শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


শরণার্থীদের ব্যাপারে যা বলেছে ইসলাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু

rohinga14মাটি ও মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। প্রতিটি মানব মনে বিছানো থাকে স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি মায়ার স্তর, ভালোবাসার মায়াবী পর্দা। এ মায়া ও ভালোবাসা স্বভাবজাত। জন্মগত উত্তরাধিকার। শত প্রতিকূলতার মাঝেও মানুষ তার জন্মভূমি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চায়। জীবনে-মরণে ঠাঁই চায় আপন ভূমে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা. যখন জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনার উদ্দেশ্যে বের হন, তখন তিনি ভেজা চোখে বলেছিলেন ‘হে মক্কা! যদি তোমার অধিবাসীগণ আমাকে বের করে না দিতো আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’

তবুও পৃথিবীতে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে হয় অন্যত্র। পৃথিবীর প্রাচীনকাল থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ধর্মীয় মতবাদ, রাজনৈতিক স্বার্থ ও জাতিগত সংঘাতের শিকার হয়ে মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ নবী-রাসুল আ. গণও রেহাই পাননি এ নির্মমতা থেকে। এজন্য সভ্যতার সূচনাকাল থেকে অভিবাসন ও অভিবাসীদের আশ্রয় প্রদানের বিষয়টি একটি বিশ্বজনীন মানবিক আইনে পরিণত হয়েছে। ইসলাম আগমনের পূর্বে বর্বর আরব সমাজেও অভিবাসী ও শরণার্থীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব পেত। যুবক বয়সে হজরত মুহাম্মদ সা. হিলফুল ফুজুল নামে যে সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, তার অন্যতম প্রধান ধারা ছিল অভিবাসীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান। একইভাবে ইসলাম আগমনের পূর্বে ‘দীনে হানিফিয়্যাহ’ তথা মানবিক ধর্মে বিশ্বাসী হজরত খাদিজা রা. রাসুল সা. এর গুণাবলি উল্লেখ করেছিলেন, সেখানেও অভিবাসীদের আশ্রয় ও সহযোগিতার বিষয়টি ছিল। আধুনিককালেও আন্তর্জাতিক আইনসমূহে শরণার্থীদের অধিকার স্বীকৃত। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদেও শরণার্থীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার সনদের ১৪নং ধারায় বলা হয়েছে ‘নির্যাতন এড়ানোর জন্য প্রত্যেকেরই অপর দেশসমূহে আশ্রয় প্রার্থনা এবং আশ্রয় লাভের অধিকার আছে।’ [সূত্র: ইন্টারনেট]

১৯৯০ সালে ওআইসি কর্তৃক কায়রো মানবাধিকার ঘোষণায়ও শরণার্থীর অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। ১২নং ধারায় বলা হয়েছে ‘শরিয়তের ভিত্তিতে প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে চলাচল এবং দেশে ও বিদেশে বসবাসের স্থান নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। নির্যাতিত হলে অন্যদেশে আশ্রয় লাভের অধিকার পাবে। আশ্রয়দাতা দেশ তার পূর্ণ নিরাপত্তা দান করবে যতদিন না সে নিরাপদে আপন ভূমিতে ফিরতে পারে এবং যদি না সে শরিয়তবিরোধী কোনো অপরাধে লিপ্ত হয়।’ [সূত্র: ইন্টারনেট]

পবিত্র কুরআনে নবী-রাসুল আ. ও মুমিনগণের একাধিক হিজরত তথা দেশত্যাগের ঘটনা বিবৃত হয়েছে। যেমন হজরত ইবরাহিম ও লুত আ. এর দেশত্যাগের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে ‘আমি তাকে ও লুতকে মুক্তি দিলাম এমন ভূমিতে যা আমি বিশ্ববাসীর জন্য বরকতময় করেছি।’ [সূরা আম্বিয়া: ৭১] হজরত মুসা আ. এর দেশত্যাগের বিবরণও কুরআনে এসেছে। তিনি সময়ের অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে জীবন রক্ষার জন্য দেশত্যাগে বাধ্য হন এবং মাদায়েনে হজরত শোয়াইব আ. এর নিকট আশ্রয় লাভ করেন।

হজরত শোয়াইব আ. হজরত মুসা আ. কে শুধু আশ্রয়ই প্রদান করেননি; বরং তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন এবং কন্যাদানের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন। একইসঙ্গে দেশত্যাগে বাধ্যকারী শাসক ফেরাউন ও তার জাতিকে কুরআনে ‘অত্যাচারী’ বলা হয়েছে। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পরও হজরত রাসুলে আকরাম সা. সাহাবায়ে কেরামের আশ্রয় ও পুনর্বাসনের জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি মুহাজির (দেশত্যাগকারী) ও আনসার (আশ্রয়দাতা ও সাহায্যকারী) সাহাবিদের মধ্যে ‘ভ্রাতৃত্ববন্ধন’ স্থাপন করেন। এটি ছিল একটি সাময়িক ব্যবস্থা। কিন্তু ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ‘ভ্রাতৃত্ববন্ধন’ এর ফলে আনসার ও মুহাজিরগণ আত্মার আত্মীয়তে পরিণত হন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে তাদের ত্যাগ ও ভালোবাসার প্রসংশা করে বলেন ‘যারা তাদের (মুহাজিরদের) পূর্বে এ জনপদকে নিজেদের নিবাস করেছিল এবং যারা (তাদের আগমনের) পূর্বে ঈমান এনেছিল, তারা অত্যন্ত ভালোবাসে তাদেরকে যারা হিজরত করেছে। মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে সে ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনো চাহিদা অনুভব করে না। তারা সর্বদা অগ্রাধিকার দেয় তাদেরকে (মুহাজিরদের); যদিও তারা অভাবগ্রস্থ। প্রকৃতপক্ষে যাদেরকে অন্তরের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম।’ [সূরা হাশর: ০৯]

হিজরত তথা দেশত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণের ক্ষেত্রে ইসলামের নীতিমালা হলো ইসলাম দেশত্যাগের এই প্রাগৈতিহাসিক বিশ্ব বাস্তবতাকে স্বীকার করে এবং তাকে বৈধতা প্রদান করে। ঈমান ও সম্ভ্রম, জীবন ও সম্পদ রক্ষার প্রয়োজনে ইসলাম কখনো কখনো দেশত্যাগের নির্দেশও প্রদান করে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছে তাদের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার সময় ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করবে, তোমরা সেখানে কেমন ছিলে? তারা বলবে, আমরা পৃথিবীতে দুর্বল ছিলাম। ফেরেশতাগণ বলবে, কেন আল্লাহর পৃথিবী কী প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা হিজরত করবে?’ [সূরা নিসা: ৯৭]

ইসলাম সেসব জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের তীব্র নিন্দা করেছে যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে দেশত্যাগে বাধ্য করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন ‘যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা পরস্পর খুনোখুনি করবে না এবং নিজেদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে না, তখন তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং সাক্ষ্য দিচ্ছিলে। অতঃপর তোমরাই পরস্পর খুনোখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে দেশ থেকে বহিষ্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ভাবে সাহায্য করছ। আর যদি তারা বন্দি হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময়ের মাধ্যমে তাদেরকে মুক্তি দিচ্ছ। অথচ তাদের বহিষ্কার করাই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল।’ [সূরা বাকারা: ৮৪-৮৫]

শরণার্থী গ্রহণ ও আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলাম উদার মানসিকতা পোষণ করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের মানবিক দিকটিই বিবেচনা করে। মানবিক বিবেচনায় সকলকে আশ্রয় দানের নির্দেশ দেয়। তবে আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসলিমের মাঝে বিধানগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। মুসলিম দেশের মুসলিম নাগরিকগণ সাধারণভাবে অমুসলিম দেশের অমুসলিম নাগরিককে আশ্রয় দেওয়ার অধিকার রাখে। যখন কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিমকে নিরাপত্তা দেয় তখন অন্য কারও জন্য তা রহিত করার সুুযোগ থাকে না। যদি না আশ্রিত ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্র ও মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অথবা ইসলামি রাষ্ট্রে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। একজন অমুসলিম সর্বোচ্চ এক বছরের অস্থায়ী আশ্রয় পেতে পারে। এক বছরের পর যদি সে ইসলামি রাষ্ট্রে অবস্থান করতে চায় তবে তাকে স্থায়ী নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে এবং মুসলিম দেশের অমুসলিম নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য আইন ও বিধান মানতে হবে। [ফিকহুস সুন্নাহ, আমান অধ্যায়]

আর যখন কোনো মুসলিম কোনো মুসলিম দেশে আশ্রয় চায় তখন আশ্রয় দেওয়া ও সাহায্য করার বিষয়টি ঐচ্ছিক থাকে না। মুসলিম দেশের শাসক ও জনগণের জন্য তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা আবশ্যক হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘যদি তোমাদের নিকট ধর্মের ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করা হয়, তবে তোমাদের জন্য সাহায্য করা আবশ্যক। তবে এমন জাতির বিরুদ্ধে নয় যাদের সঙ্গে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন।’ [সূরা আনফাল: ৭২] সুতরাং যখন মুসলিম শরণার্থীকে আশ্রয় দিলে চুক্তির লঙ্ঘন না হয়, তখন আশ্রয় দেওয়া আবশ্যক। চুক্তি না থাকলে ইসলামি রাষ্ট্রের অভিভাবকের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করাও আবশ্যক।

ইসলামি শরণার্থী নীতির অন্যতম দিক হলো নারী ও শিশুর নিরাপত্তা। ইসলাম তার নীতি, আদর্শ ও বিধানাবলির সর্বত্র নারী ও শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের পররাষ্ট্রনীতিতে নারী ও শিশুর নিরাপত্তার বিষয়টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো মুমিন নারী হিজরত করে তোমাদের কাছে আসে, তখন তোমরা তার পরীক্ষা নাও। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন। যদি তোমরা তাদেরকে ঈমানদার পাও, তবে তাদেরকে কাফেরদের নিকট ফিরিয়ে দিও না।’ [সূরা মুমতাহিনা: ১০] হুদায়বিয়ার সন্ধি অনুযায়ী মক্কা থেকে মদিনায় আগমনকারী মুসলিমদের মক্কার কাফেরদের নিকট ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক ছিল। চুক্তি অনুযায়ী বেশ কয়েকজন পুরুষ সাহাবি রা. কে ফিরিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা মদিনায় আশ্রয় নেওয়ার পর আল্লাহ আয়াত নাজিল করে তাকে চুক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেন। [তাফসিরে ইবনে কাসির, খ–৮, পৃষ্ঠা-৯১] সুতরাং মুসলিম নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসলামি রাষ্ট্র প্রচলিত চুক্তি ও অঙ্গীকারসমূহ থেকে বের হয়েও আসতে পারে।

তাছাড়া ইসলাম ঈমান ও সম্ভ্রম, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কখনো দেশত্যাগের অনুমতি বা কখনো নির্দেশ দিলেও এবং শরণার্থী গ্রহণে উদারনীতি অনুসরণ করতে বললেও মাতৃভূমি ও তার মুক্তির কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া পছন্দ করে না। সময় সুযোগ করে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে।

লেখক : তরুণ আলেম ও লেখক


সম্পর্কিত খবর