শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


এক সুরের পাখির গল্প!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

۞ আফিফা মারজানা

jamshed8

দুইহাজার তিন সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস সারা পৃথিবীর সর্বকালের সবচে জনপ্রিয় গানগুলোর একটি তালিকা তৈরি করলো। তালিকার তিন নম্বরে উঠে আসলো একটি উর্দূ গান। `দিল দিল পাকিস্তান' শিরোনামের সেই গানটির জনপ্রিয় শিল্পী অবিশ্বাস্য খ্যাতি যশ ও জনপ্রিয়তার চূড়োয় অবস্থানকালে তারচেয়েও অবিশ্বাস্যভাবে তার তিনবছর পর গানকে বিদায় জানিয়েছেন আনুষ্ঠানিকভাবে।
তারপর। তার জীবনে নেমে এলো পরীক্ষা। অার্থিক অনটন। তাঁর ভাষায়- `ইতোমধ্যে আমার ঈমানি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। বেতন দিতে না পারার কারণে ছেলে-মেয়েকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনলাম। গাড়িটা বিক্রি করে দিলাম। এক সময় বাড়িও বিক্রি করে দিলাম। এরপর নগদ টাকা যা ছিল, তা দ্রুত শেষ হয়ে আসতে লাগলো। সর্বশেষ যেদিন আমার পকেটে ১০০ টাকা ছিল, সেদিন স্ত্রীর হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে বললাম, এই আমার শেষ সম্বল! কাল থেকে সংসার কিভাবে চলবে, তা আমি জানি না। তুমি আমার কাছে কোন টাকা-পয়সা চাইবে না।’
এরপর এলো প্রলোভনের হাতছানি। তাও উতরে গেলেন। তিনি বলেন, ‘শয়তান কিন্তু বসে থাকল না। আমার সংকল্প থেকে আমাকে টলাবার জন্য বিভিন্নভাবে সে জাল ফেলতে লাগলো। বড় বড় অফার আসতে লাগলো। একটা মাত্র গান গাওয়ার জন্য, একটা মাত্র শোতে অংশ নেয়ার জন্য লাখ লাখ টাকার প্রস্তাব আসতে লাগলো। কিন্তু আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে সব লোভ ত্যাগ করলাম।’
১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের রাওয়াল পিন্ডিতে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। ছোটভাইয়ের কেনা শখের গিটারে টুংটাং করতে করতে একসময় নিজেই হয়ে গান গিটারিস্ট ও গায়ক। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় ক্যাম্পাসগুলোতে গেয়ে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন।
এখন। সারা পৃথিবীর আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমী মানুষের মুখে মুখে ফেরে তার গান। সত্য সুন্দর ও শুদ্ধতার সুর তিনি ছড়িয়ে গেছেন আমৃত্যু। তিনি বলেছিলেন, ‘এখন বাজারে আমার ইসলামি গজলের অনেক এলবাম ছড়িয়ে গিয়েছে। আমার মৃত্যুর পরেও এগুলো মানুষের মুখে মুখে জারি থাকবে।’
হ্যাঁ, তিনি মারা গেছেন। কিন্তু মাশরিক থেকে মাগরিব তক রয়ে গেছে তাঁর পবিত্র সুরের ঝংকার। যুগে যুগে মানুষ গাইবে- মিঠা মিঠা পেয়ারা পেয়ারা মেরে মুহাম্মাদ কা নাম...। তিনি জুনাইদ জামশেদ। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের রাওয়াল পিন্ডিতে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। ছোটভাইয়ের কেনা শখের গিটারে টুংটাং করতে করতে একসময় নিজেই হয়ে গান গিটারিস্ট ও গায়ক। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় ক্যাম্পাসগুলোতে গেয়ে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন।
পপ গানের দল ‘ভাইটাল সাইন’ গঠন করেন। ১৯৮৭ সনে প্রকাশিত হয় ‘ভাইটাল সাইন ১’ নামের এ্যালবাম। তারপর রূপকথার গল্পেরর মত এগিয়ে যাওয়া। পাকিস্তানের এলব্যাম বিক্রির টপচার্টের শীর্ষস্থানটি যেন অনেকটা লিখে নিয়েছিলো ভাইটাল সাইন। পাকিস্তানের রকগানের বিকাশ ও জনপ্রিয়তার পেছনে ভাইটাল সাইন মূখ্য ভূমিকা পালন করে। ভাইটাল সাইনের ভোকাল হিসেবে অসংখ্য গান আছে তার- যা এখনও সমান জনপ্রিয়। পাকিস্তানি এয়ারফোর্সের আফিসিয়াল সঙ ‘কসম উস ওয়াক্ত কি’ একটি অনবদ্য গান। অসাধারণ গায়কি নিয়ে সুদর্শন জুনাইদ ক্রমে হয়ে ওঠেন গায়ক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন ডিজাইনার , গীতিকার। অভিনয়ের খাতায়ও নাম লেখান তিনি। সৎ ও আদর্শবান পিতার সন্তান হওয়ায় ছোটবেলার আর্থিক অনটন ও কষ্ট ভুলতে ডুবে যান অর্থ, খ্যাতি ও ভোগ বিলাসের দুনিয়ায়।
কিন্তু তিনি তৃপ্তি খুঁজে পাননি তাতে। দুইহাজার তিন সালে পুরনো সহপাঠীর ক্লান্তিহীন মেহনত ও সাধনার বদৌলতে বদলে যায় এই শিল্পীর জীবন ও জীবনের পথ। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে দুইহাজার ছয় সালে শেষবারের মত পিটিভিতে জাতীয় সংগীত গেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মিউজিক্যাল গানের মাইক্রোফোন তুলে রাখেন তখনকার পাকিস্তানের শীর্ষ শিল্পী জুনাইদ জামশেদ। হালাল রুজি কামাইয়ের জন্য নিজস্ব ব্রান্ডের পানজাবি তৈরি ও বিক্রি করেন। বর্তমানে পাকিস্তানে অর্ধ শতাধিক শোরুম আছে তাঁর পানজাবির।
অসাধারণ গায়কি নিয়ে সুদর্শন জুনাইদ ক্রমে হয়ে ওঠেন গায়ক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন ডিজাইনার , গীতিকার। অভিনয়ের খাতায়ও নাম লেখান তিনি। সৎ ও আদর্শবান পিতার সন্তান হওয়ায় ছোটবেলার আর্থিক অনটন ও কষ্ট ভুলতে ডুবে যান অর্থ, খ্যাতি ও ভোগ বিলাসের দুনিয়ায়।
গান ছেড়ে দেবার পর মুফতি তাকী উসমানীর তাঁর নিজের লেখা ‘ইলাহি তেরি চৌখাট পর’ শীর্ষক গানটি তাঁকে সুরারোপ করে গাইতে দেন। তারপর সব ইতিহাস।২০০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ইসলামী সংগীতের প্রথম এ্যালবাম ‘জালওয়ায়ে জানা’ ভেঙে দেয় উর্দূ ভাষায় প্রকাশিত সব গানের সর্বোচ্চ বিক্রির সর্বকালের রেকর্ড। এরপর একে একে বাজারে আসে ‘মাহবুব ই ইয়াজদান, বদরুদ্দোজা, বাদিউজ্জামান, হাদীউল আনাম, রাব্বী জিদনী ইলমা, নূরুল হুদা’ শীর্ষক এ্যালবামগুলো। এসব এ্যালবাম দিয়ে তিনি জয় করে নেন সারা দুনিয়ার হামদ-নাতপ্রেমী মানুষের মন। খ্যাতি, যশ, জনপ্রিয়তা আর অর্থ আগেরচে বহুগুণ লুটিয়ে পরে তাঁর পায়ে।

তাঁর, ‘মেরা দিল বদল দে, ইলাহি তেরি চৌখাট পর, ইয়ে সুবহে মাদিনা, মুহাম্মাদ কা রওজা, মিঠা মিঠা পেয়ারা পেয়ারাসহ অনেক গান রাসূলপ্রেমী মানুষের মুখে মুখে ফেরে। প্রেমিক হৃদয়কে আকুল ও তৃপ্ত করে। জুনাইদ জামশেদ বলেন- ‘আমি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দারুল উলুম জাকারিয়া মাদরাসায় গেলাম। সেখানে প্রতিটি ছাত্রের মুখে মুখে আমার গজল উচ্চারিত হচ্ছে। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।’

২০০৮ সালে জুনায়েদ জামশেদ বাংলাদেশ সফরে আসেন। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র) কনসার্টে নাত পরিবেশন করেন। তখন তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘নবী মোর পরশমণি’ গানটি গেয়ে শ্রোতাদের চমকে দেন।

এর আগে ২০০৫ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশে আসেন প্রিয়বন্ধু বিখ্যাত ক্রিকেটার সাঈদ আনোয়ারের সাথে দাওয়াতি সফরে। হ্যাঁ, তিনি শুধু একজন গায়কই ছিলেন না, সেই সাথে তিনি একজন নিরলস ও মুখলিস দায়ীও ছিলেন। বরং তিনি একজন দায়ীই ছিলেন। গান ও তাবলীগের মেহনত দিয়ে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন হকের দাওয়াত। তাঁর দাওয়াত পাকিস্তানের তরুণদের ভেতর ও শোবিজ অঙ্গনে বেশ প্রভাব ফেলে।

হাজারো মানুষ খুঁজে পায় পথের দিশা ও ফিরে আসে সঠিক পথে। সেই সাঈদ আনওয়ারেরই তাবলীগী সফরের নুসরতে চিত্রাল যান তিনি। দশদিনের নির্ধারিত সফর শেষে আরও দুইদিন থাকেন। আজ বিকেলে ইসলামাবাদ ফেরার পথে বিমান দূর্ঘটনায় পতিত হয়ে ইলাহির চৌখাটে ফিরে যান প্রিয় জুনাইদ জামশেদ। সাথে ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী নেহা জুনাইদ। যিনি তাঁকে দীনের পথে ফিরে আসতে ও অটল থাকতে একই পথে হেঁটেছেন। যাঁর সম্পর্কে জুনাইদ বলেন- ‘বস্তুত আমার এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমার স্ত্রীর অবদান অনেক বেশি। তার সহযোগিতা ও সমর্থন না পেলে আমার এই রাস্তায় আসা কষ্টকর হয়ে যেত। সে-ই আমাকে আমার জগতে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করেছে। আল্লাহর উপর ভরসা করার তাগিদ দিয়েছে। তার অবদান এই জীবনে ভুলার নয়। আল্লাহ্ পাক তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।প্রকৃত বন্ধু তারাই যারা সবসময় বন্ধুর কল্যাণ কামনা করেন এবং বন্ধুকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। অনুরূপভাবে আদর্শ স্ত্রী তারাই যারা স্বীয় স্বামীকে অন্যায় ও হারাম থেকে বাঁচানোর জন্য এবং গুনাহের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা ও সহযোগিতা করেন এবং এ কারণে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নেন। আমার হিদায়াতের পথে আসায় আমার সেই দ্বীনি সাহায্যকারী বন্ধু ও আমার সহযোগিনী স্ত্রীর ত্যাগ আমার জীবনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

শুধু জীবনে নয় মরনেও তাঁকে সঙ্গ দিলেন তাঁর প্রিয়তমা! আল্লাহ তাঁদের সকল ভুল ক্ষমা করুন। প্রিয় জুনাইদ জামশেদকে জান্নাতের মাহফিলের মধ্যমণি বানিয়ে দিন সুরের পাখি করে। আমীন।

আরআর

আরো পড়ুন: থেমে গেল হৃদয় শীতল করা সুর

শোকাহত সঙ্গীত অঙ্গন

এসেছে এক ভিখারি আজ

যেভাবে তিনি জুনায়েদ জামশেদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ