![kashmir16](http://ourislam24.com/wp-content/uploads/2016/08/kashmir16.jpg)
কাশ্মির সমস্যাটি কিভাবে সৃষ্টি হলো, সে বিষয়ে একটু জেনে নেওয়া ভালো। আজ থেকে ৭০ বছর আগে কাশ্মিরের মহারাজা হরি সিং ভারতে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার জনগণ বিদ্রোহে ফুঁসে উঠে। ভারতের প্রথম ও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু প্রদত্ত কাশ্মিরের গণভোটের প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত করা যায়নি। ইতোমধ্যে শেখ আব্দুল্লাহ যখন ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করেন তখন পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ে। এভাবে ব্যাপক গণ-অসন্তোষের শ্বাসরুদ্ধকর পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মিরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষার তোয়াক্কা না করে ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে কাশ্মিরের যুক্ততার (এ্যক্সেসন) চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৫৩ সালে। ঐ চুক্তিতে কাশ্মিরের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ এ তিনটি ব্যবস্থাকে কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু গভর্নর জগমহন ও এন. এন. ভোহরাসহ অন্যরা এ রাজ্যের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের সকল কর্তৃত্ব বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেন। তাছাড়া গভর্নরগণ বিভিন্ন সময়ে কাশ্মিরের প্রতিবাদী ও সাধারণ জনগণের উপর শোষণ-নিপীড়ন ও দলন-দমনের ষ্টিম রোলার চালাতে থাকেন। নব্বইয়ের দশকে কাশ্মিরে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে ‘দ্য আর্মড ফোর্সেস অ্যাক্ট’ চালু করা হয়। এর অধীনে জনগণকে জুলুম-নির্যাতনের চরম ভোগান্তিতে ফেলা হয় যা অদ্যাবধি চালু রয়েছে।
১৯৫৩ সালের চুক্তির বাইরে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে কাশ্মিরে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছে, তার বিরুদ্ধে তখন থেকে নানামুখী প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। আজ থেকে দু-তিন বছর আগেও প্রতিবাদী কাশ্মিরীদের দাবি ছিল ভারত সরকার ১৯৫৩ সালের যুক্ততার নীতি অনুসরণ করুক। কিন্তু তাদের সে দাবির প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ করা হয়নি। ভারতের অবিসংবাদিত জননেতা পন্ডিত জওহর লাল নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ আব্দুল্লাহর দ্ব্যর্থহীন দাবি ছিল যেন ভারত উপর্যুক্ত তিনটি বিষয়ের বাইরে কোনো হস্তক্ষেপ না করে। কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কদর্য ইতিহাসেরও জন্ম দিয়েছে। প্রখ্যাত কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার কাশ্মিরের সর্বপ্রথম সশস্ত্র সংগ্রামী নেতা ইয়াসিন মালিককে কথা দিয়েছিলেন যে, কাশ্মিরের মানবাধিকারের উপর তিনি নিজে প্রতিবেদন তৈরি করবেন এবং তার ভিত্তিতে ঐ নেতা আমৃত্যু অনশন ভঙ্গ করেন।
কুলদীপ নায়ারের মতে, গত দু-তিন বছর আগেও কাশ্মিরের প্রতিবাদী জনগণের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মির সমস্যা সমাধানের যে সুযোগ ছিল, আজ তা প্রায় অসম্ভব। কেননা, ভারতীয় বাহিনীর সাম্প্রতিক ভূমিকায় প্রতিবাদী কাশ্মিরীরা এখন আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে একাত্ম ও একগুঁয়ে হয়ে উঠেছে। তাদের সমন্বিত আন্দোলনকে আজাদী বা স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা হয়, আর এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে যে ফ্রন্ট তার নাম হলো ‘হুররিয়্যাত’ বা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। হুররিয়্যাত আন্দোলন এখন তিনটি ধারায় বিভক্ত। প্রথমটি ইউসুফ রাজা গিলানির নেতৃত্বে, দ্বিতীয়টি ইয়াসিন মালিকের নেতৃত্বে এবং তৃতীয়টি সাব্বির শাহ্ এর নেতৃত্বে। হুররিয়্যাতের প্রথম শাখার অনুসারীরা কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে চান। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় শাখার অনুসারীরা ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এবং ১৯৫৩ সালের যুক্ততার নীতির আওতায় কাশ্মির সমস্যা সমাধানের কথা বলে আসছেন। হুররিয়্যাতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শাখার সংলাপে বিশ্বাসী নেতৃদ্বয়কে আজ কারাগারে আটক রাখা হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে জনতার প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ চলছে।
গত জুলাই মাসে হিজবুল মুজাহিদীন কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কাশ্মির উপত্যকা। ৭৩ জন কাশ্মিরী নিহত হয়েছেন এবং হুররিয়্যাত আন্দোলনকারীরা নেতৃত্ববিহীন আন্দোলনে দিশেহারা হলেও স্বাধীনতার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। ইতোপূর্বে ইয়াসিন মালিক ও সাব্বির শাহ্ কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দিল্লি ও শ্রীনগরের বিশেষ গোপন আলোচনা বা কনক্লেভে অংশ নিলেও তাদের অবর্তমানে অনুসারীরা এবং সাধারণ জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামে আপসহীন হয়ে উঠেছে, এমনকি হুররিয়্যাত এখন সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে।
কাশ্মিরে বিরাজমান উপযুক্ত পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের সামনে তিনটি বিকল্প রয়েছে: ক) অধিকতর দমন-পীড়ন চালিয়ে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব জারি রাখা; খ) ১৯৫৩ সালের যুক্ততার চুক্তির পূর্ণ অনুসরণ করা; কিংবা গ) কাশ্মিরকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা। প্রথম বিকল্পের ব্যর্থতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং অতি দ্রুত ভারতের উচিত কাশ্মিরের উপর সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করা, পূর্বেকার জুলুম-নির্যাতনের রিপোর্ট পেশ করা। কাশ্মিরী জনগণকে আস্থায় আনতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তৃতীয় বিকল্প কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর এবং কঠিন বিষয়। কিন্তু এ ইস্যুতে জম্মু-কাশ্মিরের জনগণ একাত্ম হয়েছে, যা মোকাবিলা করা হয়ত সমধিক কঠিন বিষয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিকল্প বাস্তবায়নের পথ কেন্দ্রীয় সরকারের একদম নাগালে। কারাগারে বন্দী হুররিয়্যাত্ নেতৃবৃন্দের মুক্তি দিয়ে এ পথে প্রথম পদক্ষেপ সৃষ্টি করা সম্ভব। কুলদীপ নায়ারের মতো সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ, মানবাধিকার কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রভৃতি অংশের সমন্বয়ে সরকার একটি ‘সমাধান-গোষ্ঠী’ তৈরি করতে পারে। যারা প্রতিবাদী কাশ্মিরীদের সঙ্গে নিবিড় আলোচনার সুযোগ তৈরিতে সক্ষম হবেন। কেন্দ্রীয় সরকারকে মনে রাখতে হবে আন্দোলনকারীদেরকে মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, জঙ্গি হিসেবে প্রচার করে পরিস্থিতি ঘোলা না করে তাদেরকে মুক্তি সংগ্রামী হিসেবে সম্মানিত করলে কাশ্মিরের জনগণের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি শুদ্ধ আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে উঠবে— যা ১৯৫৩ সালের চুক্তির বাস্তবায়নের প্রথম ও প্রধান পূর্বশর্ত। বিদ্রোহীরা এখন শ্রীনগরকে লন্ডন, ওয়াশিংটন বা টোকিওর ন্যায় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেছেন। এ কল্পনা ভারতকে উত্ত্যক্ত করতে পারে, কিন্তু গণ-মানুষের মন-কাঠামোয় সেই কল্পনার যে প্রোজ্বল প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন ঘটেছে, তা মুছে ফেলা বর্তমান বাস্তবতায় খুবই দুরূহ। কাশ্মিরী আন্দোলনকারীদেরকে সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে না পারলে, ইউসুফ রাজা গিলানির নেতৃত্বাধীন হুররিয়্যাত গোষ্ঠী সুযোগ নিতে চাইবে এবং চলমান আন্দোলন ভিন্ন খাতে চলে যেতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করা আরো কঠিন হয়ে উঠবে। কাশ্মিরের যে কিশোর-যুবকরা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর পাথর নিক্ষেপ করছে, তাদেরকে ‘পথভ্রষ্ট’ বলে বিবেচনা না করে তাদের কর্মের মধ্যেই বৃহত্তর জনগণের স্বাধিকারের প্রত্যাশা নিহিত রয়েছে— এ বাস্তবতার বোধ কেন্দ্রীয় সরকারকে কাশ্মির সমস্যা সমাধানে পারঙ্গম ও প্রত্যয়ী করে তুলতে পারে। তৃতীয় একটি বাস্তবতা কেন্দ্রীয় সরকারকে কাশ্মির সমস্যা সমাধানে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারে। তা হলো অধিকাংশ হুররিয়্যাত নেতা কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত দেখতে চান না, তারা পাকিস্তানকে অপছন্দ করেন, তারা স্বাধীন থাকতে চান।
কাশ্মির সমস্যার সমাধান এখন দুটি বিন্দুতে আটকে আছে। প্রথম বিন্দুতে ভারত সরকার, যারা কখনো কাশ্মিরের স্বাধীনতা দেখতে চায় না এবং পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মিরের যুক্ততা মানবে না। আর দ্বিতীয় বিন্দুতে কাশ্মিরের প্রতিবাদ-প্রতিরোধকারীরা, যারা স্বাধীন হতে চাচ্ছে এবং যারা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে ঘৃণা করে। এ দু’বিন্দুর মধ্যখানেই কাশ্মির সমস্যার সমাধান খোঁজা যায়। অর্থাত্ কাশ্মিরকে ১৯৫৩ সালের চুক্তি অনুযায়ী তিনটি বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে স্বায়ত্ত্বশাসনের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়। এর ফলে কাশ্মিরীরা স্বায়ত্তশাসনের স্বাদ অনুভব করবে, এবং তাদের পূর্ণ সার্বভৌমত্বের দাবি থেকে সরে দাঁড়ানো তাদের জন্য সহজ হবে। এ সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী বা চিরস্থায়ী সমাধানের জন্য বিবদমান গোষ্ঠী এবং আঞ্চলিক স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে সংলাপ অতীব জরুরি। কুলদীপ নায়ারের মতে, কাশ্মির সমস্যাটি এখন একটি ত্রিভুজাকৃতির সমস্যার রূপ ধারণ করেছে। তা সমাধানের জন্য ভারত, কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী জনগণ ও পাকিস্তান এ তিনটি বিন্দুকেই স্পর্শ করতে হবে। কাশ্মিরকে ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক ভুল বোঝাবুঝির সমাধান জরুরি। দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা পৃথিবী এখন সন্ত্রাসবাদের আঘাতে জর্জরিত। আঞ্চলিক শক্তিসমূহের সমন্বিত পদক্ষেপ এ সন্ত্রাসবাদ দমনে সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তান দুটি দক্ষিণ এশীয় পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রকে একনিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে কাশ্মিরের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আন্দোলনকারীরা একসময় আরো ভয়ঙ্কর কৌশল গ্রহণ করবে। সেক্ষেত্রে সন্ত্রাসের চারণভূমিতে পরিণত হতে পারে গোটা কাশ্মির উপত্যকা। কাশ্মীির সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে কাশ্মিরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত করে পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। কাশ্মিরের পুরো ভূখণ্ড বৈশ্বিক পর্যটনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের পণ্য কাশ্মিরে বিক্রির জন্য বাজার গড়ে তোলা সম্ভব। অন্যদিকে পাকিস্তান ও ভারতের বাজারেও কাশ্মিরের প্রবেশাধিকার দিয়ে আঞ্চলিক আন্তঃবাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়।
লেখক: প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিন, স্কুল অব বিজনেস এন্ড সোস্যাল সাইন্সেস. সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
ইত্তেফাক
এফএফ