শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


সাম্প্রদায়িকতার জন্যে জনগণ নয় আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার কদর্য রাজনীতিই দায়ী: আল্লামা আহমদ শফী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

hathajari6

হাটহাজারী: ইসলামী সেবামূলক সংগঠন চট্টগ্রাম হাটহাজারী আল-আমিন সংস্থার তিন দিন ব্যাপী বিশাল তাফসীরুল কুরআন ও ক্বিরাত মাহফিলের দ্বিতীয় দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, বর্তমানে ঈমান, আমল, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসন পালনে সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে গাফলতি অনেক বেড়ে গেছে। ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়ার কারণেই মুসলমানগণ নানা দুর্দশা ও ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার হচ্ছেন। সঠিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই কেবল এই বিপদাপদ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর সাহায্য আশা করা যায়।

তিনি বলেন, মুসলমানদের ঈমানী দুর্বলতা ও অনৈক্যের সুযোগে দেশী-বিদেশী আধিপত্যবাদি শক্তি নানা অপপ্রচার, ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে মুসলমানদের ঈমানী চেতনাকে নষ্ট করার বহুমুখী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, গান-বাজনা, বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা ও নারী-পুরুষের অবাধ চলাফেরার বিস্তার ঘটিয়ে তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করে ধর্মহীন করে গড়ে তুলতে চাচ্ছে। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে নানা মিথ্যাচার, কাল্পনিক তথ্যের প্রচার ও চক্রান্ত চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ওলামায়ে কেরাম ও দেশবাসীকে যে কোন উস্কানীমূলক খবর, অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।

তিনি বলেন, আধিপত্যবাদি ও ভোগবাদিরা তাদের উদ্দেশ্য সাধনে উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার মুসলমানদেরকেই প্রধান বাধা মনে করছে। কারণ, একজন আলেম ও দ্বীনদার মুসলমান কখনোই অন্যায়, অপরাধ, জোর-জুলুম দেখে চুপ থাকে না। এ কারণেই দেশে বিদেশে আজ ইসলাম ও মুসলমানদেরকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ধর্মাবলম্বীরা নিজ নিজ ধর্ম পালন করলে, ধর্মীয় তৎপরতা চালালে এবং তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিলে কেউ মৌলবাদী, প্রগতি বিরোধী ও জঙ্গীবাদি হয় না। অথচ নামায আদায় ও দাড়ি-টুপী পরলে অথবা ইসলাম ধর্মীয় কোন আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিলেই প্রগতি বিরোধী, দেশ বিরোধী ও মৌলবাদীর রং লাগানো হয়।

তিনি বলেন, সম্প্রতি বি-বাড়ীয়ার নাসির নগরসহ দেশের কয়েকটি স্থানে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার ঘটনায় কোন উলামায়ে কেরাম, মাদ্রাসা ছাত্র ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান জড়িত নয়। কারা এসব হামলার ঘটনার সাথে জড়িত, সেটাও জনগণের কাছে খোলাসা হয়েছে। অথচ দেশি-বিদেশী বিভিন্ন মহল এসব হামলার কারণ উদ্ঘাটন করতে দোষীদের কাছে না গিয়ে উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার মুসলমানদের কাছে জানতে চায়।

আল্লামা আহমদ শফী বলেন, পুরা বিষয়টাই ইসলাম বিরোধী চক্রান্তের ধারাবাহিকতারই অংশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম, বর্ণ, সকলে মিলেমিশে বসবাস করে আসছেন শত শত বছর ধরে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার জন্যে জনগণ নয় বরং আধিপত্যবাদি শক্তি ও ক্ষমতার কদর্য রাজনীতিই দায়ী। তারাই সাম্প্রদায়িকতার ইস্যু তৈরি করে ফায়দা হাসিল করতে চায়। কিন্তু জনগণ সচেতন থাকলে তারা সফল হবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যেন কেউ ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্যে আলেম সমাজ ও সাধারণ জনগণকে সজাগ থাকতে হবে।

গতকাল (২২ ডিসেম্বর) বৃহস্পতিবার বৃহত্তর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সেবামূলক সংগঠন ‘আল-আমিন সংস্থা’র উদ্যোগে হাটহাজারী পার্বতী হাই স্কুল ময়দানে ৩ দিন ব্যাপি ঐতিহাসিক তাফসীরুল কুরআন ও ক্বিরাত মাহফিলের দ্বিতীয় দিনের আয়োজন সম্পন্ন হয়।

নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা ইদরিস এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন হেফাজতে ইসলামের আমীর ও দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী, প্রধান বক্তা ছিলেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের প্রধান মুরুব্বী আল্লামা হাফেজ জুবায়ের, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল্লামা ড. এবিএম হিযবুল্লাহ, মাওলানা মামুনুল হক, মুফতী নজরুল ইসলাম, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন আল-মোবারক, মাওলানা গাজী সানা উল্লাহ প্রমুখ। তাফসীরুল কুরআন মাহফিল পরিচালনা করেন, হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক ও আল-আমীন সংস্থার সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ আনাস মাদানী ও সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব আহসান উল্লাহ। হেফাজত আমীরসহ শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী নেতৃবৃন্দ শরীক থাকায় মাহফিলে প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে।

প্রধান বক্তা হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে। কারণ, ইসলাম ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীল আচরণের শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কাছ থেকেই নানাভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পর্দা, হিজাব, দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবী, ওয়াজ-মাহফিল ও ইসলামী শিক্ষা নিয়ে বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলছে। নানাভাবে উলামা-মাশায়েখ ও ধার্মিক মুসলমানদেরকে কোণঠাঁসা ও হেয় করা হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকুরিতে ধার্মিক মানুষদের নিয়োগদান অনেকটা নিষিদ্ধের মতো করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন অমুসলিম দেশে হিজাবধারী মুসলিম নারীকে পুলিশ বাহিনী, সরকারী দফতর ও টিভিতে সংবাদ পাঠের দায়িত্বে দেখা যায়, অথচ বাংলাদেশে এরকম দেখা যায় না। তিনি বলেন, নানাভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় একের পর এক আঘাত হেনে তাদেরকে ক্রুদ্ধ করে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চলছে।

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আরো বলেন, বর্তমানে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চলছে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে। খাঁটি ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র দেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহকে আদর্শ ও লক্ষ্যচ্যুত করার জন্যে সনদের স্বীকৃতির ইস্যুকে সামনে আনা হয়েছে। এটা ইসলাম বিরোধী শিক্ষানীতি ২০১০এর আলোকে একমুখী শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, আমি আগেও বার বার বলেছি, এখনো বলছি, কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারী মান না থাকায় আমাদের যে ক্ষতি রয়েছে, সরকারী মান গ্রহণ করা তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী ক্ষতিকর। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সনদের সরকারী স্বীকৃতি কখনোই কল্যাণকর হবে না।

তিনি বলেন, কোন কমিশন গঠন, সিলেবাসে হস্তক্ষেপ ও সরকারী নিয়ন্ত্রণ ছাড়া শুধুমাত্র কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদের এমএ’র মান দিলে গ্রহণ করার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে আমাদের শর্ত মেনে সরকার যদি কওমি সনদের মান না দেয়, তবে সেটা দ্বিগুণ কল্যাণকর। আমাদের কোন ভুলের জন্যে যেন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষতি হয়ে না যায়, সে জন্যে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।

রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমার সরকারের বর্বরোচিত হত্যাকান্ড, বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ও উচ্ছেদ অভিযানের প্রসঙ্গে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, দূর প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এ বিষয়ে সোচ্চার প্রতিবাদে শামিল হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ রহস্যজনকভাবে কার্যকর কোন প্রতিবাদ করছে না। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের উপর যেই অত্যাচার চলছে, এমন নৃশংসতা মানবেতিহাসে আর দেখা যায়নি। রোহিঙ্গারা শুধু মুসলিমই নন, বরং তারা আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশের নাগরিকও। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের উপর যা হচ্ছে, এটা মানবতা বিরোধী ভয়াবহ অপরাধ। সুতরাং বাংলাদেশ যেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের কঠোর প্রতিবাদ করে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুকে জাতিসংঘ, ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে জোরদারভাবে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়, সরকারের প্রতি আমরা জোর দাবী জানাচ্ছি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তৎপরতা চালাতে ইন্দোনেশিয়ার মন্ত্রী আমাদের দেশে আসছেন, অথচ উচিত ছিল সবার আগে বাংলাদেশেরই এই নিয়ে জোর তৎপরতা চালানো।

ডিএস


সম্পর্কিত খবর