মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৭ শাওয়াল ১৪৪৫


কেমন আছেন কিউবার মুসলিমরা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

qbaআতাউর রহমান: ফিদেল ক্যাস্ট্রো। পৃথিবীব্যাপী এক আলোচিত নাম। কেউ তাকে বিপ্লবী নেতা হিসেবে ব্যাপক সম্মানের চোখে দেখে, কেউবা দেখেন একজন স্বৈরশাসক হিসেবে। গত ২৫ নভেম্বর শুক্রবার জীবনাবসান হয়েছে কিউবান সাবেক এ প্রেসিডেন্টের। তার মৃত্যুতে চীন, রাশিয়ার মতো দেশগুলো যেমনি শোকা প্রকাশ করেছে, তেমনি আমেরিকার মতো কিছু দেশ আবার তার মৃত্যুকে দেখছে একটি খারাপ অধ্যায়ের অবসান হিসেবে। আবার ক্যাস্ট্রোর নিজের দেশ কিউবার কিছু প্রবাসী নাগরিককেও দেখা গেছে তার মৃত্যুতে ‘খুশি’ হতে।

যা হোক, একজন শাসকের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এ কমিউনিস্ট দেশটিতে কেমন আছেন মুসলমানরা? এখানে তারই একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সিলভিয়া হিনস, যিনি গত ১০ বছর যাবত ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কিউবার নিয়মিত যাতায়াত করছেন, তিনি সেখানকার মুসলমানদের একটা অবস্থা তুলে ধরেছেন জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরায়। তার লেখনিতে কিউবার মুসলমানদের অবস্থার যে চিত্র উঠে এসেছে তা মোটামুটি এরকম-

মধ্য কিউবার বিশ্ববিদ্যালয় শহর সান্তা ক্ল্যারা। সেখানে একটি বাড়ির সামনে ঝুলছে একটি অস্থায়ী মুদ্রণ দোকানের সাইনবোর্ড। বাড়ি-সংশ্লিষ্ট এ ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসার সুযোগ অবশ্য আগে ছিল না। ২০০৮ সালে আত্মকর্মংস্থান বিষয়ে আইন কিছুটা শিথিল করার পর থেকে সেখানকার বাসিন্দারা এ সুযোগ পাচ্ছেন এবং এ ধরনের ব্যবসা বা কর্মসংস্থান এখন কিউবার সাধারণ চিত্র হিসেবেই দেখা যাচ্ছে।

৪৩ বছর বয়সী হাসান জানের এ প্রিন্টিংয়ের দোকানটি তারই প্রমাণ। এখানে তার এক ডলারের মতো (১ কিউবান পেসো = ০.০৪ ডলার) প্রতিদিন আয় হয়, যা দিয়ে স্ত্রীর শাবানা ও দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার চালিয়ে নেয়া যায়।

দাঁড়ি-টুপি বিশিষ্ট হাসান ও হিজাব পরা শাবানারা হলেন কিউবার একটি ছোট্ট কিন্তু অগ্রসর গোষ্ঠীর সদস্য, যারা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন।

সরকারিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। এখানে মাত্র কয়েক হাজার মুসলমান রয়েছে। এদের বেশিরভাগই আবার বিদেশি ছাত্র বা শ্রমিক।

হাভানাভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন আরব-কিউবা ইউনিয়নের সাবেক লাইব্রেরিয়ান হাজি ইশার (পূর্ব নাম জর্জ ইলিয়াস গিল ভিয়েন্ট) তথ্য মতে, কিউবায় ১ হাজারের মতো মুসলমান রয়েছে, যারা মুসলমানে ধর্মান্তরিত এবং মুসলিম ইমিগ্রান্টদের উত্তরপুরুষ। হাজি ইশাও একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম।

তিনি জানান, এটা একটা তরুণ কমিউনিটি। ৯০-এর দশকে আফ্রিকা, ওয়েস্টার্ন সাহরা, ফিলিস্তিন ও আরব দেশগুলো থেকে আসা ছাত্ররাই মূলত এ কমিউনিটির প্রধান প্রতিনিধি। পরবর্তীতে এসে পাকিস্তানিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইশার মতে, এখানকার মুসলিম ছোট্ট কমিউনিটিটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ এখন ইসলামের প্রতি সচেতন হয়ে উঠছেন। হাসানের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসা মানুষদের ইসলামের আরো কাছে আনার সুযোগ ‍সৃষ্টি করছে। এসব ক্ষেত্র মুসলমান ভাইদেরকে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুযোগ করে দিচ্ছে।

হাসান যেভাবে মুসলমান হলেন
হাসানের মুসলমান হওয়াটা ছিল খুবই অপ্রত্যাশিত। তার জন্ম হয়েছিল এমন একটি পরিবারে যেখানে ধর্মের কোনো চর্চা ছিল না।

তিনি বলেন, আমি ছোটবেলায় কোনো চার্চে যাইনি। কিউবান সমাজব্যবস্থার অংশ হিসেবে আমি বিভিন্ন পার্টিতে যেতাম। আমি সান্না ক্ল্যারার একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিও টেকনিশিয়ান ছিলাম। একজন ডিজে হিসেবে আমার প্রতিটি সন্ধ্যা গান-বাজনায়ই কাটত।

কিন্তু সবকিছু পাল্টে যায় ২০১০ সালের রমজান মাসে। একদল পাকিস্তান ছাত্র তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছিল।

২০০৫ সালে পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীরে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৮৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং প্রায় ২৫ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীত হয়েছিল।

তখন সেখানকার মানুষের সাহায্যার্থে কিউবা দুই হাজার ডাক্টার পাঠিয়েছিল। এবং সে বছরই এক হাজার পাকিস্তানি ছাত্রকে কিউবার স্কলারশিপ দেয়া হয়েছিল। সে ছাত্রদের প্রায় ৩০০ জন হাসানের কর্মস্থল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পেয়েছিল।

স্বাভাবিকভাবেই মুসলমান বলে হাসান তাদেরকে প্রথমে এড়িয়ে চলতেন।

‘মানুষ মুসলমানদেরকে খারাপ বলে থাকে, সন্ত্রাসী বলে থাকে। এটাই ছিল এড়িয়ে চলার কারণ’, বলেন হাসান।

কিন্তু একদিন রমজান মাসে তাদের একটি কাজে বেলা ২টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত তাদের সাথে থাকতে হয়েছিল।

‘প্রথমে আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করছিলাম। তারা আমাকে নাস্তা খেতে বলতো, কিন্তু আমি তাদের এড়িয়ে চলতাম। তৃতীয় দিন তারা নামাজ পড়ছিল। এ সময় আমার মনে একটি দোলা দিল- আমি কী করছি? এরপর একদিন আমি তাদের সাথে মেশা শুরু করলাম। কথা বলে বুঝতে পারলাম তারা কিউবায় তাদের বিশ্বাসের জন্য কতোই না ত্যাগ স্বীকার করছে।’

‘আমি আমার মনকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা যদি এতোই খারাপ হতো তাহলে আমার সাথে এতো ভালো আচরণ কেন করছে? আমি তাদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকলাম। একসময় উপলব্ধি করতে পারলাম, ইসলাম সম্পর্কে কিউবানরা যারা বলে থাকে বাস্তবতা তা থেকে ভিন্ন।’

রমজান মাস শেষ হলো হাসানের কাজও শেষ হলো। কিন্তু তারপরও তিনি ওই ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তাদের কুরআন পড়া শোনেন। সাত মাস পর তিনি ইসলামধর্মে দীক্ষিত হয়ে যান এবং নাম পরিবর্তন করেন।

ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর হাসানের জীবনটা খুব সহজ ছিল না। পরিবারে কেউই এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এমনকি স্ত্রীও। তবে পাঁচ মাস পরই স্ত্রীও ইসলামে দীক্ষিত হন এবং নাম পরিবর্তন করে রাখেন সাবানা।

আইনা (১৬) ও ইসমাইল (১২) নামে তাদের দুই সন্তান রয়েছে। কন্যা আইনাও ইসলামী পোশাক হিজাব পরে স্কুলে যাচ্ছে।

কিউবায় মুসলমানদের অবস্থান
কিউবার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল শতবর্ষ আগে। পনেরশ’ শতকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলমান ও খ্রিষ্টান ব্যবসায়ীরা সম্পদ আহরণ ও চিনি ব্যবসার জন্য কিউবায় গমন করতেন। তখন তাদের অধিকাংশই থাকতেন হাভানা ও কিউবার দ্বিতীয় শহর সান্তিয়াগো ডি কিউবায়। তবে পরিস্থিতির কারণে অনেকে পরবর্তীতে ধর্মচর্চা থেকে বিরত থাকেন।

কিউবার বর্তমান পরিস্থিতিও সেখানকার ধর্ম চর্চাকারী মুসলমানদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং-ই। এখনো সেখানে হালাল খাদ্যের বেশ অভাব। এখানে শুকরের মাংসের প্রচলনই বেশি। তবে আশার কথা হলো কিছু কিছু রেস্তোরাঁ ও সুপার মার্কেট এখন হালাল খাদ্যের ব্যবস্থা করছে। সুপারমার্কেটগুলো ব্রাজিল থেকে মুরগির হালাল গোশত আমদানি করছে। তবে এগুলো বেশ ব্যয়বহুল। ইসলামী পোশাকগুলো তৈরি করতে হয় আমদানি করা কাপড়ে অথবা অন্য দেশের কোনো মুসলমান ভাইদের দেয়া উপহার থেকে।

ইশা বলছিলেন, ‘অন্যান্য দেশের মুসলিম ভাইয়েরা বলে থাকেন, কিউবার মুসলমানরা সাচ্চা। কারণ এখানে অনেক প্রতিকূলতার মাঝে ধর্ম পালন করতে হয়।’

ইসলাম সম্পর্কে ধারণা
ইসলামে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি মোকাবিলা করতে হয় তা হলো, ইসলাম সম্পর্কে কিউবানদের ধারণা। সন্ত্রাসী আক্রমণ নিয়ে মিডিয়ায় উঠে আসা প্রতিবেদনগুলোতে যেভাবে মুসলমানদের দায়ী করা হয়, তার প্রভাব পড়ছে কিউবানদের মনে।

তবে আরেকজন ধর্মান্তরিত মুসলিম হাজি জামাল এর পরিবর্তন ঘটাতে চান।

তিনি বলেন, ‘আমি একটি ব্যাপ্টিস্ট চার্চের সদস্য ছিলাম। আমি খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতাম। কিন্তু আমি বাস্তবে এই পবিত্র ত্রিত্ব সম্পর্কে বুঝতাম না। একদিন আমি একজন কিউবান মুসলমানের কাছে গেলাম, যিনি কয়েক বছর আগে ইসলামী দীক্ষিত হয়েছেন। তিনি আমাকে একটি কুরআন শরীফ দিলেন পড়তে। আমি এটি পড়ে বেশ যুক্তি খুঁজে পেলাম। মুগ্ধ হয়ে গেলাম ইসলামে।’

২০০৯ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন জামাল। তিনি এখন ৩০ জন কিউবান ও ৯০ জন বিদেশি ছাত্রের একটি কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারা ইসলাম সম্পর্কে মানুষের ধারণায় পরিবর্তন আনতে এবং বোঝ সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছেন।

জামাল জানালেন, কিউবার আইন অনুসারে সব ধর্মকে সম্মান করা হয়।

তবে ইসলামে দীক্ষিত নারী যারা মাথা ঢেকে রাখা পোশাক পরেন তাদেরকে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অাপত্তি করা হয়। তবে ইশার মতে, এসব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়।

এ ব্যাপারটি অবশ্য ‘মধুর জটিলতা’ হিসেবে নিয়েছেন শাবানা। তিনি বলেন, ‘এ সমস্যার কারণে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি পরিবারকে অনেক বেশি সময় দিতে পারি।’

ইসলামে ধর্মান্তরিতদের একজন হিসেবে শাবানা উপলব্ধি করেন, অন্য কিউবানদের মাঝেও ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

‘আমি যখন হিজাব পরে বাইরে যাই, তখন অনেকে আমাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করে। উত্তর পেয়ে তারা ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারছে’, বলছিলেন শাবানা।

তৈরি হচ্ছে একটি কমিউনিটি
২০১৫ সালে মধ্য হাভানার একটি ইতিহাস জাদুঘরে নামাজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন ইতিহাসবিদরা। এটাই এখন অনেকটা মসজিদের আকার ধারণ করেছে। সেখানেই এখন মুসলমানরা শুক্রবারের নামাজ পড়তে পারছেন।

অন্য শহরগুলোতে নামাজের তেমন সুযোগ নেই। সেখানকার বাসিন্দারা নিজেদের বাসা-বাড়িতেই নামাজ পড়েন। হাসান-শাবানা দম্পতি নামাজ আদায় করার জন্য বাসার একটি রুম বরাদ্দ রেখেছেন। সেখানে অন্য মুসলমানরাও এসে নামাজ পড়তে পারেন।

সান্টিয়াগ্রোর মুসলিম সম্প্রদায় একটি মসজিদ নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তাদের এখনো অনুমোদন বা পর্যান্ত অর্থের ব্যবস্থা হয়নি।

জামাল জানালেন, ‘আমরা ১২ স্কয়ার মিটারের একটি ছোট্ট জায়গার ব্যবস্থা করেছি। ভবিষ্যতে হয়তো আল্লাহর ইচ্ছায় একটি মসজিদ নির্মাণ করতে পারবো।’

‘কিউবা সত্যিই পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু আমরা সে পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছি যখন আমরা একটি মসজিদ পাব। ইসলামী গবেষণাগার পাব। পাব সেই সুযোগ যা অন্য ধর্মের অনুসারিরা পায়। আমাদের মেয়েরা যখন ধর্মীয় পোশাক পরতে পারবে কোনো অসুবিধা ছাড়াই’, বলছিলেন জামাল।

সূত্র: নয়াদিগন্ত


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ