শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


উজবেকিস্তানের নিকৃষ্টতর স্বৈরশাসক করিমভ এর করুণ বিদায়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

epa01245908 Uzbek President Islam Karimov walks to his car during arrival ceremony in Moscow, 05 February 2008. Islam Karimov arrived in Moscow for an official visit. EPA/YURI KOCHETKOV

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

সাবেক কমিউনিস্ট নেতা উজবেকিস্তানের নিকৃষ্টতর স্বৈরশাসক ইসলাম আবদুগানিয়েভিচ করিমভ ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মারা গেছেন ৭৮ বছর বয়সে। গণতন্ত্রের নামে ২৭ বছরের চরম একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটলো। রাজধানী তাশখন্দের বুক থেকে নেমে গেল কর্তৃত্ববাদের এক জগদ্দল পাথর।

উজবেকিস্তানের ৩ কোটি মানুষকে তিনি দমিয়ে রেখেছিলেন দু’যুগেরও বেশি সময়। কোন আন্দোলন-সংগ্রাম তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি। একমাত্র আজরাইলই তাঁকে টেনে নামিয়ে মাটির তলে নিয়ে গেল। উইকিপেডিয়ার ভাষ্যানুযায়ী করিমভ ছিলেন অবৈধ সন্তান। তাঁর পিতা উজবেক আর মা ছিলেন তাজিক। স্বভাবতই তাঁর দেখভাল করার কেউ না থাকায় এতিমখানাতে তাঁর ঠাঁই মেলে। ওখানে তিনি বড় হতে থাকেন। ১৯৬০ সালে তাশখন্দ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরে তাঁর রাজনীতির শুরু। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সুবাদে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত উজবেকিস্তানের নেতা হন তিনি।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসা উজবেকিস্তানের তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন; তখন থেকে পুরো দেশ তাঁর কব্জায়। উজবেকিস্তানে সেটাই ছিল সর্বশেষ সত্যিকারের নির্বাচন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি সমালোচক এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের জেলে পাঠাতে শুরু করেন। অনেককে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে সন্দেহে হাজার হাজার ধর্মপরায়ণ মুসলমানকে তিনি কারাবন্দী করেন বিনা বিচারে। ১৯৯১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ১০ হাজার ইসলামপন্থী মানুষকে কারারুদ্ধ করেন। বন্দীদের নির্যাতন চালানো ও গুম করে ফেলা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। তুহির ইয়ালদুশ ও জুম নামাংগানী নামক ইসলামিক মুভমেন্ট অফ উজবেকিস্তানের ২ নেতাকে তাঁদের অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।

তিনি দাবি করেন উজবেকিস্তান তাদের মতো করে গণতন্ত্রের চর্চা করছে। ইসলাম করিমভের এই কথিত গণতন্ত্রে বাকস্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার কোন বালাই ছিল না। মসজিদ নির্মাণেও অনুমতি নিতে হত। সংবাদপত্রের উপর আরোপ করা হয় কড়া সেন্সরশিপ। জনগণের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণ ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ৩০০টি আইন ও বিধি প্রণয়ন করা হয়। ওয়াজ, সভা-সমিতি ও গণজমায়েতের উপর রয়েছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। দাসপ্রথা উচ্ছেদে করিমভ সরকার তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বর্তমানে উজবেকিস্তানে ১২ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু দাসরূপে প্রভূদের হাতে বন্দী।

১৯৯৯ সালে তিনি এক হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যান। এরপর তিনি বিরোধীদের ওপর দমন-নিপীড়ন আরও তীব্র করেন। ২০০৫ সালে আনদিজানে এক সরকারবিরোধী গণবিক্ষোভ দমন করা হয় নির্মমভাবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, সেখানে শত শত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীকে সেনারা হত্যা করে। নিপীড়নের ভয়াবহতায় নিজেই নিজের রেকর্ড ভাঙতেন করিমভ। তিনি দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ  মুজাফফর অভাজভ ও খুজনিদ্দিনকে  ফুটন্ত পানিতে ফেলে সিদ্ধ করে মেরেছেন বলে জানান দেশটিতে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত Craig Murry (২০০২-২০০৪)।

দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার ভাষ্যানুযায়ী ১৯৯৬ সালে পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে গিয়ে করিমভ বলেন, ‘ইসলামপন্থীদের অবশ্যই মাথায় গুলি করে হত্যা করতে হবে। আপনারা যদি সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন, প্রয়োজনে আমি নিজে তাদের প্রতি গুলি চালাবো।’ (“Such people must be shot in the head,” he said of the Islamists in a speech to parliament in 1996. “If necessary, if you lack the resolve, I'll shoot them myself.” The Independent, 03.09.16)

People carry a coffin during a mourning ceremony following the death of Uzbek President Islam Karimov, in Registan Square in Samarkand, Uzbekistan, September 3, 2016. REUTERS/Stringer

প্রেসিডেন্ট করিমভ ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ। করিমভ কমদামে কৃষকের নিকট হতে তুলা কিনে চড়া দামে বিদেশে রপ্তানী করতেন বলে অভিযোগ আছে। তিনি নিজেও বিপুল সম্পদ জোগাড় করেন, মন্ত্রী ও দলীয় ক্যাডারদেরও সম্পদের মালিক হতে সহায়তা করেন। দি টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিবেদন মতে ‘২০০৩ সালে জনৈক বিচারক আমেরিকার নিইজার্সিতে করিমভের স্ত্রীকে ৪৫ লাখ ডলারের স্বর্ণালংকার, দুবাই ও জেনেভায় ১ কোটি ১০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক মানের অবকাশ যাপন কেন্দ্র, নাইটক্লাব ও টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ সুবিধা বাবত ৬ কোটি ডলার প্রদান করেন’ (In 2003 a judge in New Jersey awarded Ms Karimova $4.5 million of jewellery, at least $11 million of investments in Dubai and Geneva, and business interests valued at $60 million – including a ski resort complex, nightclubs and telecommunications investments. The Telegraph,02.09.16)।

নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস

প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ ক্ষমতায় আরোহণের পর সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতিকে ধ্বংস করে দেন। নির্বাচন কমিশন ছিল সাক্ষীগোপাল। দলীয় ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে ভোট পরিচালনা করতেন। জনগণ ভোটকেন্দ্রে আসুক বা না আসুক তাতে কিছু যায় আসে না। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বিবেচনায়, দেশটিতে কখনও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালের নির্বাচনে ৯০.৩৯ ভাগ ভোট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন করিমভ।

করিমভ পরবর্তী উজবেকিস্তান

ক্ষমতার একক কোনো উত্তরসূরি নেই। নিপীড়ণের মুখে প্রতিপক্ষ তো দূরে থাক নিজের উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেননি এই কমিউনিস্ট নেতা। এমনকি করিমভের নিপীড়ণ থেকে রক্ষা পায়নি তার সম্ভাব্য উত্তসূরি বড় মেয়ে গুলনারা করিমভা। টুইটারে সরকারের সমালোচনা করায় তাঁকে ২০১৪ সাল থেকে গৃহবন্দি করে রেখেছে করিমভ সরকার। গুলনারা তার বাবা করিমভকে স্ট্যালিনের সঙ্গে তুলনা করেন। গুলনারা করিমভা একাধারে প্রফেসর ও কুটনীতিক। হার্ভাড থেকে মাস্টার্স করা ও রাজনীতি বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রীধারী গুলনারা মস্কো ও নিউ ইয়র্কে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্ভবত করিমভের কোন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল না। বন্দুকের নলের মুখে তিনি তাঁর মেয়ে ও নাতি নাতনিতের রাষ্ট্রপতির সরকারী বাসভবন থেকে বের করে দেন। জামশেদ নামক এক ভাগিনাকেও তিনি মনস্তাত্ত্বিক হাসপাতালে অন্তরীণ করে রাখেন। করিমভের উত্তরসূরীগণ নিবর্তনমূলক নীতি গ্রহণ করার সম্ভাবনা বেশি।

মধ্য এশিয়ার অনলাইন নিউজপোর্টাল ফারগানার বার্তা সম্পাদক দানিল কিসলভ বলেন,

Central Asian news portal Fergana.ru News editor Daniil Kislov said unrest was not likely in the transition period. “It’s quiet like a cemetery, as if not just Karimov but everyone had died,” he said. “There’s no discussion, no opposition, no civil society, it’s empty territory, so nothing will happen, nothing will change.” (The Guardian, 04.09.16)

‘উজবেকিস্তানে সম্ভবত কোন সহিংসতা হবে না কারণ এখানে বিরাজ করছে কবরের নীরবতা, কেবল করিমভ নয় সব মানুষ মারা গেছে। এখানে কোন আলোচনা নেই, বিরোধিতা নেই, সুশীলসমাজ নেই, সম্পূর্ণ শুন্য ভূখণ্ড, সুতরাং কিছু ঘটবে না, কোন পরিবর্তন আসবে না’ (দি গার্ডিয়ান, ০৪.০৯.১৬)

উজবেকিস্তান মধ্য এশিয়ার সমৃদ্ধশালী দেশ। ইসলামি কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের লালনকেন্দ্র। বুখারা, সমরকন্দ, ফারগানা প্রভৃতি অঞ্চল এখনো ইসলামি সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। বিখ্যাত হাদিস বিশেষজ্ঞ ইমাম বুখারী এখানে বসেই জগদ্বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ সহীহ আল বুখারী সংকলন করেন এবং দরস প্রদান করেন। জনসংখ্যার দিক দিয়ে মধ্য এশিয়ার অর্ধেক মানুষ উজবেকিস্তানে বসবাস করে। ৪ লাখ ৪৮ হাজার কিলোমিটার আয়তনের এ দেশের খনিতে যে বিপুল স্বর্ণ মজুদ রয়েছে পরিমাণের দিক দিয়ে তা বিশ্বের ৪র্থ। বার্ষিক ৮০ টন ক্রুড স্বর্ণ খনি থেকে উত্তোলন করা হয়। এ দেশে বিপুল পরিমাণে মজুদ রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস। প্রতি বছর ৭০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করা হয়। তামা ও ইউরেনিয়াম মজুদের দিক দিয়ে এদেশের অবস্থান বিশ্বে যথাক্রমে ১০ম ও ১২তম।

উজবেকিস্তানে শান্তি বিরাজ করুক, নির্মমতার অবসান ঘটুক, জনগণ হারানো অধিকার ফিরে পাক, জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক, ইসলামী আদর্শের ঝাণ্ডা উড়ুক– এটাই কোটি কোটি মানুষের আকুতি।

লেখক: অধ্যাপক, ওমরগণি কলেজ চট্টগ্রাম। সম্পাদক, মাসিক আত তাওহিদ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ