শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


পাক-ভারত বৈরিতার নেপথ্যে কাশ্মীর সঙ্কট

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

kashmir22কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক; আওয়ার ইসলাম

পাহাড়ের পর পাহাড় তুষারমণ্ডিত ধবল শৃঙ্গমালা আর ছলছল ফেনায়িত উচ্ছ্বাসে পাড় ঝাঁপানো নদীর পর নদীর দেশ ভূস্বর্গ কাশ্মীর। কাশ্মীর আসলে স্বাধীন দেশ নয়; বলা ভালো জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশ। যার রয়েছে ২২টি জেলা। যথা- জম্মু, উধমপুর, দোদা, রাজৌরি, ফুলয়াম, অনন্তনাগ, পুঞ্চ, বারামুলা, বদগাম, শ্রীনগর, লেহ, কুপওয়ারা, পহেলগাঁও কারগিল, কাথুয়া, সুতাবু, চুশুল, খাপালু, লামায়ুর, চিলাস, হারা আর কিস্তোয়ার। একটি নদী- এপারে কাশ্মীর, ওপারেও কাশ্মীর। ওপারের আজাদ কাশ্মীরে রয়ে গেছে সাতটি জেলা। একটার রাজধানী শ্রীনগর, আরেকটা রাজধানী মুজাফফরাবাদ।

বড়ই ভাগ্য বিড়ম্বিত কাশ্মীরবাসী। বহুমুখী সঙ্কটে এদের দিনাতিপাত। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্ধ বা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গোলাগুলি ও রক্তপাতের ঘটনা কাশ্মীরের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক। কাশ্মীর সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। ভারতীয়রা এক্ষেত্রে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বটিকে নয়, বরং সামরিক বাহিনীকে প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করে। ভারত চেষ্টা করছে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি, জরুরি সহায়তা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে দু’দেশের মানুষের সম্পর্কের বৈরিতা কমাতে।

এ প্রেক্ষিতেই সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের গোপন বৈঠক হয়েছে। এরপর গত ৯ ডিসেম্বর (বুধবার) পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত তিন দিনের ‘হার্ট অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সন্ত্রাস থেকে কাশ্মীর বিরোধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নতুন নাম ‘কমপ্রিহেনসিভ বাইল্যাটারেল ডায়ালগ’ নামে শান্তি আলোচনা শুরু করেছে ভারত ও পাকিস্তান। (সূত্র: এক্সপ্রেস ট্রিবিউন)

কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে ইতোপূর্বে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে পাকিস্তান। আবার অনেক আন্তর্জাতিক শক্তি কাশ্মীরি জনগণকে ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। বস্তুত স্বাধীন দেশ গঠন করার অধিকার জাতিসংঘ তাদের দিচ্ছে না। যে জাতিসংঘ অবরোধের মাধ্যমে ইরাকে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে, ফিলিস্তিনে দুটি রাষ্ট্র গঠন করার মাধ্যমে ইহুদিদের কাছে মুসলিমদের এলাকা ছেড়ে দেয়ার কথা বলছে ওই জাতিসংঘই কাশ্মীরে স্থানীয়দের স্বার্থ রক্ষায় চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে।
kashmir4

তবে হার্ট অব এশিয়া (এইচওএ) সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিটা একটু ভিন্নভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। কিছুটা আশার আলো দেখতে পান তারা। এর কারণ ২০১২ সালের পর তিনিই প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি পাকিস্তান সফরে গেলেন। সুষমা স্বরাজ বলছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যের সম্পর্ক জোরদার করার সময় এখনই। একে অন্যের সঙ্গে ব্যবসার জন্য যথেষ্ট পরিপক্বতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন। এ ছাড়া গুরুত্ব দেয়া উচিত আঞ্চলিক বাণিজ্য শক্তিশালী করা। এর জন্য চাই সহযোগিতা। বৈঠকের শেষ দিন তিনি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের জটিলতা উত্তরণে আশার আলোও দেখালেন। বললেন, মতানৈক্যগুলো মিটিয়ে ফেলতে আলোচনা আবার শুরু হবে।’ আলোচনার দিনক্ষণ যথাসময়ে জানানোর অঙ্গীকার করেন তিনি।

তবে এ আলোচনা প্রক্রিয়া সফল হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা। এর আগে আলোচনা শুরু হলেও বিভিন্ন কারণে স্থগিত হয়ে গেছে বারবার। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। আলোচনার মূলে সন্ত্রাসবাদ থাকবে। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুকে অবহেলা করা যাবে না বলেও বিশ্লেষকেরা মত দেন। তবে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানিদের তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার বিষয়টি নিয়ে অসন্তুষ্ট ভারত। মোদি এ ইস্যুতে মোটেই তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বরদাশত করে না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তিনি এক সমঝোতায় পৌঁছেছেন। ২০১২ সালে কাশ্মীর নিয়ে শেষ কথা হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি ও নওয়াজ শরিফের মধ্যে এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়। এতে সম্পর্কের শীতলতা খানিকটা কেটেছে। আবার এর মধ্যেই দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা ব্যাংককে মিলিত হন এক বৈঠকে। এসবের ফলে ইসলামাবাদে সুষমা স্বরাজ কাশ্মীর আলোচনার রেশ আনলেন।

ওই সম্মেলন চলার সময়ে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গেও আলাদা ভাবে কথা বলেছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী। সূত্রের খবর, কাশ্মীরের মতো কয়েকটি বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে একাধিকবার এই কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করেই দুই দেশ মুখ দেখাদেখি বন্ধ রেখেছে। এবার বিরাট ব্যতিক্রম। উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালে প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হয়। এই কাশ্মীর প্রশ্নে অন্তত ৫টি সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। গত ৩১ বছরে সার্ক সামিট হওয়ার কথা ৩১টি। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে ১৮টি। এক ডজন সার্ক সম্মেলন প্রধানত দুই দেশের বৈরিতায় ভেস্তে গেছে। এবার আশা করা যাচ্ছে সেই বৈরিতার বরফ গলতে শুরু করেছে। সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে ভারতের মিডিয়া বলেছে, বন্ধুত্বের হাতটা ভারতই প্রথম বাড়িয়ে দিতে চাইলো এই উপমহাদেশে শান্তির জন্য। দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করে তোলাই এর লক্ষ্য। আগামী বছরেই পাকিস্তান সফরে ‘সার্ক’ জোটের সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৫ বছর পর এই প্রথম কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন পাকিস্তানে।
sifali_kashmir

আগের তুলনায় কাশ্মীরিদের ওপর দমনপীড়ন কোনো অংশেই কমেনি। আমরা শুধু গত মাসের (নভেম্বর) দুটি ঘটনার দিকে তাকালে এর সত্যতা যাচাই করতে পারি। গত ২ নভেম্বরও সীমান্তে গোলাগুলিতে বোনাদিপাড়া জেলায় ভারতীয় দুই সৈন্যের প্রাণ যায়। কাশ্মীরের জাইনকোটে ৭ নভেম্বর ভারতীয় সিপিআরএফ সেনাদের ছোড়া টিয়ার শেলের আঘাতে এক যুবকের মৃত্যুর তিন দিন পরও উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। হত্যার বিচার চেয়ে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। কাশ্মীরের রাস্তায় বিক্ষোভ চলাকালে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। ১৩ নভেম্বর ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের বাইরে শিখ, মুসলিম গোষ্ঠীসহ কয়েক হাজার প্রবাসী ভারতীয় বিক্ষোভ করেন। এর কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চেয়ে হাজার হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে।

আমরাও আশা করবো যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা কাশ্মীরিদের আজাদী আন্দোলনের মর্মার্থ অনুধাবন করে চিরবৈরি দেশ দু’টি সময়োচিত ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে কার্পণ্য করবে না। বিষয়টি আরো স্পষ্ট করেন ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার আব্দুল বাসিত। তিনি ভারতের হিন্দি নিউজ চ্যানেল ‘আজতক’-এর ‘এজেন্ডা আজতক’ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার আসল কারণ জাকিউর রহমান লাখভি, হাফিজ সাঈদ বা দাউদ ইব্রাহিম নয়, বরং জম্মু-কাশ্মির ইস্যু।’ আব্দুল বাসিত আরো বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে ১৯৬৫, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছে, কারগিলেও হয়েছে। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই আপনারা কাশ্মীরের মানুষদের অনুভুতি মোতাবেক এই সমস্যাকে সমাধান করে দিন, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। পাকিস্তানেও ভারতের জন্য বিশ্বাসের বাতাবরণ প্রতিষ্ঠিত হবে।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ