিতে শোভনীয় নয় ৷ বরং উৎপাদনব্যয় বা ক্রয়মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তার মূল্য নির্ধারণ করা উচিৎ ৷ সেদিক থেকেও চড়া দাম হাঁকিয়ে ওয়াজ করা সমিচীন নয় ৷ তবে যৌক্তিক পরিমাণে সময়দান ও রাহখরচ ইত্যাদির হিসাবে পারিশ্রমিক গ্রহন করতে কোনো বাধা নেই ৷
ছয়.
আইনানুগ ফতোয়া এক জিনিস আর শারাফত-ভদ্রতা ও তাকওয়া-এহতিয়াত আরো উচ্চাঙ্গের জিনিস ৷ ওয়ায়েজীন আলেমগণ শুধু আইনের মারপ্যাচে ফতোয়া দেখাবেন, আর শারাফত ও এহতিয়াতের আশা করা হবে সাধারণ মানুষের কাছে? আমরাও তো ছোটো বয়সে দেখেছি, চুক্তি ও কন্টাক্ট করে যারা ওয়াজ করতেন তারা হক্কানী ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ থাকতেন ৷ কোনো উল্লেখযোগ্য মাদরাসায় কখনও তাদের জায়গা হত না ৷ এটাকে বড় রকমের অন্যায় মনে করা হত ৷ কিন্তু এখন…?!
আসলাফের পথ থেকে সরে গিয়ে আমরা সফলকাম হতে পারব বলে মনে হয় না ৷
আমরা শুধু ফতোয়া মুখস্ত করে নিয়েছি, পারিশ্রমিক নেয়া বৈধ ৷ কিন্তু আমাদের পূর্বসূরী দেওবন্দের শায়খুল হাদীস আর সাহারানপুরের মুহতামিম সাহেবগণ সে পারিশ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করতেন সে ওয়াজ আমরা ভুলে গেছি ৷ মাদরাসার বোর্ডিংয়ের জলন্ত চুলা থেকে তরকারী গরম করায় মাস শেষে চুলার লাকড়ীর হিসাব করে তারা নিজেদের বেতন থেকে পরিশোধ করে দিতেন ৷ আর আমরা…?!
যারা ওয়ায়েজ হবেন, তাদের মধ্যে শারাফাত ও এহতিয়াত থাকা জরুরি ৷
অপারগতার কথা ভিন্ন ৷ অনেক দূরত্বে দুই প্রোগ্রাম কাছাকাছি সময়ে পড়ে গেলে কিংবা অন্য কোনো পথে চলার শক্তি না থাকলে লক্ষ টাকার খরচে হেলিকপ্টারে সফর হতে পারে, কিন্তু অপারগতা ছাড়া বিনাপ্রয়োজনে শুধু বিলাসিতার জন্য নিজের বা অন্যের পকেটের এত বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করা অপব্যয়ের শামিল ৷
বাংলাদেশের ইতিহাসে আলেমদের মধ্যে রাজকীয় শান নিয়ে চলতেন যে কয়জন, হযরত হারুন ইসলামাবাদী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন তাদের অন্যতম ৷ তার কথা শুনেছি, জীবন সায়াহ্নে চিকিৎসার ইমার্জেন্সী প্রয়োজনে তার জন্য এয়ার এ্যম্বুলেন্স ঠিক করা হলে তিনি বলেছিলেন,এত টাকা আমার পিছনে খরচ না করে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাও ৷
পারিশ্রমিক গ্রহন বিষয়ে বৈধতার ফতোয়া থাকলেও তাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করা যেমন বৈধ হয়ে যায় নি তদ্রূপ টাকা-পয়সার প্রতি লোভ দেখানোও জায়েজ হয়ে যাবে না ৷ বিপুল পরিমান টাকার শর্ত করা যদি লোভ না হয়, তো লোভ বলবে কাকে?
সুতরাং চুক্তি ও কন্টাক্ট করে ওয়াজ করা ওলামায়ে দেওবন্দ ও আকাবিরগণের পদ্ধতি নয়, বরং অভদ্রতার পরিচায়ক ৷
সাধারণ মানুষের কর্তব্য, যথা সম্ভব ওলামায়ে কেরামের সন্মান করা, এহতেরাম করা, তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পুরনে সচেষ্ট থাকা ৷ আবার ওলামাদেরও ন্যুনতম শতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া রাহমানিয়া ঢাকা