বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


ইসলামিক স্ট্যাডিজে জেনারেল সাবজেক্ট প্রাধান্য দেয়ায় ইসলামি শিক্ষা অপূর্ণ থাকছে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

mahfuzul-haq-copyচলমান সময়ের আলোচিত একটি বিষয় কওমি সনদের স্বীকৃতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি নিয়ে একটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অনলাইন-অফলাইনে স্বীকৃতির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার ঝড় বইছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা এখন কী ভাবছেন, স্বীকৃতি নিয়ে বেফাকের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি কী? এ ব্যাপারে কথা বলেন দেশের বিশিষ্ট আলেম ও শিক্ষাবিদ, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার যুগ্মমহাসচিব, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক। স্বীকৃতি বিষয়ে বেফাকের অবস্থান তুলে ধরেছেন। বলেছেন সম্ভাবনা ও শংকার কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ এহসানুল হক

প্রথম পর্বের লিংক: যে স্বীকৃতি কওমি’র জন্য সুফল হবে সরকার সে দিকে যাচ্ছে না

আমরা বেফাক বোর্ড এর সনদের স্বীকৃতি চাচ্ছি, তবে সনদ কিন্তু কোনো বোর্ড দিতে পারে না। সনদ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই দিতে হয়। তাহলে বেফাক কীভাবে সনদ দিবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : বেফাককে যদি এফিলিয়েটিং ক্ষমতা দেয়া হয় তাহলে বেফাকও সনদ দিতে পারবে। এজন্য ইউনিভার্সিটি হওয়া জরুরি নয়। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রয়োজন হয় তাহলে বাংলাদেশে এমন অনেক কওমি মাদরাসা আছে যেগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে নিয়ে যাওয়া যাবে। আর কীভাবে স্বীকৃতি বাস্তবায়িত হবে এটা কিন্তু পরবর্তী ধাপ। আগে সঠিক পদ্ধতিতে স্বীকৃতি প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত আসতে হবে। এরপর সেই সিদ্ধান্ত কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সেটা তারাই চিন্তা করবে। আর যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সনদ প্রদানের প্রক্রিয়া করতে হয় তাহলে করবে, সেটা তো সমস্যার কিছু নয়।

শুধু বেফাককে সনদ দিলে বাকি বোর্ডগুলোর কী হবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : আমরা মনে করি এই স্বীকৃতির মাধ্যমে সবগুলো বোর্ড মৌলিক একটা জায়গায় এক হবে। সবাই যার যার মতো কাজ করবে কিন্তু সনদের ক্ষেত্রে বেফাকের সাথে সমন্বয় করবে। অন্য বোর্ডগুলো কিন্তু আগে এমনই ছিল। তাদের সাথে বেফাকের সমন্বয় ছিল। পটিয়া ইত্তেহাদুল মাদারিসের নিজস্ব কার্যক্রমের পাশাপাশি একসময় বেফাকের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। উত্তরবঙ্গের তানজিমুল মাদারিসও বেফাকের সাথে ছিল। সিলেটের আজাদ দ্বীনি ইদারা, এরপর গওহরডাঙ্গা বোর্ডও বেফাকের সাথে কমবেশি সংশ্লিষ্ট ছিল। আজকে বেফাকের বাইরে আরও যে চারটা বোর্ডের আলোচনা আসে ওই বোর্ডগুলোর কোনো এক সময় বেফাকের সাথে সমন্বয় ছিল। ঠিক ঐভাবে যদি সমন্বয় করে নেয়া হয় তাহলেই আর কোনো সমস্যা থাকবে না। সমস্ত বোর্ডগুলো যার যার মতো নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এবং সনদের ক্ষেত্রে তারা বেফাকের সাথে সমন্বয় করবে, এটা কোনো সমস্যার কারণ হতে পারে না।

মাদরাসা সংখ্যার বিবেচনায় অন্য বোর্ডগুলোর সাথে বেফাকের ব্যবধানটা কেমন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : যদি দাওরায়ে হাদিস মাদরাসা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে প্রায় ৮০ ভাগ মাদরাসা বেফাকের সাথে আছে। বাকি ২০ ভাগের ১০/১২ ভাগ অন্য বোর্ডগুলোর সাথে আছে। আর বাকিটুকু কোনো বোর্ডের সাথেই নেই। আর যদি দাওরা হাদিস ছাড়া অন্যান্য মাদরাসাগুলোর বিবেচনা করা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে ৫৫/৬০ ভাগ মাদরাসা বেফাকের সাথে আছে। আর অন্যান্য বোর্ডগুলো সাথে ২০ ভাগ। বাকিগুলো কোনো বোর্ডের সাথেই নেই। এটা আনুমানিক হিসাব।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখলাম বেফাকের পক্ষ থেকে সিলেট জেলা কমিটি গঠন করা হলো, বেফাক কি কোনো রাজনৈতিক দল? তাদের কেন জেলা কমিটি থাকবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : বেফাকের কাজটাকে গতিশীল করা, সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করা, তৃণমূল পর্যায়ের মাদরাসা পর্যন্ত পৌঁছানো, তাদের সুবিধা অসুবিধায় তাদের পাশে দাঁড়ানো, প্রতিষ্ঠানগুলো গতিশীল করতে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি বিষয় চিন্তা করে জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশেষ করে কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য এলাকাভিক্তিক সংগঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। এজন্যই মূলত জেলা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এর বাইরে বেফাক তো অবশ্যই কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। এবং এটাকে রাজনৈতিক দল মনে করার কোনো অবকাশও নেই। আর জেলা কমিটি হলেই রাজনৈতিক দল হতে হবে কেন? কত অরাজনৈতিক সংগঠনেরই তো জেলাভিত্তিক কমিটি আছে।

বেফাকের নেতৃবৃন্দের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বেফাকের দায়িত্বশীল প্রায় সবাই বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ। সবাই রাজনৈতিক নেতা, এটা কেন? এখান থেকে বের হওয়ার কোনো চিন্তা কি বেফাকের আছে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : আমাদের দেশের গ্রহণযোগ্য উলামায়ে কেরাম প্রায় সবাই ইসলামি আন্দোলনের সাথে জড়িত। তাদেরকে যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব বেফাকে আর থাকবে না। তখন বেফাকের জন্য সঠিক পথে আগানোই কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যারা ইসলামি আন্দোলন করছেন তারাই মাদরাসা পরিচালনা করছেন, যারাই মাদরাসা পরিচালনা করবেন তারাই বেফাকের নেতৃত্বে আসবেন এটাই স্বাভাবিক। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হিন্দুস্তানেও ব্যাপারটি এমনই। সেখানে ইসলামি দলগুলোর যারা নেতৃত্ব দেন তারাই মাদরাসাগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেখানে তো এই প্রশ্ন কেউ করে না রাজনৈতিক নেতারা কেন মাদরাসাগুলোর নেতৃত্ব দেয়? দারুল উলূম দেওবন্দের নেতৃত্ব যাদের হাতে হতারাই তো আবার জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতৃত্ব দেন। সেখানে তো প্রশ্ন আসছে না। আর সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে রাজনীতি আর শিক্ষাব্যবস্থা যেমন আলাদা আমাদের পর্যায়ে তেমন আলাদা নয়। আলেমদের যেমন দায়িত্ব ইসলামি আন্দোলন করা, তালিম তথা শিক্ষা ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখাও আলেমদেরই দায়িত্ব। দুইটাকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, বেফাকের মধ্যে কোনো দলের প্রভাব যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়। এবং বেফাকের মূল দুটি পদ সভাপতি ও মহাসচিব পদে দায়িত্বের জন্য কোনো রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে না থাকার শর্ত গঠনতন্ত্রে রয়েছে।

দাওরার সনদকে ইসলামিক স্টাডিজের সমমান দিতে চায় বেফাক, কিন্তু ইসলামিক স্টাডিজে যে জেনারেল বিষয়গুলো থাকে যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস এগুলোতো মাদরাসাগুলোতে পড়ানো হয় না। তাহলে দাওরাকে কীভাবে ইসলামিক স্টাডিজের মান দেয়া হবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : ইসলামিক স্টাডিজের যে মূল বিষয়, এই বিষয়ে একজন ভার্সিটির ছাত্রের চেয়ে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা অনেক বেশি অগ্রসর। আর স্বীকৃতি গ্রহণের জন্য কিছু সাবজেক্ট যদি আমাদের সিলেবাসে অর্ন্তভুক্ত করতে হয় তাহলে সেটা আমরা করবো। আর এমনিতেই আমাদের সিলেবাসে জেনারেল সাবজেক্ট অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক আছে। সেটা দশম শ্রেণি পর্যন্ত নেয়ার চিন্তা-ভাবনা আছে। আরও যে সকল সাবজেক্ট যতটুকু না হলেই নয় সেটুকু অবশ্যই অর্ন্তভুক্ত করা যাবেÑ এটা তো কঠিন কোনো বিষয় না।

এখনও পর্যন্ত একক নেসাব হয়নি। বেফাকভুক্ত সব মাদরাসার নেসাবও এক না। এটা কেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : বেফাকভুক্ত মাদরাসাগুলোর নেসাবের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। মৌলিকভাবে মিল আছে। আর যতটুকু ভিন্নতা আছে সেটাও মিলিয়ে নেয়া যাবে। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানভেদে কিছু কিছু পার্থক্য থাকে। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনার্সের নিজস্ব কারিকুলাম থাকে। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিষয়ে অনার্সের সিলেবাস এক রকম হয় না। পাবলিক, ন্যাশনাল, প্রাইভেট সবগুলোর ক্ষেত্রেই একই কথা। অনার্সের সাবজেক্ট এক হলেও সিলেবাস ভিন্ন ভিন্ন। যেমন ইকোনোমিক্স, এটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইন্সের সাবজেক্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য সব জায়গায় আর্সের সাবজেক্ট। অনার্স লেভেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের ভিন্নতার তুলনায় কওমি মাদরাসার নেসাবের ভিন্নতাটা তুলনামূলক অনেক কম।

ইসলামিক স্টাডিজের সমমান নিতে চাইলে তো অনেকগুলো জেনারেল সাবজেক্ট অর্ন্তভুক্ত করা প্রয়োজন, ব্যবধানটা তো অনেক বেশি, এটা কীভাবে সমাধান হবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : আসলে আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামিক স্টাডিজ ও এ্যারাবিকে অনার্স মাস্টার পর্যন্ত যে পরিমাণ জেনারেল শিক্ষার সমন্বয় করা হয়েছে সেটা নিয়েও তো প্রশ্ন করা যায়, এত পরিমাণ জেনারেল সাবজেক্ট ঢুকানোর কি যৌক্তিকতা আছে। এই অতিরিক্ত জেনারেল সাবজেক্ট ঢুকানোর ফল কি হয়েছে সেটা আমরা জানি। যারা বিশ্ববিদ্যায়ল থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স মাস্টার করছে, তাদের এই বিষয়ে কতটুকু জ্ঞান হচ্ছে। জেনারেল সাবজেক্টকে প্রধান্য দিতে গিয়ে মূল সাবজেক্টের শিক্ষাই সেখানে হচ্ছে না। সেখানকার ছাত্রদের টার্গেট থাকে বিসিএস। আর বিসিএসের জন্য জেনারেল শিক্ষার প্রয়োজনটা বেশি, তাই ছাত্ররা এর পিছনেই পড়ে থাকে। ইসলামি শিক্ষা আর হয় না। তাহলে এমন ইসলামিক স্টাডিজের সিলেবাস কীভাবে মানদণ্ড হতে পারে? আমরা মনে করি সেখানে প্রকৃত ইসলাম শিক্ষা দেয়া দরকার। সাধারণ শিক্ষার চাপ আরও কমানো উচিত। তবে আমাদের মাদরাসার ছাত্রদের যদি ইসলামিল স্টাডিজে মাস্টার্সের সনদ দেয়া হয় তাহলে এটাই হবে যোগ্য ব্যক্তিকে সনদ দেয়া।

নিবন্ধনের শর্ত মানলে সমস্যা কী?
মাওলানা মাহফুজুল হক : নিবন্ধনের শর্ত মানলে মাদরাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। আর আমাদের সরকারগুলো তো ইসলামি বিধি বিধানের ন্যূনতম কোনো তোয়াক্কাও করে না। যেমন আলিয়া মাদরাসাগুলো দেখুন, সেখানে হিন্দু শিক্ষকদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৩০ পার্সেন্ট মহিলা শিক্ষক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলামি পরিবেশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যে দেশের সরকারের অবস্থা এই যে তারা একটা মাদরাসা শিক্ষা ব্যাবস্থাকে ন্যূনতম ইসলামি ধারায় রাখতে প্রস্তুত নয়। সে ধরনের সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে ইসলামের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।

আজকে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে চলছে, যার যেখানে ইচ্ছা মাদরাসা করছে, যে নেসাব ইচ্ছা পড়াচ্ছে, যাচ্ছে তাই সনদ বিতরণ করছে- এগুলো তো বেফাক নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আবার আপনারা সরকারের নিয়ন্ত্রণেও যেতে চাচ্ছেন না,তাহলে সমাধান কীভাবে হবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : বেফাক একটা উন্নয়নশীল সংগঠন। ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। বেফাক যদি আরও শক্তিশালী হতে পারে এবং অন্যান্য বোর্ডগুলোর সাথে সমন্বয় হয়ে যায় তাহলে সমন্বয়হীন কেউ আর চলতে পারবে না। সকলকেই একটা নিয়মের মধ্যে আসতে হবে।

এখন যদি সরকার স্বীকৃতি দিয়েই দেয় এবং আলেমদের একটা মহল সেটা গ্রহণও করে ফেলে তখন কী হবে? বেফাক কি সবাইকে আটকাতে পারবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : আমি মনে করি সরকার এভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না।  সিংহভাগ উলামায়ে কেরামকে পাশ কাটিয়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কেউ যদি কোনো ভূমিকা পালন করে, তাহলে তারাই উলামায়ে কেরাম থেকে বিছিন্ন হয়ে যাবে।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ