শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেট আগুনে ছাই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

fire-gulsanআওয়ার ইসলাম: আগুনে পুড়ে গেছে রাজধানীর গুলশান ১ নম্বরের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেট। দীর্ঘ সময়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় দুই অংশে বিভক্ত ভবনটির ৬৩৪টি দোকানের অধিকাংশই পুড়ে গেছে। এ ছাড়া ৪০০ দোকানসহ ধসে পড়েছে মার্কেটের একাংশ। দোকানমালিকেরা বলছেন, আগুনে তাঁরা অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। তাঁদের উচ্ছেদ করতেই পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগানো হয়েছে বলে দোকানমালিকদের সন্দেহ। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূচনা হয়ে থাকতে পারে।

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, গত সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটায় তাঁরা মার্কেটটিতে আগুন লাগার খবর পান। তারপর থেকে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিট আগুন নির্বাপণের জন্য কাজ করে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে পুরোপুরি আগুন নেভেনি বলে তিনি জানান।

মার্কেটটির নিরাপত্তারক্ষী নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘রাতে কাঁচা মার্কেটের দক্ষিণ পাশে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের শব্দ পাই। এরপর মার্কেটে আগুন জ্বলতে থাকে।’ আগুন দেখে তিনি প্রধান নিরাপত্তারক্ষী আবদুল আলীকে জানান। আবদুল আলী ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন। আবদুল আলী বলেন, আগুনের খবর পেয়ে তিনি মার্কেটে এসে দেখেন, ‘কাঁচা মার্কেট’ হিসেবে পরিচিত চারতলা ভবনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় চারপাশ। রাত সাড়ে তিনটার দিকে কাঁচা মার্কেট ভবনটি ধসে পড়ে।

ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, খোলা জায়গাসহ ডিএনসিসি মার্কেটটির আয়তন প্রায় ১ লাখ ৮০০ বর্গফুট। পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বিস্তৃত মার্কেটটির পাশাপাশি দুটি ভবন আছে। পশ্চিম দিকের দোতলা ভবনটি ‘পাকা মার্কেট’ নামে পরিচিত। এটির নিচতলায় ফার্নিচার এবং দ্বিতীয় তলায় পোশাক, জুতা ও খেলাধুলার পণ্য বিক্রির খুচরা ও পাইকারি বাজার। পূর্বাংশে ‘কাঁচা ও সুপার মার্কেট’ নামের ভবনটি চারতলা। এর নিচতলায় কাঁচাবাজারের দোকান ও ওপরের তলাগুলোতে প্রসাধন ও খাদ্যপণ্যের পাইকারি দোকান। ধসে পড়া এই ভবনে দোকান ছিল ৪০০টি।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লেগেছে। তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে মনে হচ্ছে আগুন ইলেকট্রিসিটি থেকেই লেগেছে। এখানে এত বেশি ফ্লেইমেবল প্রোডাক্টস, খাবার, পারফিউম; এতে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে গেছে।’ আগুনে কোনো প্রাণহানি হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।
মার্কেটে আগুন কীভাবে লেগেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানাতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘একটা বিল্ডিং কলাপস করেছে। কোনো ক‌্যাজুয়ালটি হয়নি। এখানে ফ্লেইমেবল লিকুইড ছড়িয়ে আছে। ডেঞ্জারাস জিনিসপত্র আছে।’ তিনি জানান, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি ইউনিটও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। তারাও আগুনের কারণ নিশ্চিত করতে পারেনি।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মতৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দোকানমালিকেরা। তাঁরা বলছেন, ২২-২৩টি ইউনিটের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে দু-তিনটি ইউনিট কাজ করেছে। গতকাল ভোরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মালিকদের বাগ্‌বিতণ্ডার ঘটনাও ঘটে। তবে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এত কম সময়ে চারতলা ভবনটি ধসে পড়ায় দোকানমালিকেরা এর পেছনে নাশকতা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ঘটনাস্থলে কাঁচা মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা নিশ্চিত নাশকতা। না হলে এত দ্রুত ভবন ধসে পড়ত না।’ আগুনে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘কীভাবে আগুন লেগেছে, তা নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত, তা তদন্ত করে বের করতে হবে।’ এ জন্য ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি পুলিশ, দোকানমালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি করে আগুনের কারণ উদ্‌ঘাটনের আহ্বান জানান তিনি।
দোকান মালিকেরা সর্বস্বান্ত
মার্কেটের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে বসে কাঁদতে থাকা আলতাফ হোসেন নামের এক দোকানদার অভিযোগ করেন, আগুন লেগেছিল কাঁচাবাজারের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। সকাল পর্যন্ত আগুন ওই মার্কেটেই ছিল। সকাল সাতটার পর আগুন পাকা মার্কেটেও ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর জুতার দোকানটি পাকা মার্কেটে। সেখানকার সব মাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘জমিজমা বিক্রির সব পুঁজি নিয়ে দোকানটি দিয়েছিলাম। চোখের সামনেই সব শেষ হয়ে গেল। আমার কিছুই থাকল না।’

গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মার্কেট এলাকায় দোকানমালিকদের আহাজারি দেখা গেছে। এই মার্কেটের খোলা জায়গায় ও পাশের গুলশান শপিং সেন্টারের নিচতলায় ছিল থইথই পানি। কাঁচা মার্কেটটি ধসে পড়ায় সেখান থেকে কোনো পণ্য বের করা সম্ভব হয়নি। তবে পাকা মার্কেটের সব অংশে আগুন না লাগায় বেশ কিছু দোকান থেকে মালামাল সরিয়েছেন দোকানমালিকেরা। তাঁরা ছোট ছোট পিকআপ ভরে মালামাল নিয়ে গেছেন।

ডিএনসিসি মার্কেটের পাশের গুলশান শপিং সেন্টারের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। এই মার্কেটেরও চার-পাঁচটি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুন-আতঙ্কে গুলশান শপিং সেন্টারের দোকানমালিকেরাও সারা দিন তাঁদের মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন। দোকানমালিকদের সুবিধার্থে হাতিরঝিল থেকে গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত সড়কটি বন্ধ রেখেছিল পুলিশ। মালামাল সরিয়ে এই সড়কে রেখেছিলেন মালিকেরা। আশপাশের দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও আগুন-আতঙ্কে বন্ধ ছিল।

অগ্নিকাণ্ডের পরেই মার্কেটের চারপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। স্থানীয় সাংসদ এ কে এম রহমত উল্লাহ, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়সহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হুসেনকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মোশারফ হুসেন ঘটনাস্থল থেকে গতকাল রাত সোয়া ১১টায় প্রথম আলোকে বলেন, এখনো বিভিন্ন জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মাঝেমধ্যে আগুনও দেখা যাচ্ছে। যেসব জায়গায় পানি দিতে সমস্যা হচ্ছে সেসব জায়গায় পানি দিতে বুলডোজার ব্যবহার করে প্রয়োজনে ফুটো তৈরি করা হচ্ছে অথবা দেয়াল ভাঙা হচ্ছে।প্রথম আলো


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ