শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


বাবা আসে গভীর রাতে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবু তালহা মিহরাব

রাত অনেক গভীর। সবাই ঘুমে। বারান্দার লাইট জ্বালানো। হঠাৎ হাঁটার শব্দ শুনা যায়। কোনো একজন হাঁটছে নিশ্চয়। ভৌতিক আওয়াজ। শুনতে কেমন যেনো ভয় লাগে।

মানুষ সাধারণত এভাবে হাঁটে না। শক্ত মাটিতে গরুর হাঁটার মতো শব্দ। এমন ভাবে পা ফেলে, যেনো বারান্দা মাপছে। মাঝে মাঝে থামে, শুরু করে আবার। লোকটার হাঁটা ভূত এবং মানুষের ক্যাটাগরিতে পড়ে না। ভূতের হাঁটা অনেক ভৌতিক, মানুষেরটা আরো স্বাভাবিক।

শান্তভাবে হাঁটলেও পেছন থেকে ধাওয়া করে একটা অচেনা ভয়। আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। গলা শুকিয়ে খটোমটো। ঢুক গিলতে পারছি না। হাটুর উপর থেকে কাঁথা টেনে মাথা ঢেকে নিই।

ডান কাত হয়ে ঘুমুতে মন চায়। খাটের খটমট শব্দের ভয়ে কাত পরির্বতন করিনি। এতক্ষণে ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দুর মতো কপালে ঘাম জমে উঠে। বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করে।

লোকটা দরোজায় কান পাতে। ভেতরের কিছু শুনতে চায়। আমি খুব আস্তে আস্তে শ্বাস ছাড়ি। অনুভূব করলাম, কাঁথা ধরে কেউ টানছে। হৃৎপি-ে শুরু হয় হাতুড়ি পেটা। ডানহাত চেপে ধরি বুকে। কাঁপা থামে না।

ভয়ংকর সব প্রশ্ন বরফের মতো বুকে জমাট বাঁধে। রুমে ঢুকল কে? আমি কি দরোজা খুলে ঘুমিয়েছিলাম? কেউ তো এলে শব্দ পেতাম। একবার ভাবি, কাঁথার ফাঁক দিয়ে দরোজাটা দেখে নিই।

আমি কাজটা অনায়াসে করতে পারতাম। কিন্তু চোখ মেলে তাকাতে ইচ্ছে করছে না এ মুহূর্তে। কাঁথা টানা বন্ধ হয়। আসলে, কাঁথা কেউ টানেনি; মনের ভুল।

কাচের জানালা দিয়ে লোকটার কালো ছায়া দেখা যায়। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল, নীলাভ দাড়ি, খাড়া খাড়া শক্ত মুঁচ। ধূসর চেহারা। চোখ দুটো বিড়ালের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। জানালায় পড়ছে লোকটার নিঃশ্বাসের ছাপ।

শীতের কুয়াশা যেনো লেপ্টে আছে কাচে। বুকের উঠানামায় বুঝা যায়, লোকটা শ্বাস ফেলছে খুব দ্রুত। হাত দিয়ে বাষ্পগুলো মুছে দেয়। আঙুল তুলে হঠাৎ আমার দিকে কী যেন ইশারা করে। কিছু বুঝে উঠতে পারিনি।

লোকটার অদ্ভূত আচরণ আমাকে বিস্ময় করে তুলে। তাকাতে পারছি না আর। চোখ বন্ধ করে নিই। আমাকে দৌড়াচ্ছে। বিশাল রাস্তার উপর দিয়ে দ্রুত বেগে ছুটে চলছি। পেছনে পেছনে লোকটা। আমার হাঁটা এগোয় না।

পা যেনো পেছনে দৌড়ে। লোকটা আমার একেবারে কাছে চলে এলো। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে। আলতো করে আমার মাথা ছুঁয়। আমি আধমরা হয়ে যাই ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে ঘাড় ফিরে পেছনে তাকাই।

বাবা! তুমি? কথা বললেন না। শরীর থেকে পারফিউম বেরুয়। কড়া গন্ধ। বাবা বেঁচে থাকতে এরকম তীব্রগন্ধযুক্ত পারফিউম ব্যবহার করতেন। চেহারাটা অনেক বদলে গেছে। সেলাই ছাড়া কুর্তা পরে এলেন।

বাবার ঠোঁট নড়ে ওঠে। শব্দ করে কথা বলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শব্দ হচ্ছে না কোনো ভাবেই। আমার কাছে এখন বাবাকে অতি স্বাভাবিক মানুষ মনে হয়। যদিও তিনি  মোটেই স্বাভাবিক নন। তাঁর হাতে হীরার একটি আঙটি, চকচক করে। পৃথিবীর সব চেয়ে কঠিন বস্তু।

শাহেদ! এই শাহেদ। উঠ্, অফিসে যাবি না? ছেলেটার এত ঘুম! বলতে বলতে মা আমার পিঠে আলতু করে হাত বুলান। আমি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠি। মা ঘাবড়ে যান আমার আচরণ দেখে।

-এই, তুই অমন করে লাফিয়ে উঠলি কেন রে? কী হয়েছে তোর? স্বপ্নে কিছু দেখলি?
-হুম। বাবাকে দেখছিলাম।

-সত্যি! তাড়াতাড়ি আমাকে বল তো। কথাটা বলতে বলতে আমার পাশে এসে বসেন। আমি পুরো স্বপ্ন বলে শেষ করলাম।

মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন। তুর বাবাকে খুব মিস করছি রে! খুব অসহায় ভঙ্গিতে মা বললেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। কিছু বলতে পারছি না। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। শ্বাস টানি থেমে থেমে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরি নিচের ঠোঁট।

হাঁটুর উপর মাথা রেখে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন থাকেন। এ মুহূর্তে মার কান্না আমার কাছে শিশুর মতো মনে হয়। যদিও অন্য কেউ এটাকে শিশু সুলভ ভাববে না। মা সাধারণত অমন করে কাঁদেন না। আজ কাঁদলেন বাবার জন্য। বাবা না থাকায় ভেতরে ভেতরে আমিও জ্বলছি খুব।

সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল। এপ্লাস পেলে একটা মোবাইল কেনে দেওয়ার আবদার রাখলাম বাবার কাছে। বাবা কিছু বললেন না। মুখে হালকা ছাপ পড়ল বিষণ্নতার। ঠোঁটে একটু হাসি টেনে মাথা নাড়লেন শুধু। খুব কষ্ট করে যে হাসি দিলেন, আমার বুঝতে বাকি রইল না।

গরিব বাবার পক্ষে একটা নরমাল মোবাইল কেনে দেওয়া কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আমি চেয়ে আর না করলাম না কেনো জানি না। একদিন পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরছিলাম । সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই অবস্থা। আকাশ পরিষ্কার থাকায় মনে হল, সন্ধ্যের অনেক বাকি। বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছিলাম।

মাথা তুলে একবার চেষ্টা করলাম, বাড়িটা দেখার। বাড়ির আশেপাশে মানুষের সরাগম। শরীরে হালকা ঝাঁকুনি লাগল। বুব কাঁপে। বাড়ির দিকে চোখ তুলে আর থাকাতে পারলাম না। কী ঘটতে পারে? ঝগড়া? দুর্ঘটনা?

মাথায় অগণিত প্রশ্ন ভিড় বাঁধে। ধুর ধুর করে বুক। চেষ্টা করলাম দ্রুত হাঁটার। কিন্তু পা যেন এগোচ্ছিল না কোনো ভাবেই। ভেতরে রহস্য ঘুরপাক খায়। কৌতূহল বাড়তে থাকে। বাতাসে কান্নার শব্দ এল।

মেয়েলি আওয়াজ। চাপা আর্তনাদ। ভেতরে ভেতরে শরীর ঘামছিল। কোনো রকম বাড়ির কাছে চলে এলাম। চোখের সামনে অনেক চেনা-অচেনা মুখ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। অমন করে আমার দিকে কেউ তাকালে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি আমি। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

থমথমে পরিবেশ। বিষণ্নতার কালো ছায়া সবার মুখে লেগে আছে। কোনো দুর্ঘটনা নিশ্চয়। কারো কাছ থেকে ব্যাপারটা জানার মতো সাহস আমার ছিল না সে মুহূর্তে। ঘরে ঢুকার সামান্য বাকি। এমন সময় কে যেনো পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

ভাইয়া! তুমি এখন এলে? আমার ভেতর কেঁপে উঠল। তাসমিয়া! কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেনো বোন? ভাইয়া, বাবা আর নেই! কথাটা তীরের চেয়ে বেগে আঘাত হানল আমার বুকে। রক্ত উচ্ছলিত হয়ে উঠল।

ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ ধপাস করে পড়ে গেলাম মেঝেতে। আমার মাথায় পানি ঢেলে দেওয়া হল। চোখ খুলে তাকালাম। কত সময় বেহুশ ছিলাম জানি না। মাথা ভার হয়ে উঠল। বাবার মৃত চেহারাটা তখনও দেখিনি।

কান্নায় শরীর কাঁপছিল। চোখের সামনে বাবার চেহারা ভাসলে কলজে চ্যাঁৎ করে ওঠে। পেরেক দিয়ে বোধ হয় আমার কলজে ছিদ্র করে কোনো একজন। আমি লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবাকে জোরে জোরে ডাকতে ইচ্ছে করল খুব। যতদিন বেঁচে ছিলেন, আমি বাড়ি ফিরলে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেন কপালে।

বলতেন- একদিন তুই বড় হবি। আজ কে বলবে এ কথা? দুহাতে আমার কোমর পেঁচিয়ে দাঁড়াল তাসমিয়া। কাঁদিস না বোন। তোর কান্না আর সইতে পারছি না রে! আমি কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম। আমার কান্না দেখে তাসমিয়ার কান্না হয়তো বাড়বে। কিন্তু থামাতে পারলাম না কিছুতেই।

যন্ত্রণায় ছটফট করে বুক। শশ্মান ঘাটে আমার কলজে পুড়িয়ে কে যেনো ধূসর ছাই নিক্ষেপ করল বাতাসে। কান্দিস না বাবা, উঠ্। বাম কাঁধের উপর হাত রেখে কথাটা বললেন কাদের চাচা।

দিনের আলো গেছে ফুরিয়ে। পূর্ণিমার ঝাপসা আলোয় চাচার মুখ দেখা যায়। আমি চাচার সাথে কোনো কথা বললাম না তখন। গোরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হল লাশকে। শবদেহ কবরে রাখার আগে সাদা কাফনে মোড়ানো মুখে শেষবারের মতো একবার চুমো খেলাম।

বাড়ির পাশেই বাবার কবর। আমি রোজ একবার জিয়ারত করি। এরকম আকস্মিক মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারল না। পারিবারের প্রত্যেকের মনে সুপ্ত প্রশ্ন- বাবা কেন মারা গেলেন?

এভাবে কেটে গেল অনেক দিন। মৃত্যু রহস্য খুলেনি। মন ভালো থাকে না কেউরই। বাবা মারা যাবার পর থেকে সকলের মুখের হাসি অদৃশ্য হয়ে যায়। সবার চোখে স্যাঁত স্যাঁতে পানি লেগে থাকত।

কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলা হত না। ঝিম মেরে বসে থাকত সবাই। মা প্রায় পাগলের মতো। সংসারে অভাব বাড়তে থাকে। তিন বেলা খাবার জুটত না। ভোগ-বিলাসিতা না থাকলেও বাবা থাকতে অন্তত তিন বেলা জুটত।

কোন এক বিকালে আমাদের বাড়িতে এলেন কাদের চাচা। ভাবসাব দেখে মনে হল কিছু বলবেন। কিন্তু শুরু করবেন কীভাবে বুঝতে পারছিলেন না। আমার সামনের চেয়ারটায় বসলেন তিনি।

আচমকা আমার হাত চেপে ধরলেন। মুচড়ানো একটা হলদে খাম দিলেন আমার হাতে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই খাম খুলতে ইশারা করলেন। আমি খাম খুব আস্তে আস্তে খুললাম। আমার চোখ ছানাবানা।

সাত হাজার টাকা! একবার খামে আরেকবার চাচার দিকে তাকাই। কোনো কথা বলছিলেন না। টলোমল করছিল চোখ। শ্বাস নেন থেমে থেমে। চোখের কোণ চিকচিক করছিল পানিতে। গাল বেয়ে পানি ঝরল।

মুখ তেলতেলে থাকায় খুব দ্রুত পানি মাটিতে পড়ে গেল। বড়রা সহজে কাঁদে না। কাদের চাচা কাঁদলেন। আমিও কান্না থামাতে পারছিলাম না। চাচার কথা শুনে স্থির রাখতে পারলাম না নিজেকে।

বাবা কি সত্যিই কিডনি বেঁচে মায়ের চিকিৎসা, পারিবারিক খরচ সামলাতে চেয়েছিলেন? তোমার বাবা প্রথমেই কিডনি বেচার প্লান করেননি। বাধ্য হন। তোমার মায়ের ভীষণ অসুখ। বাঁচাতে হলে প্রচুর টাকা দরকার।

এত টাকা পাবেন কোথায়? গরিবকে কেউ টাকা দিতে চায় না। হাত পাতলেন গ্রামের ধনীদের কাছে। ঋণ দিতে চায় না কেউই। এমনকি চেয়ারম্যানের পায়ে পর্যন্ত লুটিয়ে পরলেন, টাকার জন্য। কাকুতি-মিনতি করলেন খুব। ‘স্যার, টাকাটা না দিলে চোখের সামনে স্ত্রী মারা যাবে!’ খিদের জ্বালায় সন্তানেরা  কি করবে জানি না।

চেয়ারম্যান বেচারা খুব বিরক্তির চোখে তাকাল। কপাল কুঁচ করে বলল- আমার কাছে টাকা জমা রাখছিলে নাকি? চাইলেই দিয়ে দেব? সেই দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়াল না কেউই। বাধ্য হলেন অঙ্গ বেচতে।

এটুকু বলে থামলেন কাদের চাচা। কিন্তু টাকাটা কিসের? আমি প্রশ্ন করলাম। এটা কিডনি বেচার টাকা ! তুমি নাকি তোমার বাবার কাছে মোবাইল চেয়েছিলে? আমি কথা বললাম না। মরার আগে আমার কাছে জমা রেখে বলেছিলেন- খামটা শাহেদের কাছে দিস্।

আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। অবাক হয়ে  চেয়ে রইলাম শুধু। নীরবে চোখের পানি ঝরছিল। কাদের চাচা চলে যান।

কাজের মেয়ে টেবিলে চা রেখে যায়। অফিসের সময় পেরিয়ে গেছে খানিক আগে। মা দরোজার পর্দা ঠেলে রুমে ঢুকেন। এই, তুই এখনও রেডি হস্নি? মা, আজ অফিসে যাব না।

আমার মন বেশ ভালো না। কিছু না বলে চলে যান মা। দাঁত ব্রাশ করে দিনের প্রথম কাপ চা পান করি। আমি চায়ের সাথে দু থেকে বেশি বিস্কুট খাই না।

চেয়ারে বসে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে বইটা নিই। রকমারি থেকে কিনে ছিলাম। অবসরে আমি বই পড়ি। আমার ভালো লাগে। কিন্তু আজ ঝাপসা লাগে বইয়ের কালো কালো অক্ষর।

পড়ায় মন বসছে না। শুধু বাবাকে মনে পড়ে। বুকের উপর বইটা রেখে দিই। কল্পনায় শুধু বাবা। টাকার অভাবে পৃথিবীতে কত মানুষ যে মারা গেছে এর হিসেব হবে না কোনো দিন।

গরিব সুখে থাকে, কথাটা ভুল। টাকার জন্য মানুষ মরে-বাঁচে। বাবা! আজ আমার সব আছে, শুধু তুমি নেই। তোমার কিডনি বেচার টাকা দিয়ে আমি আজ এত বড়! সুখে থেকো বাবা। তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না!

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ