শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


রোহিঙ্গারা মানুষ নয়, ওদের কোনো মানবাধিকার নেই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

পলাশ রহমান
ইতালি থেকে

palash_rahman2) ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার সে দেশে এক নতুন নাগরিক আইন চালু করে। তিন স্তরের এই নাগরিক আইনে আরাকানের জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কোনো স্থান দেয়া হয় না। দাবি করা হয়, মিয়ানমারেরোহিঙ্গাবলে কোনো গোত্র নেই। এর আগে ১৯৭৭ সালে মিয়ানমার সরকারড্রাগন রাজনামে এক সামরিক অভিযান চালায় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায়। সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় রাখাইনরা ব্যাপক নির্যাতন চালায় রোহিঙ্গাদের ওপর। সে সময় প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। যারা আর কখনো ফেরেনি তাদের স্বদেশে।

) ১৯৯০ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে একটি স্থানীয় আইন করা হয়। আইনে বলা হয়, সরকারি অনুমোদন ছাড়া রোহিঙ্গারা বিয়ে করতে পারবে না। অনুমোদনের দায়িত্ব দেয়া হয় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীনাসাকা হাতে। কেউ অনুমোদন চাইতে গেলে আষ্টেপৃষ্ঠে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত নাসাকা বড় অঙ্কের ঘুষ দাবি করে এবং এমন জটিলতা সৃষ্টি করে যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বৈধ বিবাহ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০০৫ সালে নাসাকা পুনর্গঠন করা হয়। সে সময় দীর্ঘদিন বিয়ের আবেদন গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। এর পর রোহিঙ্গাদের বিয়ে-সংক্রান্ত আইন সংস্কার করে তাতে যোগ করা হয়, কোনো রোহিঙ্গা দম্পতি দুয়ের বেশি সন্তান নিতে পারবে না। অলিখিতভাবে আরো একটি আইন চালু করা হয়- কোনো রোহিঙ্গা সমগোষ্ঠীর বাইরে কোনো প্রকারের সামাজিক সম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে পারবে না। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়ার নজির আছে।

) ১৯৯৪ সালে রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন বন্ধ করে দেয় মিয়ানমারের সামরিক সরকার। পরে জাতিসংঘের চাপে ১৯৯৫ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা ধরনের তালিকা করা হয় এবং নাগরিক হিসেবে একটি সাদা কার্ড দেয়া হয়। যেখানে জন্মস্থান জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয় না। প্রতারণার এই কার্ড প্রদানও বন্ধ করে দেয়া হয় কয়েক বছর পরে।

) মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পাশের গ্রামে যেতে হলেও নাসাকার কাছে থেকেট্রাভেল পাসনিতে বাধ্য করা হয়। ট্রাভেল পাসের জন্য নাসাকাকে দিতে হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ। তাতেও স্বস্তি নেই, ট্রাভেল পাসে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে না পারলে নাম কেটে দেয়া হয় নাসাকার তালিকা থেকে। ফলে জরুরি চিকিৎসা নিতেও বাধাগ্রস্ত হতে হয় রোহিঙ্গাদের। পদ্ধতিগতভাবেই স্বাস্থ্যসেবা থেকে দূরে রাখা হয় তাদের। এমনকি প্রসূতি নারীর সন্তান প্রসবের প্রয়োজনে গ্রামের বাইরের কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হলেও ট্রাভেল পাস নিতে হয়।

) ২০০১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি নিয়ন্ত্রণ করা হয় রোহিঙ্গাদের জন্য। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রামের স্কুল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হয়। ২০০৫ সাল থেকে তাও সংকুচিত করে আনা হয়। সেনাবাহিনীতে নিয়োগ এবং সরকারি চাকরি রোহিঙ্গাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় অনেক আগে থেকে।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠী। সে দেশের ১৩৬টি গোত্রের মধ্যে তারা একটি গোত্র। মিয়ানমার তাদের বাপ-দাদার ভিটা। যুগযুগ ধরে তারা সেখানেই বসবাস করে আসছেন। অথচ নিজ দেশের সরকার কর্তৃক তারা এত নির্যাতন, নিষ্পেষণের শিকার কেন? যুগযুগ ধরে তাদের বিরুদ্ধে এত অবিচার কেন? বিশ্লেষণ করলে উত্তর স্পষ্ট মিলে যায়। মিয়ানমার সরকার তার দেশেরোহিঙ্গানামের কোনো গোষ্ঠী রাখতে চায় না। গোষ্ঠীগতভাবে হত্যা করতে চায় রোহিঙ্গাদের। তাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চায় সে দেশের মানচিত্র থেকে। এই গণহত্যা বা জাতি হত্যার দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হলো নানাভাবে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ন্ত্রণ। মিয়ানমার সরকার যদি তার এসব কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারে তবে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন গোটা মিয়ানমারে হারিকেন জ্বালিয়েও একজন রোহিঙ্গা পাওয়া যাবে না। বিশ্লেষকদের মতে, ইতোমধ্যে মিয়ানমার সরকার অনেকটা সফলও হয়েছে। সেখানে মোট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। তাদের মধ্যে অশিক্ষার হার এখন ৮৫ ভাগ।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী ওয়াং সাং সুচি ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গারা আশায় বুক বেধে ছিল। তারা মনে করে ছিল এবার হয়তো তাদের ভাগ্য বদল হবে। আর হয়তো তাদের ভিটা-মাটি ছেড়ে পালাতে হবে না। তাদের মেয়েদের ধর্ষণের শিকার হতে হবে না। তাদের ঘর-বাড়িতে আগুন জ্বলবে না। সেনাবাহিনীর অত্যাচার বন্ধ হবে। নাসাকার নির্যাতন বন্ধ হবে। তারা ফিরে পাবে নাগরিক অধিকার। কিন্তু হায়, রোহিঙ্গাদের ভাগ্য বদল হয়নি। তাদের ছেলে মেয়েরা শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার ফিরে পায়নি। নাগরিকতো অনেক দুরের কথা, মানুষ হিসাবেই তারা স্বীকৃতি পায়নি। শান্তি বিজয়ী নেত্রীর আমলেই তাদের উপর নেমে এসেছে মহাহত্যাজ্ঞ। প্রতিদিন তাদের হত্যা করা হচ্ছে। বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, দেখার কেউ নেই। জাতিসংঘ, ওআইসি মিনমিন করছে। মুসলিম প্রধান প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশ দেখাচ্ছে চরম উদাসিনতা।

লেখক: প্রডিওসার, রেডিও বেইস ইতালি

আরআর


সম্পর্কিত খবর