সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
চিকিৎসকরা বছরে দুইবারের বেশি বিদেশ যেতে পারবেন না ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে খুলনায় গেলো পরীক্ষামূলক ট্রেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস উইং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের

তুমি রবে হৃদয়ে হৃদয়ে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
দারুল উলুম দেওবন্দ  থেকে

allama_azmi_ajmiসালাতুজ্জোহর শেষ, অমনিই আমাদের হুড়োহুড়ি দৌড়োদৌড়ি৷ খাবারদাবার ফেলে একবুক আবেগভরা আশায় কামরা ত্যাগ৷ মসজিদে রশিদের নিচতলায় দরসগাহে উপস্থিতি৷ হজরতের অপেক্ষা৷ এই আসছেন, এইতো এলেন; অধীর আগ্রহে বসে থাকা৷

হজরতের ঘর মসজিদে ছাত্তার ওপরে৷ জোহরের আগ থেকেই তৈরি থাকতেন দর্সের জন্য৷ তর্জুমান-নির্ধারিত শিক্ষার্থীবন্ধু যেতেন বাসায়৷ হজরতকে সব কাজ থেকে অবসর করে ধীরে ধীরে ওপরতলা থেকে নিচে নামাতেন৷

বহুদিন পিছু হেঁটেছি হজরতের হুইল চেয়ারের৷ জিকির করতেন৷ পথ এগোতেন৷ সঙ্গীবন্ধুরা নিজেকে ধন্য মনে করতেন৷ অধমেরও নেয়ামত মনে করা হতো৷ কেননা হজরত তো ছিলেন ‘মুস্তাজাবুদ্দাওয়াহ' তথা প্রার্থনা কবুল করা হয় যার৷

সুযোগে, সময়ে-অসময়ে মোলাকাতে দোয়া চাইতাম৷ ভাবতাম, একটিবার যদি তার পরশে ধন্য হয়ে যায় জীবনটা! আমার মতোন এমন আশায় বুক বাঁধতেন কতো লাখো তলাবা, আসাতিযায়ে কেরাম; হিসেব নেই তার৷

একসময় তাশরিফ নিতেন হজরত৷ মাউথ মাইক দেয়া হতো সামনে৷ আরম্ভ করতেন দরস। সামনে বসে থাকা কানগুলি ভরে যেতো দরসুল হাদিসে৷ হাদিসগুলি তাও আবার বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ বুখারি শরিফের৷ হজরত পড়াতেন ‘কিতাবুল মাগাজি' তথা ইসলামের জিহাদ অধ্যায়৷

পড়াতে পড়াতে কখনও কাঁশতেন, কখনও বলতেন বেশ দরকারি কথা৷ কখনো বা সবার অনুরোধে করতেন মকবুল মোনাজাত৷ দেওবন্দ কেবল নয়, সারা দুনিয়ার সবার ধারণা, দারুল উলুম দেওবন্দে আজ অবধি হজরতের কারণেই আকাবিরের রুহানিয়্যাত বহাল ছিলো৷ অথচ তিনি আজ চলে গেলেন৷

দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন অসুস্থ৷ এই ভালো, এই খারাপ কাটছিলো তার শেষ অধ্যায়গুলি৷ শেষ ক'দিন এলেন না দরসে। আমরা হয়রান, না জানি কী হতে কী হয়ে বসে! আজ ঠিক তাই-ই হয়ে বসলো!?

তিনদিন হলো ষাণ্মাসিক পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে৷ আগামীকালই দরস আরম্ভ হবার কথা ছিলো৷ হয়তো বা আরম্ভও হবে দরসগুলি৷ কিন্তু জোহর বাদ তো আর হজরতের আলোচনা শুনতে পাবে না আমাদের কান৷

মাগরিব বাদ সংবাদটি এলো দেওবন্দের ডিকে জৈন হাসপাতাল থেকে৷ সঙ্গে সঙ্গে বেদনায় লাল হয়ে গেলো চোখদুটো৷ চেহারায় অস্থিরতার ছাপ৷ কী করবো, কাকে কী বলবো, ভেবে পাচ্ছি না৷

এলাম নবীজি সা.-এর নির্মাণরেখার  ঐতিহাসিক নওদারায়৷ বন্ধুদের প্রচণ্ড ভিড় নজরে পড়লো৷ দপ্তরের এক হজরত জানতে চাইলেন, ‘জানাজার সময় নির্ধারিত হয়েছে কী?' পাথরমানব বনে দাঁড়িয়ে রইলাম মুলসুরি বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে৷

লাশ আসবে, অপেক্ষায় সবাই৷ পায়ে হেঁটে এগোলাম সদরগেট বাবে কাসিমে৷ দেখলাম উপচেপড়া ভিড় সবার৷ হজরত মুহতামিম সাহেব মুফতি আবুল কাসেম নোমানি বানারসি দামাত বারাকাতুহুমকে দেখলাম মেহমানখানার সামনে দাঁড়িয়ে৷ তার চেহারায় বেশ পেরেশানির ছাপ৷ তাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ভিড় পেরিয়ে হজরত এগোলেন নওদারার দিকে৷ পিছু নিলো ছাত্রবন্ধুরা৷

আমরা ক'জন এগোলাম মসজিদে ছাত্তায় হজরতের বাসার দিকে৷ শুনলাম, লাশ এসে পৌঁছোয়নি এখন অবধি৷ ততোক্ষণে বিশাল এক জমায়েত আমাদের নজর কাড়লো৷ যার মধ্যমনি আমাদের উস্তাযে মুহতারাম বাহরুল উলুম আল্লামা নেয়ামতুল্লাহ আজমি দামাত বারাকাতুহুম৷ হজরত এগিয়ে আসছেন দারুল উলুমের সদরগেটের দিকে৷ ধীরে ধীরে পৌঁছুলেন নওদারায়৷ হজরত মুহতামিম সাহেব হুজুরের পাশে বসলেন৷ কিছু একটা পরামর্শ করছিলেন তারা৷ শোনা গেলো না তেমন একটা৷

আমরা হজরতদের ঘিরে দাঁড়িয়ে৷ এহাতায়ে মুলসুরি ততোক্ষণে ভরে গেছে একেবারেই৷ বন্ধুদের অনেকেই দেশবিদেশে ফোন করে খবর দিচ্ছে৷ ফেসবুক, টুইটর, ইমো, ওয়াটসঅ্যাপে ইন্তিকালের সংবাদ লিখে পোস্ট করছে৷

আমি আবার বাইরে যেতে লাগলাম৷ ঠিক মেহমানখানার পেছনে লাশ গোসলের জায়গাটিতে হাজির হলাম৷ দু-চার মিনিট দেওবন্দ নগরীর ক'জন লোকের সঙ্গে দুঃখগুলি ভাগাভাগি করলাম৷ ততোক্ষণে একটি লাশের শূন্য খাট এগিয়ে এলো এদিকটায়৷ চোখ থেকে অশ্রু আমার ঝরতে লাগলো৷ এইতো হজরতের শেষ খাট৷ আর কোনোদিন ঘুমোতে পারবেন না তিনি এই পার্থিব বিছানায়৷ ভাবতেই গা শিউরে ওঠছে আমার৷ হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এখনই৷

দেওবন্দে আসার আগে বুঝিনি, হজরত কিয়া চিজ হ্যায়? এখন টের পাচ্ছি প্রতিটা পদে পদে৷ যখন আল মারকাজুল ইসলামিতে পড়তাম, আমাদের একজন উস্তাদ খুব বলতেন হজরতের কথা৷ দেওবন্দ এলে তার সান্নিধ্যে থাকবার নির্দেশ দিতেন৷ এখন খুব মনে পড়ছে সেই কথাগুলি৷ আফসোস হচ্ছে, আহ যদি আর ক'টা দিন থাকতেন হজরত!

বড্ডো রসিক ছিলেন তিনি। ছাত্রদের সঙ্গে তার আচরণ ছিলো দাদুভাইয়ের মতোন৷ ব্যবহার ছিলো একেবারেই অকৃত্রিম৷ কথা বলতেন মৃদুস্বরে৷ আমাদের অন্যতম একজন মুরব্বি ছিলেন৷ শায়খুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ছিলেন৷ ছিলেন তার অন্যতম শাগরিদও৷ খলিফা ছিলেন হজরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক হারদুঈ রহ.-এর৷

১৯৩৬ ইংরেজিতে ভারতের উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি৷ পড়াশোনা শেষ করেন ১৩৭৪ হিজরিতে৷ ১৪০৩ হিজরিতে হজরত দারুল উলুম দেওবন্দের খেদমতে নিয়োজিত হন৷ দীর্ঘ ৩৫ বছরে গড়েছেন বহু ছাত্র৷ যারা আজ পৃথিবীর আনাচে কানাচে স্বাক্ষর রাখছেন নিজ প্রতিভার৷

হজরতের লাশ এসেছে কেবল৷ তাকে রাখা হলো লাশের খাটে৷ লাইন ধরে এগিয়ে আসছে আলেম-তলাবা৷ শেষবারের মতো এক পলক দেখবার জন্য ঠেলাঠেলি করছে সবাই৷ একে একে বিদেয় দিচ্ছে আমাদের প্রিয় শাইখকে৷

চোখের জল গড়াতে গড়াতে চড়ছি নওদারার ওপরে৷ দেখছি হজরতের লাশটি৷ কী নীরবভাবে শুয়ে রয়েছেন তিনি! যেনো কোনো চিন্তাই নেই চোখেমুখে৷ একদম নিষ্পাপ৷ যেনো শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছেন মহামহিমের আদুরে কোলে৷

হজরতের ইন্তিকালে শোকের ছায়া নেমেছে সারা পৃথিবীর ধর্মীয় অঙ্গনে৷ দেশবিদেশ থেকে অগণিত আলেম-উলামা আসতে শুরু করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দে৷

বয়সটা আর কতো বা-ই হলো তার! বাহরুল উলুম সাহেব তো বয়সে হজরতের এক বছরেরও বড়৷ অথচ বাহরুল উলুম সাহেব এখনও দিব্যি পায়ে হেঁটে চলেন দেওবন্দের বরকতময় পথপ্রান্তরে৷ কিন্তু হজরতের এই অসুস্থতায়ই হজরত সময় পেলেন না আর৷

আমাদের এ যুগের ‘ইবনে হাজার' হজরত মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমি দামাত বারাকাতুহুম বললেন, ‘উন কে হার্ট কে আন্দার বহুত বড়ি দিক্কত থি৷' তাই বলে এভাবেই আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন তিনি?

হজরতের বিশেষ খাদেম আমাদের দরসবন্ধু চিল্লাতে আরম্ভ করেছে৷ কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘কেনো হজরতকে দিল্লি কিংবা সাহারানপুরে নিয়ে গেলাম না৷ দোষ আমারই৷ আমিই হজরতের খেয়ালই রাখতে পারিনি৷'

আমাদেরও নিজেদের খুব দোষী মনে হচ্ছে৷ সত্যিই তো আমরাও তেমন খোঁজ রাখতে পারিনি হজরতের৷ তাই বলে এভাবেই তার চলে যাওয়া হবে আমাদের এতিম করে!

মাত্র এলান হলো হজরতের জানাজার৷ আগামীকাল বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হবে এহাতায়ে মুলসুরিতে৷ ভারতীয় সময় দুপুর দেড়টা নাগাদ৷ সমাহিত করা হবে কাসেমি কবরস্তানে৷

কানে বাজছে সেই প্রিয় কণ্ঠটি এখনও৷ সেই পথচলা চোখের তারায় হাজির হচ্ছে সহসাই৷ হজরতের ছায়া এতো জলদিই উঠে যাবে? ভাবিনি৷ নির্বিকার দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা এহাতায়ে মুলসুরিতে৷ পাহাড়সম আফসোসে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাদের ভেতরটা৷ আহ, যদি আরেকটু মন দিতাম হজরতের বয়ান, দর্সে!

লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত

আরো পড়ুন : দেওবন্দের আল্লামা আজমী’র ইন্তেকাল

আল্লামা আজমি রহ. এর জানাযা শনিবার বাদ জোহর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ